সবচেয়ে দুঃখী কবির নাম নজরুল

বিদ্রোহী কবি কাজি নজরুল ইসলাম

The saddest poet is Kazi Nazrul Islam

আবু রাইহান, টিডিএন বাংলা:

নজরুলের জন্মক্ষণের মায়ের দেওয়া ডাক নাম দুখু আর আকিকার দিনে বাপের দেওয়া নাম নজরুল ইসলাম। অনেকে নজরুলকে নজর আলী বলে ডাকত। নজরুলের আরেক নাম ব্যাঙাচি। তাঁর অপর আর এক নাম তারা ক্ষ্যাপা, তারা মিঞাও বলতো কেউ কেউ। নুরু নজরুলের আর একটি ডাক নাম। তিনি নিজের ব্যক্তিগত অনেক চিঠিপত্রে নজরুল না লিখে নুরু লিখেছেন।
‘কবি নজরুলের বংশ পরিচিতি’ নামক প্রবন্ধে এম আবদুর রহমান লিখেছেন, ‘ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রথম দশকে মোহাম্মদ ইসলাম নামক এক সাধুপুরুষ পবিত্র আরব দেশের মশহুরনামা বাগদাদ হতে এসেছিলেন হিন্দুস্থানে। কেউ বলেন ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে, আবার কেউ বলেন ভাগ্য পরীক্ষার নিয়তে।দিল্লির শাহী তখতে আসীন ছিলেন তখন সুলতান কুতুবউদ্দিন(১২০৬-১২১০)।নানা শহর-নগর, পল্লী-পুর পরিভ্রমণ করে ডেরা পাতেন তিনি পাটনায়। পাটনার হাজিপুর গ্রামে। ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজির যশ-সৌরভ তখন ছড়িয়ে পড়েছে দেশ-বিদেশে। বাঙলা দেশ জয় করে মুসলিম শাসন কায়েম করেছেন তিনি। বহির্বঙ্গ হতে মুসলমানরা দলে দলে এসে বাঙলায় বসতি স্থাপন আরম্ভ করেছেন।এই ডাকে সাড়া দিলেন সুফী মোহাম্মদ ইসলাম। পাটনার বাস তুলে দিয়ে এলেন তিনি শরিফাবাদ বর্ধমানে। তারপর অজয় তীরবর্তী চুরুলিয়ায়। হিন্দু শাসন যুগের চুরুলিয়া ছিল রাজা নরোত্তম সিংহের রাজধানী। শিল্প ব্যবসায়ের অন্যতম কেন্দ্রস্থল ছিল এই জনপদ। ভাগীরথী অতিক্রম করে ইন্দ্রানী কন্টকনগর উজানীকে স্পর্শ করে অজয়ের বুক বেয়ে আসা-যাওয়া করত বাণিজ্যতরী এই চুরুলিয়ায়।
অতীত ইতিহাসের সাক্ষ্য হিসাবে রাজা নরোত্তম সিংহের গড়ের অস্তিত্ব আজও বর্তমান আছে। আর আছে পীর হাজী পাহলোয়ানের মাজার এবং পীর সাহেবের পীরপুকুর। পীর পুকুরের উত্তর দিকে বাসস্থান নির্মাণ করেছিলেন মোহাম্মদ ইসলাম। মুসলিম শাসন আমলে চুরুলিয়ায় ছিল আদালত। এই আদালতের কাজী নিযুক্ত হয়েছিলেন সুফী মোহাম্মদ ইসলাম। ইসলামের ধর্মীয় ভাষায় তিনি ছিলেন সুপন্ডিত। ন্যায় বিচারক বলে সুনাম ছিল তাঁর।কাজীর পদে নিযুক্ত ছিলেন তিনি বহু বৎসর। তাঁর সময় হতে তাঁর বংশধরেরা কাজী উপাধি ব্যবহার করে আসছেন।