বটগাছ ও একজন ফেরেশতা - TDN Bangla
  • About Us
  • Privacy Policy
  • Contact Us
Friday, May 9, 2025
  • Login
No Result
View All Result
TDN Bangla
  • হোম
  • রাজ্য
  • দেশ
  • আন্তর্জাতিক
  • খেলা
  • বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
  • শিক্ষা ও স্বাস্থ্য
  • সম্পাদকীয়
  • হোম
  • রাজ্য
  • দেশ
  • আন্তর্জাতিক
  • খেলা
  • বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
  • শিক্ষা ও স্বাস্থ্য
  • সম্পাদকীয়
No Result
View All Result
TDN Bangla
No Result
View All Result
ADVERTISEMENT

বটগাছ ও একজন ফেরেশতা

Umar Faruque টিডিএন বাংলা
December 7, 2024
| সাহিত্য ও সংস্কৃতি
মুহাম্মদ জিকরাউল হক

খবর এল, বটগাছটা আর থাকবে না। পড়ে যাবে। আমরা পড়িমরি ছুটলাম। গিয়ে দেখি, নদীর পাড় কাটতে কাটতে এসে ঠেকেছে এক্কেবারে গাছের গোড়ায়। যে কোনো সময় চাতাল সহ উপড়ে পড়বে নদীর গর্ভে। প্রত্যেক বর্ষায় আমাদের আশঙ্কা হয় এবার বুঝি রক্ষে হবে না, তলিয়ে যাবে গাছটা রাতের অন্ধকারে নদী-গর্ভে। চাতালে এখনো দু’পাঁচজন ব’সে বটে, তবে ভয়ে ভয়ে।

বটগাছটার চারদিকে গোল করে চাতাল বাঁধানো। সেখানে সারাক্ষণই বসে থাকে কেউ না কেউ। ভোরবেলা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত। জমি ফেরৎ মুনিষ, দূর গ্রামের পথিক, ফেরিওয়ালা কে না বসে সেখানে! ব’সে, জিরোয়, গল্প করে, আবার চলে যায়। নদীর ধারে ধারে কত গ্রাম। এই একটা পথ ধরলে সব গ্রামই যাওয়া যায়। এমনকি যাওয়া যায় শহরেও। গাছটার পশ্চিম দিকের রাস্তাটা চলে গেছে প্রাইমারী স্কুল পর্যন্ত। গ্রামের চাষ-বাসের জমিজমা পূর্বদিকের রাস্তায়। উত্তর দিকে মরা নদী, যেখানে প্রায় সারাবছরই জল থাকে না, বর্ষাটুকু ছাড়া। আর দক্ষিণ দিকে আমাদের গ্রাম। তুমি যেখানেই যাও না কেন বাপু, বটগাছ তোমার পথে পড়বেই। আর এখানেই বসে আমাদের স্কুল ফেরত আড্ডা। স্কুলে যাওয়ার সময় সক্কলে জমাও হই এই গাছতলায়।

চাতালটা বড়। গাছের চারদিক ঘিরে। তাতে তিন-চার রকমের আড্ডা বসে। ছোটদের। মাঝারীদের। বড়দের। কখনো কখনো একদিকে ছোটদের তো অন্যদিকে বড়দের। ছোটরা আড্ডা দিলে বড়রা কিছু বলত না । শুধু রাতের বেলা ছোটদের আড্ডা দেয়া বারণ। তখন তাদের পড়ার সময়। আমরা ছোটরা হয়ত অপেক্ষা করছি বন্ধুদের আসার, ওদিকে বড়দের গল্প জমে উঠেছে, আমরা তাদের গল্পে কান রেখেছি। কোন সিনেমা রিলিজ হল, হিট করল নাকি সুপারহিট, কার অভিনয় কেমন হল, একা সালমান খানেই বাজিমাত করে দিয়েছে, ওর জায়গায় অন্য কাউকে এই চরিত্রে মানাতই না ইত্যাদি সব আলোচনা।

