আবু রায়হান
‘শব্দরা ঘিরে আছে আমাকে।/শব্দ, শব্দ, শব্দ।/তারা আমার শরীরে পাতার মতো বৃদ্ধি পাচ্ছে,/কখনও স্তব্ধ হচ্ছে না তাদের ধীর বিন্যাস।/কিন্তু আমি জানি শব্দরা কি ভয়ঙ্কর।/আমাকে বিরক্ত করে,/অবশ করে,/বিস্ফোরণ ঘটায়,/বাতাসে ধরিয়ে দেয় স্বেচ্ছাচারী আগুন।/তবুও তারা পল্লবিত হয়,/যেমন পল্লবিত হয় বৃক্ষের শরীরে।/কখনো বন্ধ হয় না তাদের আগমন,/কোন নীরবতা থেকে তারা আসে?’ উত্তর-ঔপনিবেশিক যুগের সবচেয়ে সুপরিচিত নারীবাদী কবি কমলা দাস।কমলা দাসের কবিতা মূলত নারীবাদী কবিতা।তাঁর প্রতি প্রেম করার জন্য তাঁর স্বামীর দৃষ্টিভঙ্গি তাঁর মেয়েলি সংবেদনশীলতাকে ক্ষুব্ধ করেছিল।‘এই প্রেম আমার থেকেও বয়স্ক।/এমন কি এই জটিল শতাব্দীর থেকেও।/এই প্রেম জন্ম নিয়েছে আমার বয়ঃসন্ধিকালে।/ আমার আকাঙ্ক্ষা তাকে পুরুষ ভেবেছে,/ভেবেছে সুন্দরও।/যখন পেলাম তার স্পর্শ,/আমি অন্ধ হয়ে গেলাম।/তার ওষ্ঠ কি আমাকে প্রতারিত করলো?’(সম্পর্ক)
কমলা দাস তাঁর স্বামীকে একজন আত্মকেন্দ্রিক, কাপুরুষ হিসেবে চিহ্নিত করছেন, যে তাকে পর্যাপ্ত ভালোবাসেনি।‘সূর্যাস্তের সময়, নদীতীরে, কৃষ্ণ শেষবারের মতো মিলিত হলেন/এবং চলে গেলেন…/ওই রাতে পতির আলিঙ্গনের ভেতর,/রাধা এতটাই নির্জীব ছিলেন যে/কৃষ্ণ তাকে জিগ্যেস করলেন, ঘটনা কী,/আমার চুম্বনে কি মনখারাপ হয় তোমার, প্রিয়?/রাধা উত্তর করলেন,/না, একদম না,/আমি আসলে ভাবছিলাম একটা মৃতদেহের কেমন লাগে/যখন তাকে শুঁয়াপোকা কামড়ায়?’(শুঁয়াপোকা)
সাধারণ মহিলা থিম এবং এমনকি তিনি যে চিত্র এবং প্রতীক ব্যবহার করেন তার কারণে তাঁর কবিতাগুলি স্বতন্ত্রভাবে মেয়েলি।তাঁর কবিতার বিষয়বস্তু এবং সুর দুটোই মেয়েলি। প্রকৃতপক্ষে, তাঁর কবিতায়, তিনি নিপুণভাবে নারীসুলভ প্রতিবাদকে স্নেহময় নারী অনুভূতির সাথে একত্রিত করেছেন।‘তোমাকে ভালোবাসবে এমন একটা লোক পাওয়া খুব সহজ/কেবল সৎ থাকো একজন নারী হিসেবে তোমার চাওয়ার ব্যাপারে,/তাকে সঙ্গে নিয়ে নগ্ন দাঁড়াও আয়নার সামনে/যাতে সে নিজেকে দেখতে পায় অপেক্ষাকৃত শক্তিমান হিসেবে/এবং তা বিশ্বাস করতে পারে,/আর তোমাকে যেন দেখায় অনেক বেশি কোমল, তরুণতর, রমণীয়…/প্রশংসার ব্যাপারটা মাথায় রাখো।/তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের নিখুঁতত্বের কথাটা উল্লেখ করো,/শাওয়ারের নিচে তার চোখজোড়া যে লাল হয়ে যাচ্ছে,/বাথরুমের মেঝেতে তার লাজুক হাঁটা,/তোয়ালে পড়ে যাওয়া, আর ঝাঁকানো ভঙ্গিতে তার প্রস্রাব করা।/খুঁটিনাটি সব ভালোলাগার অনুষঙ্গ/যা তাকে বানিয়ে তোলে পুরুষ আর তোমার একমাত্র মানুষ।/উপহার দাও সবকিছু, দাও তাকে যা তোমাকে নারী বানায়,/ দীর্ঘ চুলের ঘ্রাণ, স্তনের মাঝে থাকা ঘামের মুখোশ,/রজঃস্রাবের উষ্ণ আঘাত, আর তোমার অন্তহীন নারীর সব ক্ষুধাগুলো।