চুরুলিয়ার কাজী বংশের অনেকেরই বাড়িতে যেসব প্রাচীন দলিল দস্তাবেজ এবং তৈজসপত্র আছে তাতে কাজী খেবরতুল্লাহর নাম লিপিবদ্ধ এবং অঙ্কিত আছে। জানা যায় তিনি তৎকালীন চুরুলিয়ার অন্যতম ধর্নাঢ্য ব্যক্তি ছিলেন এবং সম্রাট প্রদত্ত তৌজি সমূহের মধ্যে অনেকগুলি তখনও তাঁর সত্ব দখলে ছিল। আরবি, ফারসি, উর্দু প্রভৃতি ভাষায় তিনি ছিলেন সুপণ্ডিত। পীর মানুষ বলে সম্মানিত ছিলেন তিনি চুরুলিয়া অঞ্চলে। মৌলভী কাজী খেবরতুল্লাহর চার ছেলে। জ্যৈষ্ঠ কাজী গোলাম হোসেন যিনি কাজী আমানুল্লাহ এবং কাজী নজিবুল্লাহ নামে দুই সন্তানের জনক হয়েছিলেন।কাজী আমানুল্লাহর এক পুত্র কাজী ফকির আহমদ।কাজী ফকির আহমদ আরবি এবং ফারসি জানতেন চলনসই।বাংলা এবং উর্দু অতি উত্তম রূপে আয়ত্ত করেছিলেন।উচ্চাঙ্গের মিলাদ পাঠক বলে তাঁর সুনাম ছিল। মুন্সি ফকির আহমদ ছিলেন সুপুরুষ।তাঁর ছিল সুন্দর স্বাস্থ্য এবং সুগঠিত দেহ। পিতার ওয়ারিস সূত্রে তিনি পেয়েছিলেন প্রায় চল্লিশ বিঘার মতো চাষের জমি। কিন্তু শেষ বয়সে তাঁর জমি জায়গা, বিষয় সম্পত্তি বলতে, এক বসতবাড়ি ছাড়া আর কিছুই ছিল না। সরলতা, দানশীলতা,পাশা খেলার নেশা এবং সাংসারিক জ্ঞানহীনতার জন্য সমস্ত বিষয় সম্পত্তি তাঁর হাতছাড়া হয়ে গিয়েছিল।ফকির আহমদের দুই স্ত্রী। দ্বিতীয় পত্নী মোসাম্মৎ জাহেদা খাতুন মরহুমা কবি নজরুল ইসলামের জননী।ফকির আহমদের ঔরসে এবং জায়েদা খাতুনের গর্ভে তিন পুত্র এবং এক কন্যার জন্ম হয়েছিল। তাঁর পুত্রগণের মধ্যে জ্যেষ্ঠ কাজী সাহেবজান,মধ্যম কাজী নজরুল ইসলাম এবং কনিষ্ঠ কাজী আলী হোসেন।কন্যার নাম উম্মে কুলসুম।’
‘বঙ্গীয় ১৩১৪ সাল। নজরুলের বয়স যখন সবেমাত্র আট,সেই সময় তাঁর পিতা মুন্সি ফকির আহমেদ ইন্তেকাল করেন। অভাবের সংসারে আরও অভাব দেখা দিল। তাঁর পিতার যে যৎসামান্য আয় ছিল তাও বন্ধ হয়ে গেল। অভাবের অথৈ দরিয়ায় পড়লেন নজরুল জননী। অগত্যা অল্প বয়সে নজরুলের বড় ভাই কাজী সাহেবজানকে নিতে হল চাকরি। রানীগঞ্জের কয়লা খনিতে সাহেবজান যে চাকরি পেয়েছিলেন তার মাইনে মোটেই উল্লেখযোগ্য ছিল না।… অনাহারে এবং অর্ধাহারে জাহেদা বিবিকে দিন কাটাতে হয়েছে মাঝে মাঝে।…. এই দুরবস্থার মধ্যে ১৩১৬ সালের এক শুভ দিনে নজরুল ইসলাম গ্রামের মক্তব হতে প্রাথমিক পরীক্ষায় পাশ করলেন। গ্রামবাসীরা জায়েদা বিবির আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ করতে না পারলেও তখনকার মতো তাঁর একটা উপকার করলেন। নজরুলকে তাঁরা গ্রামের মক্তবে- যে মক্তব হতে তিনি পাশ করেছিলেন- সেই পাঠশালার ছোট পন্ডিতের পদে ভর্তি করে নিলেন।