আর আমাদের ছোটদের আলোচনার জগৎ ছিল ভিন্ন। কার কাছে কটা টিপি আছে, কোন মিস্ত্রীকে বলে একটা কাঠের ক্রিকেট ব্যাট বানানো যায়, ভোরে কে কে আম কুড়োতে যাবে, বাসাতে পাখির ডিম থেকে বাচ্চা ফুটল কিনা, গ্রামে কার বিয়ে, কতদিন বাকি, কাকে কাকে নেমন্তন্ন করতে পারে, এবার গ্রামে জলসা হবে কিনা, বিকালে খেলতে গিয়ে কাকে দলে নেব কাকে নেব না, কার গাছে কুল পেকেছে, কে কে যাবে লুকিয়ে পাড়তে এইসব। তারমধ্যেই কদাচিৎ ছোটদের সঙ্গে বড়দের আলোচনার বিষয়বস্তু মিলে যেত। যেমন সেদিন।

কথাটা প্রথমে পাড়ল শাকির, বড়দের মধ্য থেকে। বলল, “কাইল রাইতে ফেরেশতা দেখাছি।”

‘ফেরেশতা’ শুনেই আমরা চমকে উঠলাম। সবাই ঝুঁকে পড়লাম তার দিকে। এও কি সম্ভব! ফেরেশতা চোখে দেখা যায় না। তাঁরা একপ্রকার জ্যোতির্ময় জীব। আল্লার হুকুম পালন করাই যাঁদের একমাত্র কাজ। তাঁদের শাকির ভাই দেখল কী করে! নিজের চোখে! তাও আবার আমাদের মতো পাড়াগাঁয়ে!

মোফা ব্যঙ্গ করে বলে উঠল, “তুই আল্লার ওলী নাকি বে, যে ফেরেশতা দেখতে পাবি? তুই তো মুইতা পানি লিস না।”

মোফার ব্যঙ্গ শুনে শাকির চুপ করে গেল। প্রশ্নটা মোফা খারাপ করেনি। যে শাকির কোনোদিন মসজিদে যায় না, নামাজ পড়ে না, রোজ ভিডিও দেখতে যায়, সে দেখতে পাবে ফেরেশতা! আমরাও বিশ্বাস করতে পারছি না। তবে, শাকিরের সিরিয়াসভাবে চুপ করে থাকা আমাদেরকে কিছুটা ধন্দে ফেলল। দেখলে দেখতেও তো পারে। তাছাড়া সে ‘ফেরেশতা’ নিয়ে মিথ্যা কথা বলতে যাবে কেন?

শাকির নীরবতা ভেঙে সাফাই গাইল। বলল, “তোরা বিশ্বাস কর, সত্যিই কাইল রাইতে হামি ফেরেশতা দেখাছি।”

মোফা বলল, “কিরা কাট। কিরা কাইটা কহা যে, আল্লার কিরা হামি ফেরেশতা দেখাছি।”

শাকির কিরা কাটল। বলল, “আল্লার কিরা হামি ফেরেশতা দেখাছি।”

এরপরে আর কারো কিছু বলার নেই। আল্লার নামে কিরা কেটে কেহ মিথ্যা কথা বলবে না। শাকির আমার দূর সম্পর্কের মামা হয়। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কুণ্ঠে দেখালা মামু?”

শাকির বলতে লাগল, “আর কহিস না ভাইগ্না। কাইল বাজারে জালসা আহলো। জালসা শুনার নাম কইরা ভিডিও দেখতে গেহেনু। বাড়ি আসার সময় দেখি টুক্কুর দোকানের কাছে একটা ফেরেশতা খাড়ো হইয়া জালসা শুনছে। দেখা হামার কালজি কাঁইপা উঠল।”

তার কথা শুনে আমাদেরও কলজে কেঁপে উঠল। রাজিউল জানতে চাইল, “তুই কী কইরা বুঝলি যে ঐটা ফেরেশতা আহলো?”

