ডাঃ আনোয়ার সাদাত হালদার—একজন নিভৃতচারী সংগ্রামী, যিনি শুধু চিকিৎসক নন, বরং মিডিয়ার একজন চিন্তাশীল ব্যাক্তি। আজ থেকে প্রায় বারো বছর আগে, কলকাতার পিজি হাসপাতালের ছাত্রদের ক্যান্টিনে প্রথম দেখা হয়েছিল তাঁর সঙ্গে। ফর্সা, স্লিম গড়ন, শান্ত অথচ তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। বাংলার মুসলিম সমাজের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বঞ্চনা নিয়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বাক্যে অসাধারণ কথামালা গেঁথে যাচ্ছিলেন। প্রথম দর্শনেই মনে হয়েছিল—এই মানুষটি স্বপ্ন দেখেন, শুধু নিজের জন্য নয়, গোটা জাতির জন্য।
কিছু মানুষ আছেন, যাঁরা নিজেদের স্বার্থের চেয়ে বড় কোনও লক্ষ্যকে জীবনের ব্রত করে নেন। ডাঃ শেখ বাসীর আলি তাঁদেরই একজন। তাঁর সম্পর্কে বিস্তারিত বলার সুযোগ এখানে নেই, তবে এটুকু নিশ্চিত করে বলা যায়—তিনি একজন নির্লোভ, সৃজনশীল মানুষ।
একদিন চেম্বার বন্ধ রাখলে অনেক ক্ষতি। তবুও তিনি টিডিএন বাংলার সাংবাদিক তৈরির কর্মশালায় যেতেন, নতুন প্রজন্মকে উৎসাহ দিতেন, শেখাতেন—”সংবাদ শুধু খবর নয়, সমাজ বদলের হাতিয়ার!”
তিনি বুঝেছিলেন, মিডিয়া ছাড়া অধিকার প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়।
বাবা সাহেব আম্বেদকর বলেছিলেন, “মুখপত্রহীন সংগঠন এক টুকরো ক্লাবের মতো।” তাই বাসীর ভাইও পরামর্শ দিলেন—দলিত, আদিবাসীদের মিডিয়ায় আনতে হবে।
এই লক্ষ্যে কাজ শুরু হলো।
কিছু দলিত, মতুয়া ও আদিবাসী নেতাদের সঙ্গে আলোচনা হলো। তাঁরা এগিয়ে এলেন। টিডিএন বাংলার ইফতার অনুষ্ঠানে আলোচনা হলো—বহুজন সমাজকে মিডিয়ায় নিজেদের অবস্থান শক্ত করতে হবে।
আমি কাছ থেকে দেখেছি—বাসীর ভাই শুধু পরামর্শ দেননি, নিজেও কাজ করেছেন।
ইফতার অনুষ্ঠানগুলোতে যখন আমরা সংবাদ সংগ্রহে ব্যস্ত, তখন তিনি নিজে হাতে ইফতারি সামগ্রী পৌঁছে দিতেন। অহংকারহীন, মাটির মানুষ! ইফতার শেষে উচ্ছিষ্ট খাবারগুলো নিজ হাতে গুছিয়ে ফেলতেন।
কখনও হতাশ গলায় বলতেন—
“আমাদের মতো সাধারণ, গরিব ঘরের ছেলেরা যদি মিডিয়া নিয়ে ভাবতে পারে, তাহলে বড় বড় মুসলিম ও দলিত নেতারা কী করছেন? দৈনিক পেপার বা টিভি চ্যানেল না করতে পারলেও তারা কি অন্তত ২৪ ঘণ্টা চলতে পারে এমন একটি উন্নতমানের নিউজ পোর্টাল গড়ে তুলতে পারেন না? নাকি ভাষণ দিতেই সব কাজ শেষ, বলার সঙ্গে সঙ্গে কাজ করতে হবে তো!”
