সৌরভ

মুহাম্মদ জিকরাউল হক

জুমআর দিন। এগারোটা বাজে। সাইফ বাস থেকে নেমে একটা টোটোয় উঠে বসল। তারা চারজন উঠে বসে আছে। অথচ ছাড়ার নাম নেই। বলতেই টোটো ওয়ালা বলল, “সাতজন না হলে ছাড়ব না।”

এ কোন দেশি কথা! দু’কিমি পথ। দশ টাকা ভাড়া। চারজনে যাবে না! সাতজন হতেই হবে?

সাতজন হতে এখনও একজন বাকি। সময় বয়ে যেতে লাগল। অন্যদিন হলে সাইফ এতটা অস্থির হত না। আজ শুক্রবার। গিয়ে তাকে জুমআ নামাজের জন্য মসজিদে যেতে হবে।

সাইফ ব্যাঙ্গালোর থেকে ফিরছে। ফিরছে সাড়ে পাঁচ বছর পর। দেখল, দু’পাশে রাস্তার ধারে বড় বড় বাড়ি উঠেছে। বাড়ির সামনে দোকান ঘর। তাদের কতক খোলা, কতক বন্ধ। বন্ধ করে নামাজে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে হয়ত। রাস্তাঘাট উন্নত হয়েছে। মূল রাস্তা সহ আসে-পাশের গলিতেও ঢালাই করা রাস্তা।

কিন্তু একটা জিনিষের কোন পরিবর্তন হয়নি, সেটা হল রাস্তার আবর্জনা। ড্রেন প্রায় উপচে পড়ছে নোংরায়। ঠিক আগে যেমনটা ছিল তেমনই। মানসিকতার কোন পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেল না।

গ্রামে প্রবেশ করে সাইফ একটা দৃশ্য দেখে অবাক হল! কয়েকজন ছেলে-ছোকরা রাস্তা পরিষ্কারে হাত লাগিয়েছে। দ্রুত তারা ছুটোছুটি করছে। চিৎকার চেঁচামেচি করছে। সে টোটো থেকে নেমে তাদের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তার স্মৃতি তাকে নিয়ে গেল অতীতে।

যখন সে বাড়িতে থাকত, নিয়মিত ঝাড় দিত। সঙ্গে নিত পাড়ার ছেলেদের। সবাই মিলে হইচই করে লেগে পড়ত কাজে। একটা ভালো কাজ করার আনন্দে বিভোর হয়ে সকলে ছুটোছুটি করত। হাতে থাকত ঝাড়ু, ডালি। কেউ বা কোদাল নিয়ে নেমে পড়ত ড্রেনে। ব্লিচিং ছড়িয়ে দিত কেউ। কাজ করব না, এই মনোভাব নিয়ে যারা দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখত, তারাও একসময় কাজে হাত লাগাতো। কাজ হত ঝড়ের গতিতে।

তাকে দেখতে পেয়ে ছুটে এল মুজিব। আনন্দে আত্মহারা হয়ে বলে উঠল, “তুমি এসেছো কাকু! আমার শুধু তোমার কথাই মনে পড়ছিল।”

সাইফকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে মুজিবই বলতে লাগল,” ক’জন ছেলেকে বলে রাজি করিয়েছিলাম। তাদের সবাই আসেনি। অন্যের জন্য কাজ করতে এখন অনেকেরই অনীহা! যে ক’জন এসেছিল তাদের নিয়ে কাজ করতে সময় লাগল বেশি। দেরি হয়ে গেল। রাস্তায় দাঁড়িয়ে অনেকেই দেখল আমাদের কাজ করা কিন্তু কেহই এগিয়ে এল না!”

সাইফ একসময় যাদের নিয়ে পথে নামতো তাদের মধ্যে মুজিবই ছিল সর্ব কনিষ্ঠ। আজ সে-ই নেতৃত্ব দিচ্ছে অন্যদের। তার অন্তর বিগলিত হয়ে গেল। চক্ষু অশ্রুসজল হল। আনন্দাশ্রু লুকিয়ে সে কোনরকমে বলতে পারল, “আমি কি তোমাদের সঙ্গে একটু সাথ দেব?”

“না না কাকু। তুমি বাড়ি যাও। নামাজের জন্য তৈরি হও। আমাদেরও হয়ে এসেছে। আবর্জনাগুলো তুলে ফেলে দিয়ে আমরাও ছুটবো পুকুরের দিকে।” বলেই মুজিব তার দলবলের দিকে এগিয়ে গেল।

সাইফ দেখল, ধুলো-বালিতে মলিন হয়ে গেছে তাদের চেহারা। কাপড়-চোপড়ে ময়লা লেগে গেছে। চুলগুলো হয়েছে উস্ক-খুস্ক।

আজান শুরু হয়েছে মসজিদে। মুসল্লিরা মসজিদ পানে নামাজের জন্য যেতে শুরু করেছে। তাদের গা থেকে আসছে আতরের সুগন্ধ। ইস্ত্রী করা পাঞ্জাবি থেকে ছড়িয়ে পড়ছে সৌরভ। তবু, তাঁদের থেকে ধুলোয় মলিন হয়ে যাওয়া ছেলেদের সৌরভই, তার কাছে বেশি উজ্জ্বল মনে হল আজ।

Exit mobile version