এক.
রাহেদের সঙ্গে কতদিন দেখা হয়েছে সালমার। শুধু দেখা হয়েছে। কথা হয়নি কখনও। না কোন ইশারা। একই গ্রামে একই পাড়ায় ওদের বাস। সালমা এই পাড়ার বউমা।
সেদিন শহর থেকে ফিরছিল রাহেদ। বসেছিল ট্রেকারের সামনের সিটে। তার বসার মিনিট খানেক পরেই উঠে বসেছিল সালমা। তারই পাশে। আর সেদিনই টুকটাক কথা হয়েছিল তার সাথে। সালমা ফিরছিল ডাক্তার দেখিয়ে।
“একা কেন? সঙ্গে কেউ আসেনি?”
“না। সঙ্গে যার আসার কথা সে-ই তো নেই বাড়িতে!”
“কোথায় আছে এখন?”
“গোয়ায়।”
“কবে আসবে?”
“জানি না।” জানি না বলার সময় অভিমান ঝরে পড়ল সালমার গলা থেকে। সালমার বর সেরাজুল স্বর্ণকার। এদিকে তেমন কাজ নেই। অগত্যা বিদেশে গিয়ে পড়ে থাকে সারাবছর।
“সাধারণত ক’মাস পর আসে?”
“ছয়- সাত মাস। ঈদের পরই তো গেল। এখন আসতে অনেক দেরি।”
“একা একা থাকতে ভালো লাগছে ভাবি?” এই কথাটার মধ্যে বোধহয় মধু মিশ্রিত ছিল। আর ছিল অন্তর ছুঁয়ে যাওয়ার আকুতি। সালমা অনেক্ষণ চেয়ে থাকল রাহেদের দিকে। তারপর বলল, “তোমার বউ বাড়িতে না থাকলে তোমার কেমন লাগে!”
এই উত্তরে ছিল প্রশ্রয় । সেটা পেয়ে রাহেদের হৃদয়তন্ত্রীতে একটা মোচড় দিয়ে উঠল। সে কিছুটা ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করল। আর মাথা নিচু করে বলল, “আমি তিন-চার দিনের বেশি থাকতে পারি না।”
গ্রীষ্মের মধ্য দুপুর। ট্রেকারে যাত্রী কম। সামনে কেউ আর উঠেনি। ইঞ্জিনের শব্দ। ড্রাইভারের গাড়ি চালানোয় মনোনিবেশ। কেউ শুনল না তার কথা। সালমা ভাবি ঠিক শুনল। সেও একটু শিথিল করল নিজেকে। সরে এল আরও। ফিসফিস করে বলল, “তাহলে তুমিই বলো আমি কেমন করে আছি!”
মন নেয়া-দেয়া হয়ে গেলে আত্মা এক হয়ে যায়। তাদের বেলায়ও হল। সেক্ষেত্রে মুখে কথা না বলেও ইশারায় কথা বলা যায়! এভাবেই আরও অনেক অনেক কথা হল দু’জনের।
দুই.
“তোমার সঙ্গে প্রায় দেখা হত। কথা বলতে ইচ্ছে হত। কিন্তু লজ্জায় বলা হত না কখনও।” কথাগুলো বলল রাহেদ।
প্রত্যুত্তরে সালমা বলল, “এখন আর লজ্জা লাগছে না তো! ভাবীর সঙ্গে কথা বলতে লজ্জা কিসের? তুমি তো আর অন্য মেয়েছেলের সঙ্গে কথা বলছো না।”
রাহেদের ক’দিন থেকেই মনে হচ্ছিল ভাবীর সঙ্গে একবার দেখা করলে কেমন হয়! সেই উদ্দেশ্যেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছিল। সালমা তার বাড়ির সামনে রাস্তায় ঝাট দিচ্ছিল। রাহেদকে দেখে যখন সে জানতে চাইল, “এই অবেলায় কোথায় যাচ্ছো?” রাহেদ তবু ভনিতা করে বলল, “একটু জমির দিকে যাব ভাবি। তুমি ভালো আছো?”
সালমা চোখ নাচিয়ে উত্তর করল, “ভালো থাকতে আর পারলাম কই! সকাল-বিকাল মনের আগুনে পুড়তে আছি।”
এই কথার মধ্যে একটা আবেদন আছে। বুঝতে পারল রাহেদ। রাহেদ ধরা দিল। সালমা তাকে বসতে বলল খানিক। সে সাড়া দিল। তারা দু’জন এসে বসেছে বাড়ির বারান্দায়। রাহেদকে চেয়ার দিয়ে সে নিজে বসেছে তার মুখোমুখি, খানিক তফাতে।
সালমা চা করতে চাইছিল। রাহেদ উঠতে দেয়নি। “তোমাকে চা করতে হবে না। গল্প করতে এসেছি, গল্প করো।”
মুখ বাকিয়ে সালমা বলল, “তুমি না বললে জমির দিকে যাচ্ছিলে! তুমি তো গল্প করতে আসোনি।”
এই মুখের ভাষা রাহেদ চেনে। সেও মুখ নাচিয়ে বলল, ” চাষ কি আর এক রকমের হয় ভাবি!”