শাকির ফেরেশতার বর্ণনা দিতে লাগল। বলল, “দশ হাত লাম্বা, তিন হাত চাওড়া একজনা টুক্কুর দোকানে একটা হাত উচ্চা কইরা রাইখা খাড়া হইয়া দূরনে জালসা শুনছে। এবার তোরাই কহা আত্তাবাড়া লোক হাঙরে গাঁয়ে কেহু আছে?”

রাজিউল আবারও বলল, “তুই চিনতে পারলি না হাঙরে গাঁয়ের কেহু কি না?”

শাকির উত্তর করল, “ঠান্ডার রাইত। চাদর দিয়া মুখ-টুক ঢাইকা আছে। হামি কামন কইরা চিনব।”

আমি বললাম, “যদি হয় তো আলেম মিস্ত্রি হইতে পারে। আর না হইলে ফেরেশতা।”

আমার কথাটা সকলের কানে লাগল। পছন্দ হল। সকলেই বলল, “হা, তুই ঠিকই কইহাছিস। আলেম মিস্ত্রীকে পুছ কইরা দেখতে হইবে।”

কিন্তু পুছ করবে কে? তাঁর সামনাসামনি হওয়ার সাহস কার আছে? আমাদের বাপ-দাদারা তাঁর ভয়ে কাঁপতে থাকে তো আমরা কোন ছার! গাঁয়ের মধ্যে এত সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি দ্বিতীয়টি নেই। যেমন লম্বা তেমন চওড়া। এমন সুপুরুষ গাঁ-গ্রামে খুব কমই জন্মান। যাঁর ব্যক্তিত্বের সামনে নুয়ে থাকে সারা গাঁও। গ্রামের সর্দার। সর্দার হওয়া তাঁদের বংশের পরম্পরা। মোল্লা পরিবার। এই একটা পরিবার দ্বীনদারিটা ধরে রেখেছে মজবুত করে। যে পরিবারের সুনাম ছড়িয়ে আছে আশপাশের নানান গাঁয়ে। আর তাঁদের কারণেই আমাদের গ্রাম দ্বীনদারির ক্ষেত্রে অন্যান্য গ্রামের কাছে দৃষ্টান্ত।

আলেম মিস্ত্রি পথ চলেন মাথা নিচু করে। মাটির দিকে তাকিয়ে। হাতে থাকে একখানা ছাতা। লম্বা লাঠির ছাতা। কী শীত কী গ্রীষ্ম, ছাতা তাঁর হাত ছাড়া হয় না কখনো। তাঁর আগমন বার্তা শুনলে ছেলেরা খেলা থামিয়ে দেয়, বড়দের আড্ডায় গল্প থেমে যায়। বিড়িটা নিভে যায়। সকলের শ্বাস বন্ধ হয়ে যায় কিছুক্ষণের জন্য। পথচলতি মেয়েরা পাশের গলিতে ঢুকে পড়ে। নচেৎ থমকে দাঁড়ায় মুখের ঘোমটা আরো খানিকটা টেনে নিয়ে।

তিনি তখন ছোটো। কাঠ মিস্ত্রির কাজ শিখেছেন। আর একটা কাঠ চেরাই করার মেশিন কিনেছেন। ক’জন মিস্ত্রি তাঁর কাছে খাটে। স্বাধীন ব্যবসা। এমন সময় কিছু লোক এসেছেন শহর থেকে। সে কথা তিনি একদিন বলছেন আমাদের সামনে, “জিপ গাড়ি ঢুকল গাঁয়ে। ‘পি ডব্লিউ ডি’তে নাকি চাকরি দিবে। হামি মারনু দৌড়। লেচুর বাগানে যাইয়া লুকিয়া রহইনু। চাকরি হামি লিব না।”

আমি জিজ্ঞাসা করলাম,”চাকরি লিবেন না কেনে? চাকরি মানুষ পায় না।”

তিনি তার উত্তরে বললেন,”মাসে এক টাকা বেতন। আর হামার ইনকাম মাসে ম্যালাই। হামার কামের লোকরাই মাসে এক টাকা কইরা পায়। হামি চাকরি লিয়া করব কী!”

