ইসমাইল দরবেশ কোন কাজে কলকাতা আসলে কফি হাউসে আসে। আর কফি হাউসে এলে সেই টেবিলে এসে বসে যেখানে সে এখন বসে আছে। আগে থেকে কেউ বসে থাকলে ভিন্ন কথা। এটা সে করে আসছে গত একুশ বছর ধরে।
যখন সে কলকাতা ইউনিভার্সিটির ছাত্র ছিল, হোস্টেলের বন্ধুদের সঙ্গে প্রথম এসেছিল কফি হাউসে, তারা এই টেবিলেই বসেছিল । খুব ভালো করে মনে আছে, সেদিন তারা চারজন ছিল। সন্ধ্যার পর এসেছিল। তখন তারা সবে ভর্তি হয়েছে। কয়েকটা বই কেনার দরকার ছিল। বই কেনা হয়ে গেলে এখানে এসেছিল কফি খেতে।
কফি হাউস নাম শুনে ইসমাইলের মনে হয়েছিল শুধু কফিই পাওয়া যাবে। কিন্তু না। কিছুক্ষণের মধ্যে তার সে ধারণা পাল্টে গিয়েছিল। তারা কফি খাওয়ার আগে আরো কীসব খেয়েছিল সেদিন। তাদের কোন তাড়া ছিল না। কফি খেয়ে অনেক্ষণ গল্প করেছিল।
তাদের এসে বসার পর, ইসমাইল লক্ষ্য করলো একটি মেয়ে, তারই সমবয়সী, ইউনিভার্সিটির ছাত্রী হওয়ায় স্বাভাবিক, কোন হোস্টেলে থাকে হয়ত, কিংবা কাছাকাছি বাড়ি, ট্রেনে করে ফিরে যাবে, তার মুখোমুখি একটি টেবিলে একা বসে আছে। একনাগাড়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। মুখে লেপ্টে আছে এক চিলতে হাসি। টেবিলের উপর কনুই রেখে, এক হাতের আঙ্গুলের মধ্যে অন্য হাতের আঙ্গুল ঢুকিয়ে তার উপর থুতনি রেখে চেয়ে আছে।
ইসমাইলের ভালো লাগল। একটি মেয়ে তার দিকে চেয়ে বসে আছে ভাবতেই শিহরণ অনুভূত হল হৃদয়ের মণিকোঠায়। সে বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করছে, কি খাওয়া হবে তা নিয়ে আলোচনা করছে, অর্ডার দিচ্ছে, খাচ্ছে। এসবের ফাঁকে ফাঁকে নজর চলে যাচ্ছে সেই মেয়েটির দিকে। সে তখনও একা বসে আছে। এবং অবশ্যই তার দিকে চেয়ে।
সে কি কারো জন্য অপেক্ষা করছে? তাহলে তো ঘনঘন হাত ঘড়ি দেখার কথা! সে হাতঘড়ি দেখছে না। কিছু খাচ্ছে না। একমনে তার দিকে চেয়ে বসে আছে। ইসমাইলের সঙ্গে চোখাচোখি হলে রহস্যভরা হাসি দিচ্ছে।
কফি খাওয়া হল। বিল মেটানো হল। আগামী কালের পরিকল্পনা করা হল। এবার উঠার পালা। মেয়েটা কি কিছু টের পেল? সে উঠে দাঁড়ালো। তাদের সামনে দিয়ে নীরব পদক্ষেপে চলে গেল কফি হাউসের শেষ প্রান্তের একটা টেবিলে, যেখানে আগে থেকেই ক’জন ছেলে-মেয়ে বসেছিল। সে তাদের সঙ্গে মিশে গেল। কথা বলতে লাগল। হাসতে লাগলো।
ইসমাইলরা উঠল। বেরিয়ে আসার সময় তার মনে হল, মেয়েটি তার দিকে অন্তত একবার আড়চোখে তাকাবে। তাকালো না। সে বেরিয়ে এসেছিল এক রহস্য নিয়ে।
আজ ইসমাইল একা। সামনে কফির মগ। কফি ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সেদিকে তার কোন ভ্রূক্ষেপ নেই। তার সেদিনের কথা মনে পড়ে গেছে। সে বিচরণ করছে অতীতে। সেদিনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে সেও আনমনে কখনও কখনও হাসছে। সে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে নিজের মধ্যে। যখন সম্বিৎ ফিরল, নিজেকে সে আবিষ্কার করল অন্যরূপে। সে বসে আছে। সামনের টেবিলে চারজন মহিলা, তারই সমবয়সী, কফি হাতে নিজেদের মধ্যে গল্প করছে আর হাসছে। তাদেরই একজন, যে বসেছে ইসমাইলের মুখোমুখি, ইসমাইল তার দিকেই তাকিয়ে আছে!