বেতন নামমাত্র। কিশোর নজরুল নিযুক্ত হলেন গ্রামের মসজিদের ইমাম আর মুয়াজ্জিন এর পদে। স্বগ্রামের স্বনামধন্য ওস্তাদ শেখ চাকর গোদার আহ্বানে তাঁর লেটোর দলে গিয়ে যোগ দিলেন। চাকর গোদা নজরুলকে ডাকতেন ব্যাঙ্গাচি কবি বলে। তিনি বললেন আমার ব্যাঙাচি বড় হলে সাপ হবে। কিশোর নজরুল লেটোর দলের সঙ্গে যুক্ত থাকা কালে বহুসংখ্যক গান লিখেছিলেন এবং লেটো গানের অভিনয়ের জন্য লিখেছিলেন অনেকগুলি পালা বা ক্ষুদ্রাকার নাটক। তাঁর লিখিত নাটক গুলির মধ্যে মাত্র দশখানির সন্ধান পাওয়া যায়, বাকি নাটক বা নাটিকাগুলির নাম অপরিচিত- আজ আর পাওয়া যায় না।
ইংরেজি ১৯১৭ সাল। নজরুল তখন আঠারোতে পা দিয়েছেন। তাঁদের শিহারসোল স্কুলের প্রি টেস্ট পরীক্ষা নিকটবর্তী। নজরুল, বন্ধু শৈলজানন্দ তখন তাঁদের উভয়ের মধ্যে যুদ্ধে যাওয়ার পরামর্শ পাকা হয়ে গেছে। সৈন্যবাহিনীতে ভর্তি হবার পর নজরুলকে যেতে হয়েছিল কলকাতা হতে লাহোরে, তারপর লাহোর হতে নৌশেরা এবং সেখানে কয়েক মাস ট্রেনিং নেওয়ার পর করাচীতে। নজরুল করাচীতে ছিলেন শেষ পর্যন্ত, ছিলেন করাচীর ‘গনিজা লাইনের’ বাঙালি পল্টনের ছাউনিতে। গনিজা লাইনের বর্তমান নাম ‘আবিসিনিয়া লাইন’।কলকাতা হতে লাহোর যাত্রার পূর্বে বাঙালি পল্টনে ভর্তি হওয়া ছেলেদেরকে কলকাতার নাগরিকদের পক্ষ হতে কলকাতা টাউন হলে এক বিদায় সম্বর্ধনা জানানো হয়েছিল।’(‘কিশোর নজরুল’-এম আব্দুর রহমান)
সবচেয়ে দুঃখী কবি ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। চার সন্তানের মৃত্যুর পরে নজরুলের মা ঝুঁকি নিতে চাননি। তাই নাম রেখেছিলেন দুখুমিয়া। ভেবেছিলেন এমন নামের দুখের কুণ্ডলীকে নিশ্চয়ই যমে ছুঁবে না। শেষ পর্যন্ত যমের সত্যিই অরুচি হয়েছিল। সারা জীবন নজরুলকে দুষ্ট গ্রহ তাড়া করে ফিরলেও সব সময় মরতে মরতে বেঁচে গেছেন। এমনকি মারাত্মক আঘাতে নির্বাক হয়েও ৩৪ বছর বেঁচে ছিলেন।
নজরুলের জীবদ্দশায় তাঁর চার পুত্রের তিন পুত্রই মারা যান।পুত্র বুলবুলের মৃত্যু তো পিতা হিসাবে তাঁর জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছিল। মাত্র আট বছর বয়সে বাবা মারা যান। মায়ের দ্বিতীয় বিয়ের কষ্ট কোনোদিন ভুলতে পারেন নি।আট বছর বয়স থেকে নিজের ভরণপোষণের ভার নিজেকেই তুলে নিতে হয়। বেরিয়ে পড়তে হয় পৃথিবীর পথে পথে। নিজের গ্রাম ছেড়ে লেটোদলে, আসানসোলে রুটির দোকানে, ময়মনসিংহে, মাথরুনের, সিয়ারসোল, বিলাসপুরের পথে পথে ঘুরে বেড়াতে হয়েছে নোঙ্গরহীন এই বালককে।