আমার কাছে যুক্তিটা খাসাই মনে হল। তারপরেও জিজ্ঞাসা করলাম, “এখনি কি মনে হয় যে চাকরিটা লিলেই ভালো হইতোক?”

“হয়রে ভাইগ্না। মনে হয়। এখনি তো বেতন বাইড়াহ গেছে। মনে হয় চাকরিটা লিলেই ভালো হয়তোক।”

তিনি কথাটা বললেন বলার জন্যই। এজন্য তাঁর কোনো আফশোষ আছে বলে মনে হল না। পরক্ষণেই বললেন, “চাকরি মানে পরের আন্ডারে কাম করা। আর হামরা হইনু স্বাধীন। তোরা লেখাপড়া করা চাঙড়া ভালোই জানিস স্বাধীনতা মানে কি।”

তাঁর আছে যে কোনো ধরণের সমস্যা সমাধানের অসাধারণ দক্ষতা। কোনো এক জাদুবলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে পারেন নিমেষে। তাঁর সামনে গলা উঁচু করে কথা বলার মতো লোক নেই একজনও। একদিন একটা ঘটনা ঘটল। আমরা মসজিদ থেকে এশার নামাজ পড়ে বের হয়ে এসে দেখি বটগাছের নিচে জটলা। জটলার কারণ, আলেম মিস্ত্রির এক ভাই জায়েদ মিস্ত্রি আমার দাদুর নামে উল্টাপাল্টা কীসব নাকি বলেছে। আমার দাদুর পোতারা অর্থাৎ আমার ভাইয়েরা জড়ো হয়েছে এর একটা বিহিত করতে। তাকে আজ কৈফিয়ত দিতে হবে কেন তিনি এসব কথা বলেছেন আমাদের মরা দাদুর নামে। আমার এক চাচাতো বড় দাদা জাইদুল আমাদের দুজনকে দায়িত্ব দিল মসজিদের গেটে পাহারা দিতে। কোনোমতেই যেন অন্যকোনো দিক থেকে পালিয়ে না যায়। আর জোর গলায় অন্যান্যদের উদ্দেশ্যে বলতে লাগল, “লাঠি আইনা রাখ। আইজ মাইরা হাড়-হাড্ডি ভাইঙ্গা দিব। কী তোরা সাভাই রাজি আছিস তো?”

জাইদুল দাদা চাকরি করে। তার কথার একটা দাম আছে। যেখানে প্রশ্নটা দাদুর মান-সম্মানের কেউ রাজি না হয়ে পারে! তাছাড়া আরেক সাবেদ দাদা জাইদুল দাদার কথা পূর্ণ সমর্থন করে বসল। সবাই চেঁচিয়ে উঠে বলল, ”হামরা সাভাই রাজি।”

আমরা সোৎসাহে ছুটলাম মসজিদের দিকে। গিয়ে দেখি জায়েদ মিস্ত্রি নামাজ শেষে হাত তুলে দোয়া করছেন। আর তার পাশে বসে আছে তারই এক ছেলে আমানুল। আমার খটকা লাগল। আমানুল তো নামাজ পড়ে আমাদের সঙ্গেই বেরিয়ে গিয়েছিল। সে তবে এখানে কেন? সে কি জটলার খবর শুনে ফিরে এসেছে বাবাকে খবর দিতে? তাই হবে হয়ত। আমার শঙ্কাই সত্যি হল। দোয়া শেষ হলেই আমানুল তার বাবাকে জটলার খবর দিল। জায়েদ মিস্ত্রি খবর শুনে বাড়ির জন্য উঠে না পড়ে বসে বসে যিকির করতে লাগলেন। আমার মনে হল খবরটা জাইদুল দাদাকে দেয়া দরকার। আমি ছুটলাম বটগাছের নিচে জটলার দিকে। গিয়ে দেখি লোকজন আরো বেড়েছে। সবাই চাইছে জায়েদ মিস্ত্রির একটা শিক্ষা হওয়া দরকার। আমি গলা উঁচু করে খবর দিলাম, “জায়েদ মিস্ত্রি মহজিতনে বাহারবে না। অর ব্যাটা অখে খবর দিয়াছে যে হামরা অর বাপকে মারার গেনে জড়ো হইয়াছি।”

