‘বাংলাদেশী’ দাগিয়ে রাণাঘাটের কাছে গেদে-শিয়ালদা লোকাল ট্রেনে হুগলির রেজাউল ইসলামকে মারধর! নিন্দার ঝড়

‘বাংলাদেশী’ দাগিয়ে অকথ্য ভাষায় গালি দিয়ে মঙ্গলবার শিয়ালদহ গামী গেদে লোকালে রানাঘাটের কাছে ট্রেনের ভিতর মারধর করা হয় এক সংখ্যালঘু মুসলিম যুবককে। এমনটাই অভিযোগ করেছেন হুগলির হরিপালের আক্রান্ত রেজাউল ইসলাম মন্ডল। বুধবার শিয়ালদহ জিআরপিএস – এ এফআইআর করেছেন তিনি।
শিয়ালদহ স্টেশনে অভিযোগ জানাতে উপস্থিত ছিলেন ইমতিয়াজ আহমেদ মোল্লা সহ অনেকেই। ইমতিয়াজ আহমেদ মোল্লা এই ঘটনার তীব্র নিন্দা জানান। তিনি রেজাউলের পাশে থেকে আইনি লড়াইয়ের আশ্বাস দেন।

এদিকে চলন্ত ট্রেনে এই রকম ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন রাজনৈতিক দলের নেতা থেকে শুরু করে বিশিষ্টজনেরা।

“বাংলাদেশ থেকে কি তাড়িয়ে দিয়েছে চেয়ার ব্যাগ বেধে! ইন্ডিয়া দখল করতে এসেছিস, এবার আবার গাল”

টিডিএন বাংলা জানতে পেরেছে, ধর্মপ্রাণ রেজাউল ইসলাম মন্ডল বাংলাদেশের বিশ্ব ইজতেমায় গিয়েছিলেন। আখেরি মোনাজাত শেষে গেদে হয়ে নিজের মাতৃভূমিতে ফিরছিলেন।

নিজের ফেসবুকে রেজাউল ইসলাম লিখেছেন,’আমি গেদে-শিয়ালদহ (ট্রেন নং – ৩১৯১৮, আমার টিকিট নং – ৬৬৭৩৭৮৯১) ৮:৪৫ এর শিয়ালদহ গামী লোকালে গেদে স্টেশন থেকে চাপি, এবং আমার সাথে আরও ৩ জন সাথী, মোট আমরা ৪ জন। যথারীতি ট্রেনের বাম দিকে উইনডোসিটে সামনাসামনি আমি আর আমার বন্ধু বসি এবং ট্রেনের ডান দিকে আরো দুজন উইন্ডো সাইডে বসে। তখন ট্রেন পুরোই ফাঁকা। তো আমার হাতে থাকা একটি লাগেজ টলি ব্যাগ আমি আমার সোজাসুজি বাংকারে তুলে রাখি সবকিছু নরমালই ছিল, যখন ৪০ মিনিট মতো ট্রেন চলে তারপর ট্রেনে ভিড় বাড়তে থাকে, তারপর রানাঘাট স্টেশন ঢুকলো তখন ট্রেনে প্রচন্ড ভিড় হয়ে যায় এবং আমাকে উদ্দেশ্য করে -প্রচন্ড গালিগালাজ, ইসলাম বিদ্বেষী কথা, বাংলাদেশি তকমা ইত্যাদি দিতে থাকে, যেহেতু আমাকে নাম ধরে বা গায়ে হাত দিয়ে কিছু বলেনি আমি তাই কোন উত্তর করিনি ওই সমস্ত কটু কথার। যখন আমি কোনো উত্তর করিনি তারপর আমাকে সিটে বসে থাকা এক ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করে “টলি ব্যাগটা কি তোর?” আমি সাথে সাথেই বলি হ্যাঁ। এরপর আমাকে বলল যে, আমরা কোলে ব্যাগ নিয়ে বসে থাকবো আর তুই টলি ব্যাগ বাঙ্কারে তুলে রাখবি! এখুনি ব্যাগ নামা। আমি সাথে সাথেই ব্যাগ নামিয়ে সিটের নিচে রাখি, ব্যাগের উপর একটা ফোল্ডিং চেয়ার ছিল আমার সেটাও নামাতে যাচ্ছি,তখন আমার পিছনে থাকা একজন আমাকে ঠেলে প্রচন্ড নোংরা ভাষায় গাল দিয়ে বলে যে “বাংলাদেশ থেকে কি তাড়িয়ে দিয়েছে চেয়ার ব্যাগ বেধে! ইন্ডিয়া দখল করতে এসেছিস, এবার আবার গাল”। এই ভাষাটা যে বলেছে তার নাম- অজয় (ট্রেনের মধ্যে ওদের বলাবলির কারণে নামটা শোনা)।