একটা সময় ছিল, যখন সংবাদ বলতে বোঝানো হতো ছাপার অক্ষরে ছোঁয়া সংবাদপত্র, আকাশবাণীতে শোনা খবর বা টেলিভিশনের পর্দায় ভেসে ওঠা বুলেটিন।
মোবাইলের পর্দায় খবর? সেটা কি সম্ভব?
অনেকেই বিশ্বাস করেনি। সংবাদপত্রের জগতে মোবাইল জার্নালিজমের প্রবেশ এক রকম কল্পনাতীত ছিল। আমার সমাজ রেডিও সেন্টার করেনি, টেলিভিশনও করেনি, কলম পত্রিকার আগে ‘ দৈনিক’ ছিল না, মিডিয়া নিয়ে বহু আলোচনা হয়েছে, ওয়ার্কশপ হয়েছে, তবু নতুন কিছু দৈনিক, নিউজ এজেন্সি জন্ম নেয়নি।
কিন্তু আমি বিশ্বাস করতাম, অসম্ভব বলে কিছু নেই। টিডিএন বাংলার হয়ে একটা সস্তা দামের মোবাইল হাতে তুলে নিলাম, ছবি তুলতে শুরু করলাম, নিউজ লিখে পোস্ট করতে থাকলাম। একের পর এক ঘটনার চিত্র ধরা পড়তে লাগল—আফরাজুল থেকে আখলাক, নাজিব থেকে রোহিত ভেমুলা। আর তাতেই এক নতুন বিপ্লবের সূচনা হলো।
টিডিএন বাংলা অনলাইন মিডিয়ায় ঝড় তুলল। ক্যামেরা নেই, নামি দামী সাংবাদিক নেই, নবীন প্রজন্মকে সঙ্গে নিয়ে একটার পর একটা মিডিয়া ওয়ার্কশপ করলাম। পাশে পেলাম বজবজের ডা. শেখ বাসীর ভাইয়ের মতো প্রগতিশীল চিন্তাবিদদের।
তরুণ সমাজ এগিয়ে এলো।
টিডিএন বাংলার কর্মশালায় হাতে খড়ি নিয়ে গড়ে উঠল একটার পর একটা অনলাইন মিডিয়া। কেউ কেউ এই লাইনে টিকে থাকতে পারেননি, আবার কেউ কেউ হাউজ বদলেছে, কিন্তু কেউই পিছিয়ে যায়নি। তারা চান, সমাজে মিডিয়া বিপ্লব আসুক। তারা চান, বাঙালি মুসলিম ও দলিত আদিবাসীদের কথা জানুক গোটা বিশ্ব।
সংকট ছিল, হতাশা ছিল, বাধা এসেছিল, তবুও চলতে হয়েছে।
আজ আমি দ্বিধাহীন কণ্ঠে বলতে পারি—মোবাইলে খবরের ধারণা আজ বাস্তব! মানুষের হাতে হাতে মোবাইল, খবর হাতের মুঠোয়। পত্রিকার পাতা উল্টে পড়ার আগ্রহ কমেছে, কারণ ডিজিটাল যুগ তার চেয়েও দ্রুত।
শত শত ইউটিউব চ্যানেল, ফেসবুক পেজ এখন সংবাদ প্রচার করছে। বড় নিউজ পোর্টাল হয়তো এখনো কম, কিন্তু কাজ চলছে, এগিয়ে যাওয়ার সংগ্রাম চলছে। দাবিয়ে রাখার দিন শেষ!