জাইদুল দাদা খবরটা শুনে ফুঁসে উঠল। বলল, ” জাততাই রাইত হোক, হামরাও বাড়ি যাইছি না। দেখি ওই কাততাখন পর বাড়ি যায়।”

আমি আবারও ছুটলাম মসজিদের দিকে। উৎসাহে টগবগ করে ফুটছি। আজ একটা হেস্তনেস্ত করেই ছাড়ব। দাদুকে নিয়ে উল্টাপাল্টা বলা? তুমি তো চেনো না আমাদের গুষ্টিকে! কিন্তু গিয়ে যা শুনলাম তাতে আমার উৎসাহে কেউ যেন জল ঢেলে দিল। আমার পাহারাদার সঙ্গী আজাবুল আমাকে বলল, “মসজিদে আলেম মিস্ত্রীও আছে। ওরা তিনজনা মিলা সাল্লাহ পরামর্শ করছে।”

শুনে আমি হতোদ্যম হয়ে তাকে বললাম, “যা। যাইয়া জাইদুল দাদাকে খবরটা দিয়া আই। হামি রহইছি এটঠেখানে।”

আজাবুল চলে যেতেই আমি অবাক হয়ে দেখলাম ওরা মসজিদ থেকে তিনজন বের হয়ে এলো। বাড়ির দিকে রওয়ানা হল। সামনে আলেম মিস্ত্রি আর তাঁর পেছনে বাপ-ব্যাটা। ওদের পেছন পেছন আমি।

আলেম মিস্ত্রি জটলার কাছে গিয়ে খুব ঠান্ডা গলায় বললেন, “কী ব্যাপার তোমাঘেরে? আত্তা মানুষজন?”
জাইদুল দাদা যে তাঁকে দেখে থতমত খেয়ে গেছে তা বোঝা যাচ্ছে। তারপরও নিজেকে সামলে নিয়ে বলে উঠল, “জায়েদ চাচা হামাদের দাদুর নামে উল্টাপাল্টা কীসব বইলা বাড়াইছে। হামরা ওঁর আত্তাটি পোতা রহইতে এটা সহ্য করব না। হামরা আইজ….”

আলেম মিস্ত্রি কথা শেষ করতে দিলেন না। কথার মাঝেই তিনি জোরে হেসে উঠলেন। অনেকক্ষণ হাসলেন। তারপর হঠাৎ হাসি থামিয়ে বললেন, “দেখ জাইদুল। তুই শিক্ষিত ছেলে। চাকরি-বাকরি করিস। সমাজে তোর একটা মূল্য আছে। এটা কেহু না বুঝলেও হামি বুঝি। তোর দাদা মানে হামার চাচাও ছিল সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তি। তোরা আর ক’দিন দেখাছিস তোর দাদুকে? হাঙরেকে কোলে পিঠে কইরা মানুষ কইরাছে। আত্তা ভালো মানুষ হামি হামার গোট্টা জীবনে দেখিনি। কাত্তা মানুষকে বাড়িতে ডাইকা আইনা খিলিয়াছে। বাড়ি করার গেনে জাগা দিয়াছে। গাঁয়ে কুয়া আহলো না। কুয়া বানিয়া দিয়াছে। মহজিত বানাইতে সাহায্য কইরাছে। তোর বাপরা সাত ভাই মানে তাঁর সাতটা ব্যাটাকে মানুষ কইরাছে। এরকম একজন মানুষ, তাঁকে কেহু কিছু কহইলে কী আইসা যায়। যাকে গোটা নয়মৌজাবাসী চিনে-জানে তার কাছে হামরা আর কী?”