যখন আমাকে বাংলাদেশী ডিরেক্ট বলেছে তখন আমি প্রতিবাদ করে বলি যে “আপনি ভারতের নাগরিক আমিও ভারতের নাগরিক, এই ভারত ভূমিতে আপনার যতটুকু অধিকার আমার ঠিক ততটুকুই অধিকার আছে, আপনার ১ ইঞ্চি বেশি নেই, আমার ১ ইঞ্চি কম নেই” – কথাগুলো কোন ভয়-ভীতি ছাড়া চোখে চোখ রেখেই বলেছিলাম- এটাই ওদের গাত্রদাহ হয়ে ওঠে।

তখন ওই অজয় চুপ করে যায় পাস থেকে এক লোক অকথ্য ভাষায় আমাকে এবং মুসলিম সম্প্রদায়কে গাল দিতে থাকে এবং সাথে বলতে থাকে “এখনি ওকে মেরে ফেল, ট্রেন থেকে ফেলে দে, ট্রেন থেকে নামিয়ে দে, ব্যাগ ছুড়ে ফেলে দে, চেয়ার কেড়ে নে, ইত্যাদি সব মুখেই বলতে থাকে, আমি তখন রাগের মাথায় প্রতিবাদ স্বরূপ বলি “আপনি যদি মারেন আমিও আপনাকে চড় মারতে পারবো, একটা হলেও” পুরো কম্পার্টমেন্ট প্রত্যক্ষদর্শী – কিন্তু কেউ এগিয়ে আসেনি বা প্রতিবাদ করেনি একটি মাত্র লোক ছাড়া।

ওই কথা হওয়ার পরেই আমার দিকে তেড়ে আসে , আমাকে মারবি তোকেই মেরে ফেলবো আজকে, দুইজন তেড়ে আসতে আরো দুইজন এইভাবে ১০ থেকে ১৫ জন তেড়ে এসে আমার উপর পড়ে যায় এবং তখন অজয় আমাকে ঠেলতে থাকে এবং বলতে থাকে বাংলাদেশের কোথাকার, বাংলাদেশে পার্সেল করে দেবো, দেশটাকে নষ্ট করে ফেলছে এরা এসে, সামাজিক শিক্ষা নাই, এই ওই সেই বহু কথা এবং গালগালাজ চলতে থাকে। এবং যখন তেড়ে আসে সকলে, একমাত্র যেই ভদ্রলোক ব্যাগ নামানোর কথা বলেছিলেন তিনি আমাকে আকার করে ধরে থাকেন এবং সবাইকে মারতে নিষেধ করতে থাকেন,ঠেলে সরাতে থাকেন কিন্তু অত লোক সামাল দিতে পারেননি উনি একা। উনার কাঁধের উপর দিয়ে হাত বাড়িয়ে আমার কানের পাশে ঘুসি দিয়েছে, আমার টুপি টেনে খুলেছে এবং টুপি পায়ের তলায় ফেলে দিয়েছে ওদের নিজেদের, সেই সাথে আমার মাথার চুল ছিঁড়েছে, হাত বাড়িয়ে দাঁড়ি ধরে টানার চেষ্টা করেছে, দু চারটে চুল ছিঁড়েছে দাড়ির, আমার গলায় থাকা রুমালের কিছু অংশ ছিড়েছে এবং আমাকে ট্রেনের বগিতে যদি বাম সাইডে ছিলাম ১০ জনের অধিক আমার উপর পড়ে গিয়ে আমাকে টিপে ধরে যে ট্রেনের কোণে, তাই বাঁ দিকের কাঁধে চোট লেগেছে। ট্রেনের দেয়ালের সাথে।