দশম শ্রেণিতে পড়ার সময়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সৈনিক হিসাবে চাকরি শুরু করতে হয়। অর্থের অভাবে রোগের শুরুতে চিকিৎসা করতে না পারায় চিরদিনের জন্য বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন, মস্তিস্কের কার্যক্ষমতা হারিয়ে যায়।মাত্র উনত্রিশ বছর বয়সে স্ত্রী প্রমীলা পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হয়ে চিরদিনের জন্য শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন।
নজরুলের যখন মাত্র আট বছর বয়স স্বামীহারা জাহেদা খাতুন সন্তানদের ভরণ-পোষণের কারণে, স্বামী ফকির আহমদের চাচাতো ভাই তথা নজরুলের লেটো গানের উৎসাহদাতা বজলে করিমের সাথে দ্বিতীয় বিবাহে আবদ্ধ হওয়ায় মায়ের সাথে নজরুলের অভিমান হয়। নজরুল সেই যে মাকে ছাড়লেন, মায়ের মৃত্যুতেও তাঁকে আর দেখতে যাননি।মাকে নিয়ে নজরুলের আজীবন গভীর এক বেদনাবোধ ছিল।মাকে নিয়ে একটি কবিতাও লিখেছিলেন।নজরুল গবেষক মজিদ মাহমুদ নজরুল জীবনভিত্তিক উপন্যাস “তুমি শুনিতে চেয়ো না” তে লিখেছেন-‘আমার অসুস্থ জীবনে জন্মভূমি চুরুলিয়ায় যাওয়ার সুযোগ ঘটল। প্রায় তিন যুগ আগে মায়ের প্রতি অভিমান করে মা ও মাতৃভূমি ছেড়েছিলাম-আমার সৃজনময় সুস্থ জীবনে আর কখনো সেখানে ফেরা হয় নি। মায়ের মৃত্যু প্রায় তিন দশক পার হয়ে গেছে, সহোদররা মারা গেছে। চুরুলিয়া আসার কারণ পশ্চিমবঙ্গ সরকার আমার জীবন নিয়ে একটি তথ্যচিত্র তৈরি করছে-সেই প্রয়োজনে আসা।দুখিনী মা আমার।মায়ের সাথে আমার আচরণ সংগত ছিল না। অনেকে আমায় দোষারোপ করেছে, গবেষকরা কারণ খুঁজতে চেয়েছে।অনেক মা নিয়ে আমি কথা বলেছি, কবিতা লিখেছি, অনেক মাকে বই উৎসর্গ করেছি।কিন্তু নিজের মায়ের ভালোবাসা নিয়ে লিখেছি ‘শায়ক-বেঁধা পাখী’-সেদিন কি আর আমি জানতাম একদিন এই কবিতার মতো আমায় এখানে ফিরে আসতে হবে, মা যেন কেঁদে কেঁদে বলছে-‘হারিয়ে পাওয়া ওরে আমার মানিক।/দেখেই তোরে চিনেছি, আয়, বক্ষে ধরি খানিক।/বাণ-বেঁধা বুক দেখে তোরে কোলে কেহ না নিক,/ওরে হারার ভয়ে ফেলতে পারে চিরকালের মা কি?/ওরে আমার কোমল-বুকে-কাঁটা-বেঁধা পাখী।/কেমন ক’রে কোথায় তোরে আড়াল দিয়ে রাখি।/এ যে রে তোর চির-চেনা স্নেহ,/তুই তো আমার ন’সরে অতিথ্ অতীত কালের কেহ,/বারে বারে নাম হারায়ে এসেছিস এই গেহ,/এই মায়ের বুকে থাক যাদু তোর য’দিন আছে বাকী।/প্রাণের আড়াল ক’রতে পারে সৃজন দিনের মা কি?/হারিয়ে যাওয়া? ওরে পাগল, সে তো চোখের ফাঁকি।’ মাতৃ স্নেহের কাঙাল নজরুল আজীবন মাতৃস্নেহ খুঁজে বেড়িয়েছেন।

Exit mobile version