আলেম মিস্ত্রির কথা শুনতে শুনতে আমাদের রাগ কখন পড়ে গেছে। তারপরেও জাইদুল দাদা বলার চেষ্টা করল,” আপনি জানেন হামরা দাদুকে কত ভালোবাসি। দাদুর ব্যাপারে কিছু শুনলে হামাদের রক্ত গরম হইয়া যায়।”

জায়েদ মিস্ত্রি কোনো কথা বলছে না। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে আলেম মিস্ত্রির ঠিক পেছনে। আলেম মিস্ত্রি আবারো বলতে লাগলেন, “সাত বাপের তোরা উনিশ ব্যাটা। তোরা সাভাই শিক্ষিত। তোঘরে মতন কোন গুষ্টিতে আত্তা চাকরি-বাকরি আছে? হামরা আর ক’দিন আছি। এরপরে তোঘরেখেই গাঁয়ের হাল ধরতে হইবে। হামার কথা শোন। যা বাড়ি যা। আর ভোরবেলা যেন তোকে মহজিতে দেখতে পাই।”

তারপরে আর কোনো কথা বলার সাহস হয়নি কারো।

স্কুলে গিয়ে লেখাপড়া করেননি কোনোদিন। বাড়ির পরিবেশে শিখেছেন আরবি। বাংলাও পড়তে পারেন। কিন্তু উপস্থিত বুদ্ধি প্রখর। স্কুল, মাদ্রাসা, মসজিদের বিভিন্ন পদে বিভিন্ন সময় দায়িত্ব সামলেছেন। এখনো সামলাচ্ছেন। যেকোনো সভায় তাঁর উপস্থিতি যেমন ছিল অবশ্যম্ভাবি তেমনি ছিল তাঁর মতামতের গুরুত্ব।

বাড়ি থেকে বেরুনোর তাঁর কয়েকটা নির্দিষ্ট সময় আছে। সকালে কাজে বেরুনোর সময়। আর আজান হলে নামাজ পড়ার জন্য মসজিদে যাওয়ার সময়। আজান হলেই আমরা বুঝতে পারতাম এবার তিনি আসবেন। এই পথেই মসজিদে যাবেন। পথে যাদেরই দেখবেন মসজিদে যেতে বলবেন।

কখনো কখনো আমাদের এমনিতেই মনে হত তিনি হয়ত আসবেন। কেমন জানি ঠান্ডা শনশনে হালকা বাতাস সেদিক থেকে বয়ে এসে তাঁর আগমনী আমাদের জানিয়ে দিত।

নাবিউল বলল, “হামার মন কহইছে তিনি এখনিকাই আসবেন।”

তার কথা শুনে আমাদেরও মনে হল তিনি আসবেন। এখন প্রশ্ন হল যদি এসেই পড়েন তাহলে কে জানতে চাইবে কাল রাতের ব্যাপারটা? নাবিউল শাকিরকে উদ্দেশ্য করে বলল,” তুই পুছ কর। তুইই তো দেখাছিলি।”

কথা শুনে শাকিরের দমবন্ধ হয়ে যাওয়ার জোগাড়। আর তখনই দেখা গেল তিনি কাজ থেকে বাড়ি ফিরছেন। আমার বিশ্বাস তিনি সামনে দিয়ে চলে যাবেন কিন্তু কেহই জিজ্ঞেস করার সাহস দেখাবে না। কিন্তু আমাদেরকে অবাক করে দিয়ে শাকির উঠে দাঁড়াল। মুখে কৃত্রিম হাসি ফুটিয়ে হাত দুটো বিনয়ের সাথে কচলাতে কচলাতে মাথা নিচে করে বলল, “আপনার কাছে একটা কথা পুছ করার আহলো।”

আলেম মিস্ত্রি বললেন,”কহানারে কী কহবি। হাত কাচলাইছিস কেনে?”

শাকির হাত কচলানো আরো বাড়িয়ে দিয়ে বলল,”আপনি কী কাইল রাইতে টুক্কুর দোকানের সামনে খাড়ো হইয়া জালসা শুনছিলেন?

আলেম মিস্ত্রি ততোধিক নিস্পৃহ হয়ে বললেন, ”হা। কেনে?”

