বলা হয়, প্রকৃতির মধ্যেই এমন সব উপাদান আছে যা দিয়ে মানুষের শরীরের প্রায় সব রোগ নিরাময় করা সম্ভব। আয়ুর্বেদ নিয়ে যাঁরা পড়াশোনা করেছেন তাঁরা এই কথা সর্বান্তকরণে বিশ্বাস করেন। শুধু তাই নয়, প্রাচীনকালের চিকিৎসা পদ্ধতিও ছিল প্রাকৃতিক উপাদানের ওপর ভিত্তি করেই। আজ আমরা সময়ের সাথে সাথে বিজ্ঞানের উন্নতির সঙ্গে পা মিলিয়ে অনেকটাই নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে এলোপ্যাথিক মেডিসিনের উপরে। তবে, এখনো যদি আমরা খুঁজে দেখি তাহলে দেখতে পাবো আমাদের আশেপাশে বড়ই অযত্নে বেড়ে উঠছে এমন গাছগাছড়া যার ভেষজ গুণ অনন্য। এমনই একটি চমৎকারী গাছ হল কুলেখাড়া। যার বৈজ্ঞানিক নাম হাইগ্রোফিলা অরিকুলাটা (Hygrophila auriculata)। কুলেখাড়ার আয়রন-সমৃদ্ধ বৈশিষ্ট্য আপনার শরীরে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা বাড়াতে পারে, এবং প্রাচীন ভারতীয় ঐতিহ্য অনুসারে স্বাস্থ্যকর শাক খাওয়ার চেয়ে ভাল আর কী হতে পারে। এই শাক আপনার শরীরের হিমোগ্লোবিনের মাত্রা যেমন বাড়াবে, তেমনই খাদ্য হজমের ক্ষমতা এবং অন্যান্য আরও অনেক উপকার করবে। কুলেখাড়া হল একটি ভারতীয় আয়ুর্বেদিক উদ্ভিদ যা রক্তে হিমোগ্লোবিন বাড়াতে ব্যবহৃত হয়। কুলেখাড়ার বোটানিক্যাল নাম হাইগ্রোফিলা এবং ইংরেজিতে একে সাধারণত ‘মার্শ উইড’ও বলা হয়।
কুলাখাড়ার পুষ্টিগুণ— প্রতি ১০০ গ্রামে রয়েছে, সোডিয়াম ৫৬.১ মিলিগ্রাম, পটাশিয়াম ২৬৬ মিলিগ্রাম, ক্যালশিয়াম ২৭.৯৩ মিলিগ্রাম, তামা ৪.৮৭ মিলিগ্রাম, দস্তা ০.৪৪ মিলিগ্রাম, আয়রন ৭.০৩ মিলিগ্রাম, ভিটামিন সি ৫০.০৮ মিলিগ্রাম, রিবোফ্লাভিন ১০২ মিলিগ্রাম, ফলিক অ্যাসিড ১.০ (এর বেশি) মিলিগ্রাম, বিটা ক্যারোটিন ২.৫ মিলিগ্রাম।
কুলেখাড়া পাতার ঔষধি গুণ প্রচুর। স্বাস্থ্যকর খাবারের স্বাদ প্রায়শই ভাল হয় না, এবং কুলেখড়ার ক্ষেত্রেও তাই। এই ভেষজের পুষ্টিগুণ জানলে আপনি অবাক হবেন। কুলেখাড়া, শুধুমাত্র ভিটামিন সি সমৃদ্ধ নয়, এতে প্রচুর পরিমাণে পটাসিয়ামও রয়েছে। আমাদের চারপাশের সাধারণ শাক-সবজির তুলনায় কুলেখাড়ায় আয়রনের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। কুলেখাড়া পাতা শরীরে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করে। গবেষণায় দেখা গেছে, যে এক মাস বা তার বেশি সময় ধরে এই পাতা খাওয়া রক্তাল্পতায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের স্বাস্থ্যের উল্লেখযোগ্য উন্নতি করতে পারে। এটি ডায়াবেটিস রোগীদের জন্যও অত্যন্ত কার্যকর কারণ এটি রক্তে শর্করার মাত্রা কমাতে সাহায্য করতে পারে। এটি পাকস্থলী এবং লিভারের কার্যকারিতা উন্নত করে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। এটিতে প্রদাহ-বিরোধী বৈশিষ্ট্য রয়েছে এবং হজমশক্তি উন্নত বলেও বলা হয়। একটি বৈজ্ঞানিক গবেষণায় ডায়রিয়া ও আমাশয়ের চিকিৎসা হিসেবে কুলেখাড়ার ব্যবহার প্রমাণিত হয়েছে। গবেষণা অনুসারে, ভেষজটিতে হলুদের মতো অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল এবং অ্যানথেলমিন্টিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে। কুলেখাড়া ব্যথা উপশমে ব্যথানাশক হিসেবেও কাজ করে। শুধু তাই নয়, পুরুষদের বন্ধ্যাত্বের চিকিৎসার জন্যও এর ব্যাবহার হয়। কুলেখাড়া গাছের বীজ পুরুষদের বন্ধ্যাত্বের চিকিৎসায় ব্যবহার করা হয়। এর বীজ একটি অ্যাফ্রোডিসিয়াক হিসাবে কাজ করে। এটি সিরাম টেস্টোস্টেরন এবং শুক্রাণুর সংখ্যা বৃদ্ধি করতে পারে। সবমিলিয়ে কুলেখাড়ার ভেষজ উপকারিতা এত জনপ্রিয় এবং ব্যাপক যে কোম্পানিগুলি কুলেখাড়া দিয়ে সমৃদ্ধ একাধিক পণ্য বাজারেও বিক্রি করে।
এই শাক খাওয়ার বিভিন্ন উপায় রয়েছে।কুলেখাড়ার কাটা পাতা নিয়ে মিক্সারে সামান্য জল দিয়ে ভালো করে পিষে নিন। সবুজ রস ছেঁকে একটি বয়ামে রাখুন। এক কাপ জলে ১ টেবিল চামচ রস ও ১ টেবিল চামচ মধু মিশিয়ে নিন। চাইলে কুলেখাড়ার চা বানিয়েও খেতে পারেন। এক গ্লাস জলে ৩ থেকে ৪টি পরিষ্কার পাতা মিশিয়ে ভালো করে ফুটিয়ে নিন। এতে এক টেবিল চামচ মধু মিশিয়ে গরম গরম পরিবেশন করুন। কুলেখাড়া পাউডার হিসাবেও খেতে পারেন। শুকনো পাতা মিক্সার দিয়ে পিষে একটি পাত্রে গুঁড়ো রাখুন। এক গ্লাস জলে আধা চা চামচ এই গুঁড়ো এবং এক চা চামচ মধু মিশিয়ে নিন। এটি দিনে ১ বা ২ বার পান করুন।
এই ভেষজ গুণ সমৃদ্ধ পাতার কোন পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া নেই। তবে, এটি অতিরিক্ত মাত্রায় সেবন করার ফলে পেটে ব্যথা বা ডায়েরিয়া জনিত সমস্যা দেখা দিতে পারে।