প্রেসিডেন্সি কলেজে আমাদের সিনিয়র, আজকের পশ্চিমবঙ্গের তরুণ ঔপন্যাসিক, শামিম আহমেদ তাঁর একটি গ্রন্থে একটি দৃশ্য রেখেছেন, যেখানে মির্জা গালিবের সঙ্গে কলকাতায় রামমোহন রায়ের দেখা হচ্ছে। ঐতিহাসিকভাবে এটা সত্যিই ঘটেছিল কিনা আমার জানা নেই, কিন্তু শামিম বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম সেরা ছাত্র এবং আজকের ভারতবর্ষের একজন অধ্যাপক, এটা সত্যি কথা বলেছেন, যে গালিব এবং রামমোহন ১৮২৮ থেকে ১৮২৯ একসঙ্গে কলকাতায় ছিলেন। এবং মির্জা গালিব রামমোহনের কাজকর্মে ভূয়সী প্রশংসা করছেন। রামমোহন আর গালিবের এই কাল্পনিক বা হয়তো সত্যি সাক্ষাৎকার দিয়ে এই নিবন্ধ শুরু করার কারণ, ইতিহাস এবং সমসাময়িক দর্শন অনেক সময়ই আমাদের অনেক অদ্ভুত সমাপতনের সামনে এনে দাঁড় করায়। শামিম যেভাবে গালিব এবং রামমোহন, একজন নবজাগরণের ভারতবর্ষের প্রাণপুরুষ, অন্যজন ভারতীয় সাহিত্যের উর্দু কবিতার ‘আইকন’, দুজনকে এক সূত্রে বেঁধেছেন, তা দিয়ে অনেক কিছুকে আন্দাজ করা যায়।
যেমন ধরা যাক, জর্জ অরওয়েল আর শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে।জর্জ অরওয়েলএকজন ঔপন্যাসিক সাহিত্যিক, যিনি শুধু সাহিত্য নন, সম্ভবত গত এক শতাব্দী ধরে রাজনৈতিক দর্শনেরও অন্যতম পুরোধা| চিন্তাবিদ হিসেবে যিনি স্বৈরতন্ত্র, আধিপত্যবাদের বিপদকে নিপুণ বিশ্লেষণে দেখিয়ে গিয়েছিলেন আজ থেকে আট দশক আগেও, সেই জর্জ অরওয়েলের জন্ম কিন্তু হয়েছিল বিহারের চম্পারণে। হ্যাঁ, চম্পারণে, যে চম্পারণকে আমরা চিনি গান্ধীজির ঐতিহাসিক সত্যাগ্রহের কারণে। এরিক আর্থার ব্লেয়ার, যেটা জর্জ অরওয়েলের আসল নাম, একজন ব্রিটিশ আমলার পুত্র হিসেবে তিনি জন্মেছিলেন বিহারের চম্পারণে। কিন্তু ইতিহাসের আশ্চর্য সমাপতনে তিনি মায়ের সঙ্গে ইংল্যান্ডে ফিরে গেলেও আবার ফিরে আসেন বার্মা বা আজকের মায়ানমারে চাকরি করবার জন্য। এবং ইম্পেরিয়াল ব্রিটিশ পুলিশের হয়ে তিনি চাকরি করেন। যেসময়টা জর্জ অরওয়েল বার্মায় কাটাচ্ছেন এবং ১৯২৭ সালে চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে আবার ইংল্যান্ডে ফিরে যাচ্ছেন, সেইসময় বার্মাকে কেন্দ্র করে আর-একজন ঔপন্যাসিক তাঁর ঐতিহাসিক এবং কালজয়ী সাহিত্যকীর্তি তৈরি করছেন। শরৎচন্দ্র লিখছেন ‘পথের দাবী’, যে উপন্যাসকে ব্রিটিশ সরকার রাজদ্রোহের দায়ে নিষিদ্ধ করবে। ইতিহাসের সেই অদ্ভুত সমাপতনে অরওয়েল যতটা বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠছেন ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতাবাদের প্রতি, প্রতিবাদ করতে শুরু করছেন একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে, এবং মনে মনে ঠিক করে নিচ্ছেন, যে একনায়কতন্ত্র ঔপনিবেশিকতাবাদ, অত্যাচারের প্রতিবাদ তাঁকে করতেই হবে, সেই একই জিনিস আমরা দেখতে পারছি শরৎচন্দ্রের ‘পথের দাবী’ উপন্যাসে।