শাকির বলল,” না কিচ্ছু না। এমনিই। আপনাকে দেখা মনে হইছিল আপনি ফেরেশতা!”

এবার আলেম মিস্ত্রি হেসে ফেললেন। বললেন, “ধুর পাগলা।” বলেই তিনি চলে গেলেন বাড়ির দিকে।

তিনিও চলে গেলেন আমাদেরও ছেড়ে। ক’দিন ধরেই বার্ধক্যজনিত কারণে শয্যাগত ছিলেন। আমরা অনেক বড় হয়েছি এখন। যে যার মত কাজকর্ম নিয়ে থাকি। কেউ গ্রামে থাকি, কেউ ভিন গ্রামে। কেউ ভিন জেলায়, ভিন রাজ্যে। তাঁর মৃত্যুর খবর পেয়ে ছুটে এসেছি গ্রামে। তাঁকে কবরস্থ করে এসে ছেলেবেলার অনেক কথাই মনে পড়ছে। এভাবে ক’দিন কেটে গেল তাঁরই আলোচনায়। ছেলে-মেয়েদের তাঁর কথা শোনাই আর আফশোষ করে বলি, এমন মানুষ আর কেই বা থাকল গ্রামে যাকে দেখে ছোট-বড় সকলে পথ ছেড়ে দেবে, ভয় করবে, ভক্তি করবে, শ্রদ্ধায় মাথা নত করবে!

এই ক’দিনও আমাদের আড্ডা বসেছে সেই বটগাছ তলায়। তাতে পুরোনো দিনের অনেক কথাই আলোচনা হয়েছে। নদীতে জল ঢুকছে বর্ষার। শত বর্ষ পুরোনো গাছটা তলিয়ে যাওয়ার আগে তার শিকড় দিয়ে মাটি ধরে রেখে আপ্রাণ চেষ্টা করছিল দাঁড়িয়ে থাকার। খবর পেয়ে আমরা এসেছি সকলেই। গ্রামের বহু লোক ভিড় করেছে আশেপাশে। আমরা তাকিয়ে আছি গাছটার দিকে। একটা আওয়াজ হল বেশ। আমরা খানিক পেছনে সরে এলাম। আমাদের চোখের সামনে গাছটা আছড়ে পড়ল নদীর গর্ভে। আমরা বাকহারা হয়ে সেদিকে অনিমেষ চেয়ে রইলাম।

Tags: Banian Tree StoryBangla Short Story
ShareTweet

Related Posts

মুরগী

December 7, 2024
0

মুহাম্মদ জিকরাউল হক ফেসবুক পোস্টটা চোখে পড়তেই বদিউজ্জামান রূপম কমেন্ট করল, "মুরগি কই?" মোনালিসা আহমেদ এই পোস্ট দিয়েছে। একটি ঝা...

Recommended

কেরেলায় ইঞ্জিয়ারিং ছাত্রকে কুপিয়ে খুন

2 months ago

বক্তা

5 months ago
Facebook Twitter Youtube
TDN Bangla

TDN Bangla is an Online bengali news portal, provides voice for poeple by sharing most authentic news in bengali.You can find out news like international, national, state, entertainment, literature etc at TDN Bangla.

Category

  • Uncategorized
  • আন্তর্জাতিক
  • খবর
  • খেলা
  • দেশ
  • ধর্ম ও দর্শন
  • প্রবন্ধ
  • বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
  • বিনোদন
  • রাজ্য
  • শিক্ষা ও স্বাস্থ্য
  • সম্পাদকীয়
  • সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • About Us
  • Privacy Policy
  • Contact Us

© 2024 TDN Bangla | developed with ♥ by GS Kitchen.

Welcome Back!

Login to your account below

Forgotten Password?

Retrieve your password

Please enter your username or email address to reset your password.

Log In
No Result
View All Result
  • হোম
  • রাজ্য
  • দেশ
  • আন্তর্জাতিক
  • খেলা
  • বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
  • শিক্ষা ও স্বাস্থ্য
  • সম্পাদকীয়

© 2024 TDN Bangla | developed with ♥ by GS Kitchen.