/ আর হ্যাঁ, ভালোবাসার জন্য একটা লোক পাওয়া খুব সোজা,/ তবে পরে মুখোমুখি হওয়া লাগতে তাকে ছেড়ে থাকার ব্যাপারটির।/যখন তুমি ঘুরে বেড়াচ্ছো, যাপন করছো এক জীবনহীন বাঁচা,/ অপরিচিত মানুষের সঙ্গে দেখা হচ্ছে,/চোখগুলো তোমার ছেড়ে দিয়েছে অন্বেষণ,/তোমার কান যা কেবল শোনে তোমার নাম ধরে তার শেষবারের ডাক/আর তোমার শরীর তার স্পর্শে যা ছিল দীপ্তিমান/ঘষামাজা পিত্তলের মতো,এখন যা নোংরা এবং পরিত্যক্ত।’ (দেখার আয়না)
তিনি নিজের আত্মজীবনী ‘মাই স্টোরি’তে তিনি অকপটে মেলে ধরলেন নিজেকে। বোঝালেন, নিজেকে উন্মোচিত করার ক্ষেত্রে এভাবেই হতে হয় সৎ ও সাহসী, হতে হয় সত্যনিষ্ঠ; আর সেই আত্মকথন মালাবার থেকে মন্ট্রিল তাবৎ রক্ষণশীল সমাজের ঝুঁটি ধরে টান মারলো।তিনি এই শতাব্দীর অন্যতম সাহিত্যব্যক্তিত্ব কমলা দাস, তিনি মাধবীকুট্টি, সুরাইয়া-তিনি কমলা সুরাইয়া।ভারতের অগ্রগণ্য কবি কমলা দাসের জন্ম ১৯৩৪-এর ৩১ মার্চ, কেরালার ত্রিশুর জেলার পুন্যায়ুরকুলামে।শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ২০০৯-র ৩১ মে।
কমলা দাস পরবর্তীতে পরিচিত হন ভারতীয় আধুনিক ইংরেজি কবিতার অন্যতম প্রধান কবি-‘দ্য মাদার অফ মডার্ন ইংলিশ ইন্ডিয়ান পোয়েট্রি’ হিসেবে।কেরালার যে দু-একটি পরিবারের সাহিত্যজগতে অসামান্য অবদান, তার মধ্যে অন্যতম নায়ার পরিবার। এই পরিবারের সন্তান কমলার পিতা ভি. এম. নায়ার ছিলেন বিখ্যাত মালায়লম দৈনিক ‘মাতৃভূমি’র ম্যানেজিং এডিটর। মা নালাপ্পাত বালামণি আম্মা মালায়লম ভাষার প্রথিতযশা কবি। ‘নিবেদ্যম’, ‘সোপানম্’, ‘লোকান্তরঙ্গলিল’ প্রভৃতি গ্রন্থের প্রণেতা বালামণি আম্মাকে বলা হত মালায়লম সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি। কেউ কেউ তাকে বলতেন- ‘মাদার অফ মালায়লম পোয়েট্রি’।
সাহিত্যে অসামান্য অবদানের জন্য ভারতীয় সাহিত্যের সর্বোচ্চ পুরস্কার ‘সরস্বতী সম্মান’-এ ভূষিত বালামণি আম্মার কন্যা কমলা যে কালে-কালে লেখক হবেন, তা খানিকটা প্রত্যাশিতই ছিল। বাবা সংবাদপত্রের সম্পাদক এবং মা বিখ্যাত লেখক হওয়ার সুবাদে তাঁদের বাড়িতে রাজনীতি ও সাহিত্যের রথী-মহারথীদের আনাগোনা লেগেই থাকত। কমলার বহির্মুখী হয়ে উঠার ক্ষেত্রে এসবই পরোক্ষে প্রেরণা যুগিয়েছিল। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, কমলার দাদু, বালামণি আম্মার কাকা নালাপ্পাত নারায়ণ মেননও একজন উল্লেখযোগ্য লেখক ছিলেন।