হ্যাঁ, চম্পারণে, যে চম্পারণকে আমরা চিনি গান্ধীজির ঐতিহাসিক সত্যাগ্রহের কারণে। এরিক আর্থার ব্লেয়ার, যেটা জর্জ অরওয়েলের আসল নাম, একজন ব্রিটিশ আমলার পুত্র হিসেবে তিনি জন্মেছিলেন বিহারের চম্পারণে।
আর-একটা ২৬ জানুয়ারি বা ভারতবর্ষের প্রজাতন্ত্র দিবসের প্রাক্কালে জর্জ অরওয়েলকে ডেকে আনার কারণ, তিনি যে শুধুমাত্র একজন ‘আইকনিক’ ঔপন্যাসিক ছিলেন, তা তো নয়, ‘নাইনটিন এইট্টি ফোর’ উপন্যাসের মাধ্যমে তিনি আমাদের মস্তিষ্কে, মননে এমন কতগুলো শব্দ গেঁথে দিয়েছেন, যা আজকের ভারতবর্ষে বা বলা চলে গোটা বিশ্বের রাজনীতিতেই খুবই তাৎপর্যপূর্ণ এবং জরুরি শব্দ। ‘বিগ ব্রাদার’ বা ‘দাদাগিরি’ কিংবা ‘থট-পুলিশিং’ অর্থাৎ নীতি পুলিশ, এই শব্দগুলো আজকের ভারতবর্ষেও তো সমান তাৎপর্য বহন করে! অরওয়েল অবশ্যই স্ট্যালিন জমানার দিকে নিশানা করে তাঁর বিখ্যাত সাহিত্যকীর্তি ‘নাইনটিন এইট্টি ফোর’ বা ‘অ্যানিম্যাল ফার্ম’ লিখেছিলেন। কিন্তু একইসঙ্গে তাঁর তীব্র বীতরাগ ছিল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতাবাদ বা ইউরোপীয় ফ্যাসিজমের বিরুদ্ধেও। আমাদের মনে রাখতে হবে, যে অরওয়েল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে এবং পরে ইউরোপের ফ্যাসিবাদের উত্থানকে দেখেছিলেন। এবং তা তিনি চিনতেন বলেই ওরকম কালজয়ী উপন্যাস এবং ভবিষ্যতের পৃথিবী কোনধরনের একনায়কতন্ত্র বা ফ্যাসিবাদে আক্রান্ত হতে পারে, কোন ধরনের রাজনৈতিক দর্শন বিশ্বকে গ্রাস করে নিতে পারে, সে বিষয়ে এমন নিপুণ বর্ণনা দিয়েছিলেন। অরওয়েল সেজন্যই রাজনৈতিক দর্শন বা রাজনীতির হালহকিকত বাতলে দেওয়ার জন্য এক অব্যর্থ ঔপন্যাসিক।
১৮২৮ বা ২৯-এর কোনও সময়ে কলকাতা শহরে গালিব এবং রামমোহন রায়ের সত্যিই সাক্ষাৎ হয়েছিল কিনা, সেই প্রসঙ্গ থেকে জর্জ অরওয়েল, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বা বিহারের চম্পারণে গান্ধীজির সত্যাগ্রহকে মনে করিয়ে দেওয়ার কারণ, আজকের ভারতবর্ষে আমরা যেসমস্ত বিষয়গুলি নিয়ে চিন্তিত বা যা আমাদের গণতন্ত্র এবং রাজনীতির জন্য চ্যালেঞ্জ, তা সব কিছুর উপাদান এইসব চরিত্রগুলি অনেক আগেই দিয়ে গিয়েছেন। রামমোহন যেভাবে ভারতবর্ষের নবজাগরণকে দিকনির্দেশ করেছিলেন, গালিব যেভাবে ভারতবর্ষের বহুত্ববাদকে ‘চ্যাম্পিয়ন’ করে গিয়েছিলেন, আর গান্ধীজি যেখান থেকে সত্যাগ্রহ শুরু করেছিলেন, সেগুলিকে যদি আমরা মনে রাখি, তাহলে আজকের ভারতবর্ষের গণতন্ত্রের এবং প্রজাতন্ত্রের চ্যালেঞ্জকে চিনতে খুব অসুবিধা হবে না। এবং ইতিহাসের সমাপতনে এই চ্যালেঞ্জকে চিনবার জন্য, আধিপত্যবাদকে চিনবার জন্য, বহুস্বরকে দাবিয়ে রাখার প্রবণতাকে বুঝবার জন্য জর্জ অরওয়েলের ‘আইকনিক’ উপন্যাস ‘নাইনটিন এইট্টি ফোর’-র চাইতে ভালো পাঠ আর কী-ই বা হতে পারে?
