টিডিএন বাংলা: বেশ কিছুদিন ধরেই বিভিন্ন “ইলেকট্রনিক খবরের চ্যানেল” থেকে শুরু করে বিনোদনমূলক “কেবল চ্যানেলে” লটারির বিজ্ঞাপনের হিড়িক। আর এইসব বিজ্ঞাপনের মুখ গ্ল্যামার জগতের খ্যাতনামা শিল্পীরা। অতীতেও যে লটারির বিজ্ঞাপন দেখা যেত না তা কিন্তু একদমই নয়। কিন্তু সেটা বিশেষ বিশেষ দিনের আগে দেখা যেত, যেমন “রথযাত্রা বাম্পার”, “নববর্ষ বাম্পার”, “দীপাবলি বাম্পার” ইত্যাদি। কিন্তু বর্তমানে লটারির ব্যাপক প্রচার যা নির্দিষ্ট বিশেষ দিনের গণ্ডি ছাড়িয়ে বছরের প্রতিটি দিনকে লটারি ক্রেতা এবং বিক্রেতা সকলের কাছে বিশেষ দিন হিসেবে তুলে ধরছে ।
এর ফলে কটা সাধারণ মানুষ ধনী হচ্ছেন বা লাখপতি হচ্ছেন তাঁদের আর্থসামাজিক অবস্থার কোনও পরিবর্তন হচ্ছে তার কোনও পরিসংখ্যা না থাকলেও, লটারির ফাঁদে পা দিয়ে হাজার হাজার পরিবারে বিপর্যয় নেমে এসেছে তা স্পষ্ট বলা যায়।
লটারির এই যে আধিপত্য তার কারণ বা ইতিহাস নিয়ে তর্ক-বিতর্ক হতেই পারে। কিন্তু লটারির সুফল থেকে কুফলের পাল্লা অনেক ভারী, একথা জোর গলায় বলা যায়। অল্প সময়ে বা বিনা পরিশ্রমে বা ভাগ্যের খেলা দেখতে যে লটারিই সেরা মাধ্যম বা প্রচুর পরিমাণে অর্থ প্রাপ্তি ঘটানোর ক্ষেত্রে এর জুড়ি যে অন্য কোন মাধ্যম হতে পারবে না তা নিয়ে কারও সন্দেহ নেই। আর তাই বর্তমানে সাধারণ লোভী অলস মানুষ থেকে শুরু করে সমাজের নানা স্তরের মানুষ এই লটারির নেশায় মেতে উঠেছেন। কিন্তু ভাগ্য ফেরানোর ইচ্ছায় লটারির ফাঁদে পড়ে সাধারণ মানুষের পরিবারগুলির ভয়াবহ অবস্থা। লটারির বিষাক্ত ছোবল থেকে রেহাই পাচ্ছে না গ্রাম বাংলার দূর দূরান্তের অজানা প্রান্তও। প্রতিটি সাধারণ মানের গ্রাম, শহরেও আজ লটারির এজেন্টের পায়ের ছাপ পড়ে কলুষিত হয়ে উঠেছে। প্রতিদিন গ্রাম থেকে শহরতলি, বা শহর সব জায়গাতে লটারির বাড়বাড়ন্ত। রাস্তার মোড় , বাসস্ট্যান্ড, রেলস্টেশন সর্বত্র লটারির হাতছানি। দিনমজুর থেকে চাকুরীজীবী সকলে এই সর্বনাশা নেশায় মত্ত। নিজেদের বন্ধু বা আত্মীয় বা মুখ চেনা বা অনেক সময় আমরা নিজেরাই এই লটারির কোটি কোটি টাকা বা লাখ লাখ টাকা জেতার নেশায় নিজেদের কষ্টার্জিত টাকাকে বিলিয়ে দিচ্ছি প্রতিদিন। প্রতিদিন ন্যূনতম ১০০ টাকা বা সর্বোচ্চ ৫০০ টাকার টিকিট অনেকেই নগদে বা ধারে কাটছেন। এইভাবে যাঁরা টিকিট কাটছেন তাঁরা একপ্রকার সর্বোচ্চ পর্যায়ে লটারির নেশায় মেতে পথে বসেছেন ।
সরকারি প্রশ্রয়ে প্রতিদিন কয়েকশো কোটি টাকার ব্যবসা চলছে লটারির নামে। কিন্তু আসলে তা বেশিরভাগ গরীব সাধারন মানুষদের রক্ত জল করা পরিশ্রমের টাকা। কত ঘরে যে এই নিয়ে নিত্যদিন অশান্তি, দৈহিক অত্যাচার, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মনোমালিন্য, বাবা ছেলের পারিবারিক অশান্তি এবং সর্বোপরি মানসিক অবিশ্বাস সৃষ্টি হচ্ছে আজ তার কোন খবর আমাদের কাছে নেই। একজন কোটিপতি হওয়ার পিছনে যে কত জন সাধারণ মানুষ সর্বস্বান্ত হয়ে লটারির চোরাবালিতে ঢুকে যাচ্ছে তার হিসাব নেই ।