এই অসাধ্য সাধনে তরুণ সমাজের ভূমিকা অপরিসীম। মুসলিম সমাজে মিডিয়ার প্রভাব বিস্তারে শেখ বসির ও আনোয়ার সাদাতদের মতো ডাক্তারদের অবদান জাতি চিরকাল স্মরণ রাখবে। তাঁরা সাংবাদিক নন, এই বিষয়ে ডিগ্রিও নেই। কিন্তু তাঁরা আমাদের ভালোবাসা দিয়েছেন, উৎসাহ দিয়েছেন, স্বপ্ন দেখিয়েছেন। ‘আপনারা কাজ করুন, আমরা রোগী দেখার পাশাপাশি সময় পেলেই লিখবো, পরামর্শ দেবো, মিডিয়া নিয়ে আলোচনা করবো, বিপদে আপদে পাশে থাকবো’, এই কথা বলার মতো ডাক্তার ঘরে ঘরে তৈরি হোক।
বজবজের এক সাধারন গরীব ঘরের ছেলেকে দিয়ে আল্লাহ্ হয়তো মিডিয়ার খিদমত করার সুযোগ করে দিয়েছেন। ফলে আটার মিলের ক্লাস নাইনের শ্রমিকটি এখন টিডিএন বাংলার দৌলতে আলিয়া থেকে সাংবাদিকতায় এম এ করে পিএইচডি করার স্বপ্ন দেখছেন। কোন এক এলাকার ‘ দুষ্কৃতী’ বলে পরিচিত বাবার ছেলে মিডিয়ায় বিএ পড়ছেন। মা হারা গোসাবার ছেলেটি এখন ‘পাশ করা সাংবাদিক’। আলিয়ার সেই টুপি দাড়িওয়ালা ইসলামিক থিউলজির ছেলেটি এখন নিজেই মিডিয়া খুলেছেন। মুর্শিদাবাদের গঙ্গাভাঙনের পাড়ে বাঁচার স্বপ্ন দেখে টিডিএন বাংলায় আসা ছেলেটি এখন নিজেই জঙ্গিপুর অনলাইন খুলেছেন আর লিখছেন ইংরেজি টেলিগ্রাফে। মসজিদের সেই ইমামের হাতে এখন মোবাইল স্ট্যান্ড আর ব্যুম। এইভাবে জেলায় জেলায় বহু ছেলেমেয়ে এখন মিডিয়া সম্পর্কে সচেতন। টিডিএন বাংলার এই কাজটি আমার একার পক্ষে করা সম্ভব ছিল না, যুবকরাই আমার পাশে ছিলেন। বয়স্করা উৎসাহ দিয়েছেন। ভালোবাসা দিয়েছেন। তবে কেউ কেউ আঘাতও দিয়েছেন। কিন্তু আমি জানতাম—কাজ করলে আঘাত আসবেই, আর আঘাত এলে বিপ্লব আসবে! স্বপ্ন ছিল একশো সাংবাদিক তৈরি করবো, পঞ্চাশটি অনলাইন মিডিয়া করতে সাহায্য করবো। আলহামদুলিল্লাহ, আমার অজান্তে, অনেক বেশি হয়েছে। আমার এক্ষেত্রে তেমন কোনো ভূমিকা নেই, যেভাবে আল আমীনকে দেখে তরুণদের মিশন গড়ার হিড়িক পড়েছিল, ডাক্তার হওয়ার জোয়ার উঠেছিল, তেমনি টিডিএন বাংলার হাত ধরে মুসলিম সমাজে অনলাইন মিডিয়ার জোয়ার এসেছে।
এটা আল্লাহর ইচ্ছা। খুব কঠিন পরিস্থিতির মধ্যেও তরুণরা লড়ছে। কখনো তারা ভাঙছে, আবার গড়ছে, কিন্তু পিছিয়ে আসছে না। মরা গাঙে এটাই জাতির জন্য ভালো খবর।
আমার মতে, এই মুহূর্তে নবীন প্রজন্মের ডাক্তারদের মধ্যে মিডিয়ার প্রতি সবচেয়ে সচেতন মানুষটি নিঃসন্দেহে আনোয়ার ভাই। তিনি বারবার চেষ্টা করেছেন ছোট হলেও একটি মিডিয়া গড়ে তুলতে—যেখানে লেখা থাকবে জাতির ইতিহাস, ঐতিহ্য, সুখ-দুঃখের কথা। একদিন তিনি আমায় বলেছিলেন, “মোকতার ভাই, এমন একজন ছেলে দিন, যে খবরের বিশ্লেষণ করতে পারবে, যে ছোট ছোট ডকুমেন্টারি তৈরি করবে।” তাঁর দৃষ্টিতে ছিল গভীর এক প্রত্যাশা। তিনি প্রশ্ন তোলেন—
কলকাতায় বাঙালি মুসলিম এত কমে গেল কেন?