‘দাদাগিরি’ এবং ‘নীতিপুলিশ’ যখন আমাদের চারপাশের সমাজ সভ্যতাকে গিলে ফেলতে চাইছে, তখন আমাদের আর-একটা ২৬ জানুয়ারি আসছে। এবং আরও তাৎপর্যপূর্ণভাবে ওই ২৬ জানুয়ারির আগে একটা ২০ জানুয়ারি এসে গিয়েছে, যে ২০ জানুয়ারিতে পৃথিবীর তথাকথিত সবচেয়ে শক্তিশালী গণতন্ত্রে অতি দক্ষিণপন্থার ‘আইকন’ ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় ফিরে এসেছেন।
অতি দক্ষিণপন্থী রাজনীতিতে ডোনাল্ড ট্রাম্পের গুরুত্বকে বুঝে যদি এই ২৬ জানুয়ারি বা প্রজাতন্ত্র দিবসে ভারতবর্ষের রাজনৈতিক এবং সামাজিক চ্যালেঞ্জকে চিনবার চেষ্টা করি, তাহলে আমার বিশ্বাস সুবিধা হবে। এটা আলাদা বিষয়, যে ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্যাপিটাল হিলের হামলায় সবাইকে মার্জনা করে দেওয়ার অনেক আগে বাবরি ভাঙায় অভিযুক্ত এদেশের সমস্ত বিজেপির শীর্ষনেতাও আদালতের থেকে ছাড়া পেয়ে গিয়েছেন। যদি কারও ২০২১-এর ৬ জানুয়ারি মার্কিন পার্লামেন্টের গা বেয়ে সেই অতি দক্ষিণপন্থীর রাজনীতির সমর্থকদের বেয়ে ওঠার দৃশ্য মনে পড়ে, তাহলে আমি বলব, এর অনেক আগে কিন্তু ভারতবর্ষ এই ধরনের ঘটনা দেখেছিল ১৯৯২-এর ৬ ডিসেম্বর। একইধরনের আক্রমণের তীব্রতা, একইধরনের নিজেদের একমাত্র শক্তি বলে মনে করা, বাবরি ধ্বংসের দিনই ভারতবর্ষ দেখে নিয়েছিল। সেক্ষেত্রে অতি দক্ষিণপন্থী রাজনীতির উত্থানে এবং একধরনের ‘দাদাগিরি’কে ডমিনেটিং পলিটিক্যাল থট হিসেবে বা আধিপত্য বিস্তারকারী রাজনৈতিক দর্শন হিসেবে প্রতিষ্ঠা করায় ভারতবর্ষ বা বিজেপি ডোনাল্ড ট্রাম্প বা রিপাবলিকান পার্টির চাইতে এগিয়ে রয়েছে। ফলে ২০ জানুয়ারি যখন ডোনাল্ড ট্রাম্প এসে আমেরিকার রাজনীতি, সংস্কৃতি, তার অভিবাসন নীতি সব কিছুকে ঝাঁকুনি দিচ্ছেন, তখন ভারতবর্ষে দক্ষিণপন্থা কতটা উৎসাহিত হবে, সেটা অবশ্যই লক্ষ্য করার মতো বিষয়।
তাহলে কি ট্রাম্পের উত্থান বা দ্বিতীয়বার তাঁর কুর্সিতে বসা ভারতীয় দক্ষিণপন্থী রাজনীতিকে বা অতি দক্ষিণপন্থাকে আরও উৎসাহিত করবে? প্রশ্নটা জরুরি এই কারণে, যে আমরা দেখতে পাচ্ছি, এতদিন যাদের আমরা হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির পথপ্রদর্শক বা মূল কাণ্ডারি বলে মনে করতাম, সেই আরএসএসের মোহন ভাগবতের কথা অস্বীকার করে নব্য হিন্দুত্ববাদের কথা বলতে শুরু করে দিয়েছেন উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ। এমনকি মোহন ভাগবত যখন ভারতবর্ষে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা করা বা হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের কথা বলছেন, সমস্ত মসজিদের নিচে মন্দির না খুঁজতে যাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন, তখন যোগী আরও কড়া হিন্দুত্ববাদের দিকে ইঙ্গিত করছেন। তিনি সম্ভালের মসজিদ হিন্দুদের ছেড়ে দেওয়া উচিত বলে প্রকাশ্যে হুংকার ছাড়ছেন। তাহলে