আর সাথে আমার যে তিনজন ছিল একজন আমার মুখোমুখি সে ফোন বার করতে গেলে তাকে বলা হয়েছে, ফোন সমেত তোকেও ফেলে দেব ট্রেন থেকে এবং ডান সাইডে জানলার ধারে থাকা দুইজন উঠে আসতে চেয়েছে তখন তাদেরকে জোর করে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং বলা হয়েছে সবগুলোকে ফেলা হবে ট্রেন থেকে, বাংলাদেশ থেকে এসে ইন্ডিয়া দখল করতে আসছিস আর ধর্ম তুলে জাতি তুলে মা বাপ তুলে গালিগালাজ আনলিমিটেড, এমন কি এতে তিন চার জন মহিলাও জড়িত। তবে সকলের ডেলি প্যাসেঞ্জার বলে মনে হয়েছে। এবং ওই বগিতে নিয়ে গেলে আমি সকলকেই সনাক্ত করতে পারব।”

ফেসবুকে তিনি আরো জানিয়েছেন,

“আমার সাথে ডানদিকে জানালায় দুজন বসেছিল তাদেরকে নৈহাটিতে নামতে বাধ্য করা হয়, আমাকে না নিয়ে তারা নেমে যায়।

আমার সামনের জন নিরীহ লোক সে কোন কথাই বলতে পারেনি এবং তাকেও মারতে উদ্যত হয়।

এই মুহূর্তে আমি একা আমার মাথায় আসেনি কি করতে হবে! কি করলে ভালো হবে! তখন প্রাণ বাঁচাবো নাকি ভিডিও করব ফোনই তো বের করতে দেয়নি! অনেকেই বলছেন ভিডিও কেন করেননি? তাই এই কথা বললাম।।
এবার আসি রেল পুলিশ এফআইআর সেটা আমার মাথায় আসেনি, একা যাওয়ার মানসিক পরিস্থিতি ছিল না।
…….
আজকে জিআরপিতে এফআইআর করব, গতকাল মেডিকেল এবং লোকাল থানায় সম্পূর্ণ ঘটনা জানানো আছে।

আমি মানসিক ও শারীরিকভাবে বিধ্বস্ত থাকায় কাল এতটা লেখার ধৈর্য, শক্তি কোনটাই ছিল না। তাই লিখতে পারিনি সম্পূর্ণ।”

এই ঘটনা শোনার পর ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন অনেকেই।


কলকাতার প্রাক্তন মেয়র তথা সিপিআইএম সাংসদ বিকাশ রঞ্জন ভট্টাচার্য ফেসবুকে লিখেছেন,’ নদীয়ায় রেজাউলের উপর আক্রমণের ঘটনা কোন একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। আর এস এস রাজনীতির দ্বারা লালিত প্রশাসিত রাজ‍্যে এসব আকছার ঘটে চলেছে। পশ্চিমবঙ্গ সহ বাম ভাবাদর্শ প্রাণিত রাজ‍্যে ঐ রকম নক্কারজনক ঘটনা ঘটাতে কেউ সাহস করত না। বিগত একদশক পশ্চিমবঙ্গ আরএসএস ভাবাদর্শে শাসিত হয়ে সমাজজীবনে ধর্মীয় বিভাজন তৈরি করতে সমর্থ হয়েছে। এই কুচক্র থেকে মুক্তি পেতে ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শের পক্ষে জোরদার আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।’