লটারি খেলবার নেশায় অগণিত পরিবার সর্বস্বান্ত হচ্ছে। পরিবারকে বঞ্চিত করে আয়ের সিংহভাগ লটারিতে ব্যয় করছেন অগণিত মানুষ। অনেকে বাড়ি, স্ত্রীর সোনার গহনা এবং অন্যান্য সম্পত্তি বাঁধা রেখেও ক্রমাগত টিকিট কিনে চলেছেন। এই আবর্ত হতে বের হওয়া অনেকের পক্ষেই মদ কিংবা মাদকের আকর্ষণ উপেক্ষা করবার মতোই দুঃসাধ্য। স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রণায় আত্মহত্যা করেছেন, এমন মানুষ কম নাই। এমনকি যাঁরা জিতেছেন, তাঁরাও সকলে ধনী হবার স্বপ্নকে স্পর্শ করতে পারেন নি। অল্প সময়ে বাজে নেশায় সব টাকা হারিয়ে আবার দরিদ্র জীবনে ফিরে গেছেন। বছরের পর বছর লটারির টিকিট কিনেও বিফল, ঋণগ্রস্ত, হতাশ হয়েছেন, এমন দৃষ্টান্ত অজস্র। সহজে ধনীর হওয়ার দিবাস্বপ্নে এক অন্ধকার গোলকধাঁধার আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছেন বহু মানুষ। চরম বিপর্যয়ের দিকে এগিয়ে চলেছেন তাঁরা। কিন্তু লটারির টিকিটের বিক্রয় কমেনি। ২০১৫ সালে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক লটারি নিষিদ্ধ করবার প্রস্তাব পেশ করে রাজ্য সভায়। তাতে বলা হয়, ভারতে বৎসরে অন্তত পঞ্চাশ হাজার কোটি টাকার লটারির টিকিট বিক্রয় হয়, এবং দৈনিক অন্তত দুই কোটি মানুষ টিকিট ক্রয় করেন।
বাস্তব কুফলগুলি বিচার করলে মানতেই হবে, লটারির এই বিপুল জনপ্রিয়তা এক নৈতিক ও সামাজিক সঙ্কটে ফেলেছে সমাজ তথা রাষ্ট্রকে। নাগরিকের সুরক্ষা রাষ্ট্রের কর্তব্য। অন্যান্য মাদকের ন্যায় লটারিও নাগরিকের এক বৃহৎ অংশকে বিপথচালিত করে, তার অর্থের অপচয় ও চরিত্রের অপকর্ষ ঘটিয়ে থাকে, সে সম্পর্কে সাক্ষ্যপ্রমাণ রয়েছে। তা হলে রাষ্ট্র লটারি নিষিদ্ধ করবে না কেন? বস্তুত, ভারতে তেরোটি রাজ্য ব্যতীত বাকি সবগুলিতে লটারি নিষিদ্ধ। সারা ভারতে অনলাইন লটারি নিষিদ্ধ করেছে কেন্দ্র।
কোষাগারের চালকরা অবশ্য বলবেন, লটারি হতে যে বিপুল রাজস্ব মেলে, রাজকোষের জন্য তার প্রয়োজন। তা ব্যয় হবে উন্নয়নে। এই যুক্তি অনৈতিক। রাষ্ট্রের পক্ষে হানিকর। উন্নয়ন নাগরিকের জন্য, তাঁকে বিপন্ন করে উন্নয়নের জন্য অর্থসংগ্রহ করা চলে না। আর অধিক রাজস্ব পাবার তাড়নায় যদি ক্রমাগত লটারির বিক্রয় বাড়াতে থাকে সরকার, তার পরিণাম হবে ভয়ানক। সরকারের সংযত হওয়ার সময় এসেছে। তাই তামাক বা তামাকজাত পণ্যকে বা নেশা জাতীয় তরলকে যেমন দেশজুড়ে নিষিদ্ধ করার প্রয়োজন, তেমনি সমানভাবে প্রয়োজন এই লটারির ব্যবসাকে নিষিদ্ধ করার বা একটা নির্দিষ্ট হারে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আনার।