রেগনের থেকে যেমন আরও কট্টরপন্থী হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্প এলেন, তেমনই কি মোহন ভাগবত বা নরেন্দ্র মোদির থেকে আমরা আরও কড়া হিন্দুত্ববাদী হিসেবে যোগী আদিত্যনাথকে চিহ্নিত করব এবং চিনে নেব? এবং ঠিক যেভাবে ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজেকে দক্ষিণপন্থার নতুন ‘আইকন’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে এতদিনের প্রচলিত মার্কিন সংস্কৃতি বা মার্কিন গণতন্ত্রের সব ধারণাকে গুঁড়িয়ে দিচ্ছেন, ভবিষ্যতে যোগী আদিত্যনাথের মতো আরও কট্টরবাদী হিন্দু নেতারা ভারতবর্ষের সংবিধান, গান্ধীর আদর্শ সব কিছুকে গুঁড়িয়ে দেবেন? এই সংশয় এবং এই প্রশ্ন অবশ্যই এই ২৬ জানুয়ারির আগে আমাদের সকলের হৃদয়ে এবং মননে থাকবে। থাকার আরও বেশি কারণ, যে অতি সম্প্রতি লোকসভা নির্বাচনে আমরা দেখেছি নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন ভারতীয় জনতা পার্টি ভারতবর্ষকে হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করার যে স্বপ্ন নিয়ে এগিয়েছিল, তা ভারতের জনগণ প্রত্যাখ্যান করেছে। তাহলে যোগী আদিত্যনাথের আরও কট্টর হিন্দুত্ববাদ কি ভারতবর্ষে স্বীকৃতি পাবে? তা চ্যাম্পিয়ন হবে না ভারতবর্ষের জনগণ আবার ২০২৪-এর মতো পরিণত বোধ দেখাবে?
এবং এখানেই হয়তো দক্ষিণপন্থা বনাম অতি দক্ষিণপন্থার লড়াই বা সংকটও শুরু হয়ে গিয়েছে। একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টা পরিষ্কার হবে। এবছরই ২৬ জানুয়ারি নরেন্দ্র মোদির আমন্ত্রণে প্রজাতন্ত্র দিবসে প্রধান অতিথি হিসেবে আসছেন ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট প্রাবোও সুবিয়ান্তো। আমাদের মনে রাখতে হবে, ইন্দোনেশিয়ায় সবথেকে বেশি মুসলিমদের বাস। অর্থাৎ ইন্দোনেশিয়া পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মুসলিম দেশ। সেই দেশের রাষ্ট্রপ্রধানকে প্রজাতন্ত্র দিবসে এনে যদি নরেন্দ্র মোদি কোনও বার্তা দিতে চান, অর্থাৎ মোহন ভাগবতের মতো তিনিও হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের কথা তুলে ধরতে চান, তাহলে তার বিপরীতে অবস্থান করছেন যোগী আদিত্যনাথ। উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যা বলছেন, তাঁর সুরেই প্রায় সুর মিলিয়ে বিজেপি শাসিত উত্তরাখণ্ডের মুখ্যমন্ত্রীও বলছেন, যে এই বছর ২৬ জানুয়ারি তাঁর রাজ্যে ইউনিভার্সাল সিভিল কোর্ট বা অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু হয়ে যাবে। কী অদ্ভুত সমাপতন দেখুন! নরেন্দ্র মোদি যেদিন আদর করে, আপ্যায়ন করে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মুসলিম দেশের রাষ্ট্রপ্রধানকে নয়াদিল্লিতে ডেকে আনছেন, ঠিক সেই দিনই রাজধানী দিল্লি থেকে কয়েকশো কিলোমিটার দূরে উত্তরাখণ্ডে মুসলিমদের উত্যক্ত করবার জন্যে সেই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু করার হুমকি দিচ্ছেন। এটাই ভারতবর্ষের গণতন্ত্রের বা এই প্রজাতন্ত্র দিবসের সবচেয়ে বড় সংকট বা চ্যালেঞ্জ, যা ভারতবর্ষের গণতন্ত্রকে অতিক্রম করতে হবে।