পিতার কর্মসূত্রে খুব ছোটোবেলায় কমলাকে চলে আসতে হয় কলকাতায়। কলকাতায় থাকাকালীন মাত্র ছয় বছর বয়সে মুণ্ডুহীন ভাঙা পুতুল নিয়ে কবিতা লেখেন।মাত্র পনেরো বছর বয়সে খানিকটা অপ্রত্যাশিতভাবে স্কুলের পাঠ চলাকালীনই তিনি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন।গভীর রাতে যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়ত,রান্নাঘরের সব্জি কাটার টেবিলটা পরিষ্কার করে সেখানে লিখতে বসতেন কমলা।এই সময়টাই ছিল তাঁর একান্ত নিজস্ব সময়।ইংরেজি এবং মাতৃভাষা মালায়লম-দুই ভাষাতেই অনর্গল লিখে যেতে থাকলেন কমলা। ইংরেজি ভাষার পাঠক তাঁকে প্রথমে চিনলেন কবি হিসেবে। কে. দাস বা কমলা দাস নামে প্রকাশিত তাঁর কবিতা পাঠকের কাছে অসম্ভব জনপ্রিয় হয়ে উঠল। কবিতায় পাঠককে তিনি চেনালেন গ্রামীণ অন্তজ মানুষের যাপনপ্রণালী, শোনালেন অন্তঃপুরচারী নারীদের গোপন ব্যথা। তাদের মনের গহনে চেপে রাখা ইচ্ছা, রক্ষণশীল সমাজের তীব্র প্রতিক্রিয়া এবং অপবাদের ভয়ে নিজ হাতে মেরে ফেলা নারীর তাবৎ লিপ্সা মূর্ত হয়ে উঠল তার কলমের ডগায়। এ এক অন্য কমলা। নিজের অভিজ্ঞতাকে পাঠকের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার পাশাপাশি তিনি ঢুকে পড়ছেন মানুষের অন্দরমহলে। অনায়াসে লিখে ফেলছেন গোপন যত কথা, অকপটে।
‘অনুরাগ-অন্ধ স্বামী,/আমার মনের ভেতর প্রাচীন দখলদার,/বুড়ো নাদুস-নুদুস মাকড়সা,/বুনে চলেছ বিভ্রান্তির জাল,/দয়ার্দ্র হও।/আমাকে রূপান্তরিত করো তুমি পাথরের পাখিতে,/গ্রানাইটের এক ঘুঘু,/ শ্রীহীন করে তোলো আমার চারপাশ,/…আমার স্বপ্ন দেখতে থাকা চোখে ঢুকিয়ে দাও আঙুল।/আর হ্যাঁ,দিবাস্বপ্নের ভেতর,/শক্তিমান পুরুষেরা ছায়া ফেলে তাদের,/শাদা সূর্যের মতো মিশে যায় আমার দ্রাবিড় রক্তের ভেতর,/ স্রোতগুলোকে গোপনে বইয়ে দেয় পবিত্র শহরগুলোর নিচ দিয়ে।/তুমি যখন ছেড়ে যাও,/…অন্যের ঘরের দরজায় করাঘাত করতে আমি এলোমেলো চল্লিশ কদম দৌড়াই।/পড়শীরা দেখে,যদিও দরজার ছিদ্রপথ দিয়ে,/…আমাকে জিগ্যেস করো, সকলে,/জিগ্যেস করো কী দেখতে পায় সে আমার ভেতর,/ জিগ্যেস করো কেন তাকে ডাকা হয় সিংহ,/মুক্তমনা,আমাকে জিগ্যেস করো কেন তার হাত ফণা তোলা সাপের মতো দোলে/আমার জংঘা আঁকড়ে ধরার আগে।/ জিগ্যেস করো কেন একটা পতিত,/ বিশাল গাছের মতো, সে ধপাস করে পড়ে আমার স্তনের ওপর,/আর ঘুমায়।জিগ্যেস করো আমাকে,/জীবন কেন এতো ছোট,/আর ভালোবাসা স্বল্পায়ুতারও চেয়ে,/ জিগ্যেস করো পরমানন্দ কী জিনিস/আর কী মূল্য দিতে হয় তার জন্য..।’(পাথর যুগ)
কমলা দাসের ‘সামার ইন ক্যালকাটা’ তার একটি বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ। প্রেম এবং প্রবঞ্চনা, আর তাই নিয়ে নারীর উদ্বেগ-এ সবই এই কাব্যগ্রন্থের মূল উপজীব্য। আর এমন অকপট লেখার জন্যই রক্ষণশীল সমাজ তার কবিতায় যৌনতার গন্ধ পেল। পুরুষের লেখায় নারীঙ্গের বর্ণনা বা নারীর কামনা সরাসরি ফুটে উঠলেও যে সমাজ চুপ করে না দেখার ভান করে থাকে, তারা এক নারীর লেখায় নারীর আকাঙক্ষাকে ফুটে উঠতে দেখে গেল, গেল রব তুলল। কমলা ভ্রূক্ষেপও করলেন না।