সালমা কী বুঝল কে জানে। তার মুখচোখে লালিমা খেলা করে গেল। সে মাথা নিচু করে বসে রইল।
তিন.
তারপরেও রাহেদ দু-একবার গিয়েছে সালমার বাড়ি। নিয়ে এসেছে মোবাইল নম্বর। কথাও হয়েছে। সালমা তার কাছে একটা কুর্তি চেয়েছে। সঙ্গে একটা প্লাজো। রাহেদ যে ক’বার গিয়েছে, সালমার মেয়েটার জন্য চকলেট নিয়ে গেছে। দামি চকলেট। মেয়েটা চকলেট পেয়ে ভীষণ খুশি। এর আগে কেউ হয়ত এত দামি চকলেট তাকে কিনে দেয়নি। রাহেদের আশপাশে সর্বক্ষণ ঘুরঘুর করেছে।
রাহেদের অবস্থা ভালো না। এক ছেলে আর বউকে নিয়ে মায়ের সঙ্গে থাকে। বাবা মারা যাওয়ার পর, রেখে যাওয়া জমিজমা চাষ করে যা আসে তাতেই সংসার গুজরান হয়। সে চলে যেতে চেয়েছিল বিদেশে। কাজে। মা যেতে দেয়নি। বলেছিল, “আমি এই আছি এই নেই! চোখের সামনে থাক বেটা। আর ক’দিনই বা বাঁচবো!” মাকে ছেড়ে তারও মন সায় দেয়নি চলে যেতে। তবে অনটন আছে এবং পুরোদমেই আছে। সারা সংসার জুড়ে তার উপস্থিতি।
সালমা একটা কুর্তি-প্লাজো চেয়েছে। কী এমন চেয়েছে তার কাছে? কতই বা দাম? বড়জোর সাতশো? কিন্তু রাহেদ জানে এই সাতশো টাকা তার কাছে অনেক। এই টাকায় তার সংসারের শত ফুটোর কয়েকটা অন্তত বুজানো সম্ভব হবে। ওদিকে সালমার টানও অনুভব করছে হৃদয় জুড়ে। সে পড়েছে দোটানায়।
সালমার ফোন আসে। আজ একবার যাওয়ার কথা ছিল। ছুটে যেতে মন চাইছে। বাধ সাধছে কুর্তি-প্লাজো। তা না নিয়ে কেমন করে যায় সে। কত বড় মুখ করে চেয়েছিল। একটা আবদার করেছিল ভালোলাগা মানুষটির কাছে। অন্তর্দ্বন্দ্ব টের পায় রাহেদ। ফোন ধরে না। রিং হতেই থাকে। একসময় কেটে যায়। আবার রিং হয়। সুইচ অফ করে দেয়। সে যাবে না। তার সে সাধ্য নেই।
সাতশো টাকা রোজগারের জন্য তাকে জমিতে সাতদিন, সকাল থেকে সন্ধ্যে নিরন্তর কাজ করে যেতে হয়। মাথার ঘাম চুইয়ে পা পর্যন্ত গড়ায়। সাতশো টাকা তার কাছে অনেক, অ-নে-ক। ছেলের কয়েকমাসের টিউশন ফি বাকি, ধার পড়েছে মুদির দোকানে, মায়ের ওষুধ কেনা হয়নি। সার কিনতে পারছে না বলে জমিতে জল দেয়া হচ্ছে না, পিছিয়ে যাচ্ছে চাষের সিজিন।
রাহেদ যায়নি। তার কিছু করার নেই। কিচ্ছু করার নেই।
তবু মনের কোণে একটা বেদনার সূক্ষ্ম অনুভূতি টের পায়। মানুষের মন তো!
রাহেদকে ভাবনায় ডুবে থাকতে দেখে তার বউ চেঁচায়, “তোমার কাছে ঈদে একটা প্লাজো-কুর্তি চেয়েছিলাম। দিতে পারলে না। আমি হয়েই তোমার মত মরদের সঙ্গে ঘর করছি । অন্য কোন মেয়ে হলে তোমার মুখে ঝাঁটা মেরে এতদিনে বিদেয় হয়ে যেত বুঝলে।”
রাহেদ এমন কথা বহুবার শুনেছে তার বউয়ের মুখে। শুনে ব্যথিত হয়েছে বারংবার। কিন্তু আশ্চর্য! আজ তেমন খারাপ লাগলো না কথাগুলো। মুহূর্তে মন খারাপের গুমোট বাতাস কোথায় যেন উবে গেল!