আমেরিকার অতি দক্ষিণপন্থী রাজনীতির ‘আইকন’, নতুন নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ভারতবর্ষকে দক্ষিণ এশিয়ায় রাজনীতিত্ স্থিতিশীলতা ফেরাতে, অর্থাৎ আরও পরিষ্কার করে বলতে গেলে, ঘরের পাশের প্রতিবেশী বাংলাদেশে মৌলবাদের উত্থান ঠেকাতে কতটা সাহায্য করবে, সেই বিষয়টা আমাদের ভাবাচ্ছে, তেমনই ভাবাচ্ছে ট্রাম্পের অভিবাসন নীতি থেকে শুরু আরও হাজারো নীতিনির্দেশ মার্কিন মুলুকে প্রবাসী ভারতীয়দের বা ভারতীয় বংশোদ্ভূতদের কতটা বিপন্ন করবে। ট্রাম্প আজকের পৃথিবীতে অবশ্যই অতি দক্ষিণপন্থার ‘আইকন’, কিন্তু আবারও বললাম না, রাজনীতি, ইতিহাস, সমাজ, দর্শন আসলে এক অদ্ভুত সমাপতনে চলে। ইন্দোনেশিয়ার যে প্রেসিডেন্টকে নরেন্দ্র মোদি ডেকে আনছেন, তিনিও তাঁর দেশে অতি দক্ষিণপন্থী জাতীয়তাবাদী বলে পরিচিত। কিন্তু যেটা আমরা খেয়াল রাখি না, সুবিয়ান্তো নির্বাচনে জিতেছেন বা তাঁর নিজের দেশে তাঁর যে রেটিং বাড়ছে তার কারণ, বিনা পয়সায় মানুষকে খাবার দেওয়া। অর্থাৎ, দক্ষিণপন্থার রাজনীতিতেও কোথাও আপনাকে সমাজতান্ত্রিক ভাবনাকে অ্যাকোমোডেট বা জায়গা করে দিতে হচ্ছে। সুবিয়ান্তো বিশ্বের সবচেয়ে বড় মুসলিম দেশে এই মুহূর্তে যে অ্যাপ্রুভাল রেটিংয়ে এগিয়ে রয়েছেন, সেটা আসলে কিন্তু ওই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডার’ বা বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে ‘লাডলি বাহেনা’র মতো ডাইরেক্ট বেনিফিশিয়ারি তৈরি করার কৌশলে। তাহলে? তাহলে কী হবে? নরেন্দ্র মোদি অতি দক্ষিণপন্থী থেকে সরে এসে যে মধ্যপন্থার রাজনীতির ওপর আস্থা রাখতে চাইছেন, তা চ্যাম্পিয়ন হবে? ২০২৪-এর নির্বাচন নরেন্দ্র মোদি বা মোহন ভাগবতকে যে বাস্তবতার পৃথিবীতে ফিরিয়ে এনেছে সেই পথে ভারত হাঁটতে পারবে? নাকি আমাদের ঘাড়ের উপর যোগী আদিত্যনাথের ‘নীতিপুলিশ’-এর খাড়া, ‘দাদাগিরি’-র হুমকি, এইসব কাজ করবে?
অরওয়েল দিয়ে শুরু করেছিলাম, অরওয়েল দিয়েই শেষ করি। অরওয়েল কিন্তু সেই ‘নাইনটিন এইট্টি ফোর’-এ দেখিয়ে গিয়েছেন, যে একাধিপত্য, ফ্যাসিবাদ পৃথিবীতে ফেরত আসবেই। আর মানুষকেই তার মোকাবিলা করতে হবে। ২০২৫-এর ২৬ জানুয়ারি তাই আমাদের ভাবতে হবে, যে কেন বিজেপি বা ভারতবর্ষের দক্ষিণপন্থী দলটি মাঝেমাঝেই সংবিধান পরিবর্তন বা আম্বেদকর নিয়ে বিভিন্ন বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে। আর কীভাবে সেই বিতর্ককে অতিক্রম করে ভারতবর্ষ, ১৪০ কোটির দেশ গান্ধীবাদী পথেই হাঁটতে চায়। অরওয়েলেরও কিন্তু জন্ম হয়েছিল গান্ধীজির অসহযোগ আন্দোলনের জন্য বিখ্যাত হয়ে থাকা চম্পারণে।