‘এপ্রিলের আগুন সূর্য কমলালেবুর মতো/আমার পানীয়ের গ্লাসে।/আমি আগুন পান করছি।/আগুন/আগুন পান করছি।/কি সুমধুর বিষ আমার শিরায় শিরায় সঞ্চারিত হচ্ছে,/আমার মন ভরে উঠছে আনন্দে।/আমার দুশ্চিন্তারা ঘুমিয়ে পড়ছে।/তুষের আগুনের মতো কলকাতা বুদবুদ হয়ে জ্বলছে আমার গ্লাসে।/হাসছে মৃদু সদ্য পরিণীতা লাজুক বধূর মতো।/স্পর্শ করছে আমার ওষ্ঠ।/আমাকে ভুলে যাও প্রিয়।/আমার চোখে নেমে আসছে ঘুম।/এপ্রিলের গলিত সূর্য আমার পানীয়ের মধ্যে।/আমাকে পান করতে দাও,/আমাকে পান করতে দাও।’
ইংরেজি ও মালায়লম সাহিত্যে উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্য কমলা অসংখ্য সাহিত্য সম্মান ও পুরস্কারে ভূষিত। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল এশিয়ান পোয়েট্রি প্রাইজ, কেন্ট অ্যাওয়ার্ড ফর ইংলিশ রাইটিং ফ্রম এশিয়ান কান্ড্রিজ, এশিয়ান ওয়ার্ল্ড প্রাইজ, এজুথাচান অ্যাওয়ার্ড, সাহিত্য আকাদেমি, ভায়ালার অ্যাওয়ার্ড, কেরালা সাহিত্য আকাদেমি এবং মুত্থাতু ভারকে অ্যাওয়ার্ড। তিনি কিছুদিনের জন্য পোয়েট ম্যাগাজিনের সম্পাদক এবং ইলাস্ট্রেটেড উইকলি অফ ইন্ডিয়ার কবিতা বিভাগের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকও হয়েছিলেন।আমন্ত্রিত কবি হিসেবে কমলা পৃথিবীর নানা দেশে ঘুরেছেন, বক্তৃতা দিয়েছেন বিশ্বের নানা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এর ফলে তার খ্যাতি দেশ ছাড়িয়ে প্রসারিত হয়েছে পৃথিবীর নানা প্রান্তে। আর তাই অধিকাংশ ভারতীয় ভাষায় তার গ্রন্থ অনূদিত হওয়ার পাশাপাশি ফ্রেঞ্চ, জার্মান, রাশিয়ান, জাপানিজ, স্প্যানিশ–সহ পৃথিবীর প্রায় পনোরোটি ভাষায় তা প্রকাশিত হয়েছে।
তাঁর লেখা গল্প ও কবিতায় যেভাবে বারবার অভিঘাত সৃষ্টি করেছেন,ঠিক সেভাবেই জীবনের শেষ অভিঘাতটি তিনি রচনা করেন ৬৭ বছর বয়সে তাঁর আজন্মলালিত হিন্দুধর্ম ত্যাগ করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে।কমলার সঙ্গে যুক্ত হয় ‘সুরাইয়া’-হলেন কমলা সুরাইয়া।কিন্তু কেন এই ধর্ম পরিবর্তন?কারণ হল-‘ইসলাম ধর্মে নারীর সুরক্ষা’।‘কিন্তু ইসলাম ধর্ম কী আপনার বিতর্কিত অতীতকে মেনে নেবে?’ কমলা সুরাইয়া বললেন, ‘ধর্ম কখনই কারো সৃষ্টিকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করতে পারে না। আর আল্লাহ তো পরম করুণাময়। আমার মন বলছে, আল্লাহ আমার সব পাপ মাফ করে দেবেন’।‘তোমাকে পাওয়ার আগ মুহূর্তেও,/আমি কবিতাই লিখতাম, চিত্র আঁকতাম,/আর বন্ধুদের সাথে সময় কাটাতাম হৈহুল্লোড়ে।/অথচ তোমাকে ভালোবাসি এখন/কুঞ্চিত খচ্চরের মতো,/যার জীবন, পারিতোষিক আধেয়, সবই তোমার মাঝে…’।(ভালোবাসা)