পশ্চিমবঙ্গে অনগ্রসর শ্রেণী (ওবিসি) হিসেবে ৭৭টি সম্প্রদায়কে অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়টি নিয়ে উদ্ভূত বিতর্কে সুপ্রিম কোর্টে নতুন মোড়। গতকাল শীর্ষ আদালতে রাজ্য সরকার জানিয়েছে যে, ওবিসি তালিকাভুক্তির নতুন সমীক্ষা প্রক্রিয়া হাতে নেওয়া হয়েছে এবং আগামী তিন মাসের মধ্যে এই কাজ সম্পন্ন করার লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছে। ফলে মামলার পরবর্তী শুনানি জুলাই মাসে হবে বলে আদেশ দিয়েছে আদালত।
পটভূমি
কলকাতা হাইকোর্টের রায়ে ৭৭টি সম্প্রদায়ের ওবিসি শ্রেণীকরণ বাতিল হয়ে যাওয়ায় রাজ্য সরকার সুপ্রিম কোর্টে চ্যালেঞ্জ করে। উল্লেখ্য, এই সম্প্রদায়গুলির বেশিরভাগই সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ভুক্ত। এই প্রেক্ষাপটে পশ্চিমবঙ্গ সরকার জানায়, নতুন করে ‘অনগ্রসরতা’ নিরূপণের জন্য একটি বিশদ সমীক্ষা চালানো হবে।
সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি বি.আর. গাভাই এবং এ.জি. মাসিহ-এর বেঞ্চ এই মামলার শুনানি গ্রহণ করেন। পশ্চিমবঙ্গের পক্ষে প্রবীণ আইনজীবী কপিল সিব্বল জানান, পশ্চিমবঙ্গ অনগ্রসর শ্রেণী কমিশন ইতোমধ্যে আবেদনকারী সম্প্রদায়গুলির উপর একটি মানদণ্ডভিত্তিক সমীক্ষা শুরু করেছে। এই প্রক্রিয়া তিন মাসের মধ্যে সম্পন্ন হবে বলেও জানান তিনি।
বিচারপতি গাভাই পর্যবেক্ষণে বলেন, ‘‘যদি সমগ্র প্রক্রিয়া নতুনভাবে সম্পন্ন হয় এবং পরে সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেওয়া হয়, যেখানে কেউই বঞ্চিত বা ক্ষুব্ধ না হন, তবে এই মামলা নিছক একাডেমিক আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়াবে।’’
কলকাতা হাইকোর্টের বিতর্কিত রায়
পূর্ববর্তী রায়ে কলকাতা হাইকোর্ট মন্তব্য করেছিল, পশ্চিমবঙ্গ সরকার এবং অনগ্রসর শ্রেণী কমিশন অত্যন্ত তাড়াহুড়ো করে ৭৭টি সম্প্রদায়কে ওবিসি হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। অভিযোগ ওঠে, তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রীর একটি রাজনৈতিক সমাবেশে দেয়া ঘোষণাকে বাস্তবায়ন করার জন্যই এই তৎপরতা চালানো হয়। যথাযথ সমীক্ষা, আবেদন আহ্বান এবং আপত্তি আমন্ত্রণ ছাড়াই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
আদালতের মতে, সংবিধানের নির্ধারিত বিধান লঙ্ঘন করে এই শ্রেণীকরণ করা হয়েছে। জনগণের সামনে তথ্য প্রকাশ না করেই সংরক্ষণ কার্যকর করা হয়েছে। আদালত আরও উল্লেখ করে, ৪২টি শ্রেণীর মধ্যে ৪১টি মুসলিম সম্প্রদায়ভুক্ত হওয়ায় এই সিদ্ধান্তে ধর্মীয় পক্ষপাতিত্বের সুস্পষ্ট ইঙ্গিত ছিল। এটি সংবিধানের ১৬(৪) ধারা এবং ১৯৯৩ সালের আইন অনুযায়ী বৈধ ছিল না।
এছাড়া, আদালত স্পষ্ট জানায়, সংরক্ষণ ধর্মের ভিত্তিতে নয়, বরং পিছিয়ে পড়া অবস্থান এবং উপযুক্ত তথ্যের ভিত্তিতে প্রদান করতে হবে।
বর্তমান পরিস্থিতি ও আগামী দিকনির্দেশ
রাজ্যের পক্ষ থেকে সুপ্রিম কোর্টে জানানো হয়েছে, রাজ্যের সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর হার ২৭-২৮% হলেও সংরক্ষণ প্রদানের মাপকাঠি ধর্ম নয়, বরং বাস্তব ভিত্তিক সামাজিক ও অর্থনৈতিক অনগ্রসরতা। নতুন সমীক্ষার মাধ্যমে স্বচ্ছ পদ্ধতি অনুসরণ করেই তালিকা তৈরি করা হবে বলে দাবি করা হয়েছে।
সুপ্রিম কোর্ট এই প্রক্রিয়া চলাকালীন মামলার শুনানি জুলাই মাসে মুলতবি রেখেছে। তবে এটি স্পষ্ট যে, যদি নতুন সমীক্ষার ফলাফল নিয়ে কোনও পক্ষ ক্ষুব্ধ না হন, তাহলে বিষয়টি আদালতের পর্যালোচনার বাইরে চলে যেতে পারে।
ওবিসি সংরক্ষণ নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের এই মামলা সামাজিক ন্যায় এবং সংবিধানসম্মত প্রক্রিয়ার এক গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত। ধর্মের ভিত্তিতে সংরক্ষণ নয়, বরং পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য সঠিক ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সংরক্ষণ প্রদান করা হবে কি না, সেটাই এখন দেখার বিষয়।