আইএসএফ বিধায়ক নওশাদ সিদ্দিকী সোস্যাল মিডিয়ায় লেখেন,” নদীয়ার রাণাঘাটের কাছে গেদে-শিয়ালদা লোকাল ট্রেনে রেজাউল ইসলাম নামের এক যুবক বেশ কয়েকজন সহযাত্রীর দ্বারা চরম শারিরীক ও মানসিক লাঞ্ছনার শিকার হন। এই ঘটনা কোন ব্যতিক্রমী বিষয় নয়। এই রাজ্যে ইতিপূর্বে এইধরণের ঘটনার কথা আমরা গণমাধ্যমের মারফত জানতে পেরেছি। সমাজমাধ্যমের প্লাটফর্মগুলিতেও ছড়িয়ে যাচ্ছে এইধরণের ঘটনার কথা। কিন্তু এইরাজ্যের সরকারের কোন হুঁশ নেই। রেজাউল ইসলামের অপরাধ কি? তাঁর দাড়ি আছে, মাথায় টুপি পরে আছেন, এটাই কি তাঁর অপরাধ? তাতেই তাঁকে জঙ্গী তকমা দিয়ে শারিরীকভাবে লাঞ্ছনার শিকার হতে হবে? তাঁকে গালাগাল দিতে হবে? দেশজুড়ে হিন্দুত্ববাদী বিজেপি সরকার যে চরম সাম্প্রদায়িক গরল উগরে চলেছে, যে ঘৃণার চাষ করে চলেছে, সেটা থেকে এই বাংলার মাটিও রেহাই পাচ্ছে না। এই রাজ্যের তৃণমূল কংগ্রেস সরকারও এই বিষয়ে একপ্রকার মদত দিয়ে চলেছে। মুসলিমদের “ক্যাপটিভ ভোট ব্যাঙ্ক” হিসেবে ব্যবহার করে এই দল কিন্তু তাদের হিন্দুত্ববাদীদের চরম সাম্প্রদায়িক আক্রমণের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। মূলধারার গণমাধ্যমের একাংশও এই ঘৃণা ছড়ানোর কাজে ধারাবাহিকভাবে ইন্ধন দিয়ে চলেছে। সেই জন্য রেজাউল ইসলামের মতন মানুষগুলি ট্রেনে-বাসে, রাস্তা-ঘাটে আকছার হেনস্থার শিকার হচ্ছেন, লাঞ্ছিত হচ্ছেন প্রতিনিয়ত। ট্রেনের ভেতর যখন এইধরণের ঘটনা ঘটছে তখন রেল কর্তৃপক্ষও নিষ্ক্রিয় থাকতে পারে না। রেল পুলিশকেও তৎপরতার সঙ্গে এই ঘটনার মোকাবিলা করতে হবে ও অপরাধীদের গ্রেপ্তার করতে হবে। এই বিষয়ে কোন গাফিলতি সহ্য করা যাবে না। এই দমবন্ধ পরিস্থিতির অবসান ঘটাতে মানুষকে সচেতন করতে হবে। এই রাজনৈতিক সচেতনতার কাজটা আমাদের ধারাবাহিকভাবে করে যেতে হবে।”

এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে সারা বাংলা সংখ্যালঘু যুব ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মদ কামরুজ্জামান টিডিএন বাংলাকে জানিয়েছেন,”রানাঘাট লোকাল ট্রেনে রেজাউল ইসলাম এর উপরে যে আক্রমণ, তাতে স্পষ্ট গো-বলয়ের ছায়া দেখা যাচ্ছে। বিগত দিনেও ট্রেনে মুসলিম ছেলেরা আক্রান্ত হয়েছে। তার ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। কিন্তু রেল পুলিশ বা রাজ্য পুলিশ অপরাধীদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়নি। তাই এই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে। আমরা দাবি করছি প্রশাসন অপরাধীদের বিরুদ্ধে আইনি কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করুন।
যারা সম্প্রীতির বাংলায় মেরুকরণের চেষ্টা চালাচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধেও কঠোর ব্যবস্থা না নিলে এই ধরনের ঘটনা ঘটতে থাকবে বলে আমরা আশঙ্কা করছি।”

Exit mobile version