বেলেঘাটার মুসলিমরা কোথায় হারিয়ে গেল?
সল্টলেক, বিধাননগরের মতো বিশাল এলাকায় হাতেগোনা কয়েকটি মসজিদই বা কেন?
এইসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে তিনি মুসলিম সমাজের বঞ্চনা নিয়ে গভীরভাবে ভাবেন, তবে শুধু অভিযোগ তোলার জন্য নয়। বরং তিনি সম্প্রীতির পথ খোঁজেন, ঐক্যের সেতু গড়ার চেষ্টা করেন। সেই লক্ষ্যেই গড়ে তুলেছিলেন ‘ইনকিলাব’ অনলাইন, পরবর্তীতে ‘দৃষ্টি’।
আমাদের সমাজে ডাক্তার, শিক্ষক, প্রকৌশলী, রাজনৈতিক নেতা, ব্যবসায়ীর অভাব নেই। মুসলিম সংগঠনও অগণিত। কিন্তু মিডিয়ার গুরুত্ব নিয়ে কয়জন ভাবে? আনোয়ার ভাই বছরের পর বছর সেই বার্তাই দিয়ে যাচ্ছেন—নিজ নিজ অবস্থান থেকে ছোট হলেও মিডিয়া তৈরি করুন, সত্য তুলে ধরুন, ইতিহাস লিখুন।
কিন্তু এই মানুষটি শুধু সমাজ নিয়ে ভাবেন না, তিনি মানুষের হৃদয়েও জায়গা করে নিয়েছেন। আমার বাড়ির টেলিমেডিসিন ডাক্তার তিনি—যখনই অসুস্থ হই, ফোন করলেই সাড়া দেন, মুহূর্তের মধ্যে ওষুধ লিখে পাঠিয়ে দেন। শুধু আমিই নই, অগণিত মানুষ তাঁর স্নেহের পরশে সুরক্ষিত, তাঁর যত্নের ছায়ায় প্রশান্তি খুঁজে পায়।
শুধু চিকিৎসক হিসেবেই নয়, একজন লেখক হিসেবেও তিনি অনন্য। তাঁর লেখায় সমাজের বাস্তব চিত্র ধরা পড়ে, ইতিহাসের অলিখিত অধ্যায় উন্মোচিত হয়, বঞ্চিতদের কথা উঠে আসে সাহসের সঙ্গে। এমন মানুষদের মূল্যায়ন জরুরি—যারা নিঃস্বার্থভাবে কাজ করেন, মানুষকে ভালোবাসেন, সমাজকে আলোকিত করেন।
ডাঃ শেখ বাসীর আলি ও ডাঃ আনোয়ার সাদাত হালদাদের মতো মানুষদের হাত ধরেই সমাজ এগিয়ে যায়, মানবতার আলো প্রসারিত হয়। আনোয়ার প্রচারবিমুখ, নীরবে কাজ করেন। ফেসবুকে তেমন সক্রিয় নন। বেশ কিছু অধ্যাপকদের সঙ্গে নিয়ে সাইফুল্লাহ ভাইয়ের সহযোগিতায় পিডিএফ আকারে ‘দৃষ্টি’ প্রকাশ করছেন। সব লেখা বলিষ্ঠ। আনোয়ার ও বাসীর ভাইয়ের জন্য হৃদয়ের গভীর থেকে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা রইল। আপনাদের নিরবচ্ছিন্ন সেবা ও মানসিক শক্তি আমাদের ‘ আধমরা’ সমাজের পথচলায় দিকনির্দেশনা হয়ে থাকুক।