সুমন ভট্টাচার্য, টিডিএন বাংলা: ডেমোক্র্যাটদের ‘ইজরায়েল নীতি’ নিয়ে অসন্তুষ্ট মার্কিন প্রবাসী মুসলিমরা যখন মুখ ফেরাচ্ছেন কমলা হ্যারিসের থেকে, আর সেই সুবাদে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জিতে হোয়াইট হাউজে ফিরছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প, ঠিক সেইসময় পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর মুখ্য উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ করছেন রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী এবং অধ্যাপক আব্দুস সাত্তারকে। সিপিএম আমলে সংখ্যালঘু উন্নয়ন এবং মাদ্রাসা শিক্ষার দায়িত্ব সামলানো সাত্তারকে তৃণমূল সরকারও প্রায় সেই একই দায়িত্ব দিচ্ছে, এবং সরকারি নির্দেশে পরিষ্কারই বলে দেওয়া হয়েছে তিনি ক্যাবিনেট মন্ত্রীর সম্মান পাবেন। সিপিএম ছেড়ে সোমেন মিত্রের হাত ধরে কংগ্রেসে যোগ দেওয়া আব্দুস সাত্তার অধীর চৌধুরীর পরবর্তী সময়ে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি হওয়ার দৌড়ে ছিলেন। কিন্তু কংগ্রেস হাই কমান্ড বাংলাদেশে পালাবদলের পর পশ্চিমবঙ্গে দলের দায়িত্ব একজন সংখ্যালঘু নেতার হাতে তুলে দেওয়া হলে কী হতে পারে, সেই দোলাচলে থেকে সাত্তারকে প্রদেশ সভাপতি না করলেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কিন্তু সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করলেন না। রাজনীতির অদ্ভুত সমাপতনে, আব্দুস সাত্তার যেদিন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের নতুন সংখ্যালঘু মুখ হয়ে উঠছেন, তার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জিতছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প, যিনি আবার বাংলাদেশে ‘সংখ্যালঘু নির্যাতন’ নিয়ে আগেই সরব হয়েছেন।
আমেরিকায় ডোনাল্ড ট্রাম্পের শাসন পশ্চিম এশিয়ায় কী হবে, ইজরায়েল তাদের ‘গণহত্যা’ কতটা বন্ধ করবে এবং ট্রাম্প প্রশাসন কতটা ‘মুসলিম বিদ্বেষ’-এ শান দেবে, সেই নিয়ে নিশ্চয়ই আলোচনা চলবে। এবং হয়তো আগামী কয়েক বছরের আন্তর্জাতিক রাজনীতিও আবর্তিত হবে। মার্কিন রাজনীতির অনেক বিশেষজ্ঞই মনে করেন, যে, প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী কমলা হ্যারিসের ভরাডুবির কারণ, তাঁর অন্ধভাবে জো বাইডেনের ‘ইজরায়েল নীতি’কে সমর্থন করে যাওয়া, যার পরিণতিতে মার্কিন প্রবাসী মুসলিমরা ডেমোক্র্যাটদের থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিলেন। কমলা হ্যারিস যা বুঝতে পারেননি, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে মুসলিম মন বুঝতে দেরি করেন না, তা আরও একবার প্রমাণ হল কংগ্রেস থেকে নিয়ে এসে সাত্তারকে একেবারে তাঁর মুখ্য উপদেষ্টার পদে বসিয়ে দেওয়ায়। ঠিক যখন ওবিসি সংরক্ষণ নিয়ে বিভিন্ন আইনি জটিলতা চলছে এবং পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় কিছুটা চিন্তিত, ঠিক সেইসময় তিনি বিষয়টি সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখা আব্দুস সাত্তারকে মুখ্য উপদেষ্টা করে এনে সংখ্যালঘু উন্নয়ন এবং মাদ্রাসা শিক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেওয়ার দিকে ঠেলে দিলেন। বুধবার সকালে, তৃণমূল সরকারে নতুন দায়িত্ব পাওয়া সাত্তারের সঙ্গে টেলিফোন আলাপে মনে হল নতুন দায়িত্বের চাইতেও তাঁকে বেশি আপ্লুত করেছে দলনেত্রীর আন্তরিকতা এবং সম্মান দেওয়ার ইচ্ছে।
সুভদ্র, সুশিক্ষিত আব্দুস সাত্তার উত্তর ২৪ পরগনা থেকে বিধায়ক হলেও তিনি আদতে মালদহের লোক। আমাদের মনে রাখতে হবে, পশ্চিমবঙ্গের লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেস তার একটি মাত্র আসন জিতেছে মালদহ থেকে, বরকত গড়ে জয়ী হয়েছেন তাঁরই ভ্রাতুষ্পুত্র ঈশা খান। তাই সাত্তারকে দলে টেনে এবং সংখ্যালঘু উন্নয়নে সরকারের গুরু দায়িত্ব দিয়ে মমতা মুর্শিদাবাদ-মালদহে এমন একজনকে পেলেন, যিনি শুধু সেই অঞ্চলকে চেনেন না, সংখ্যালঘুদের মনের কথাও পড়তে পারেন। বাংলায় একটা পুরোনো প্রবচন আছে, ‘কারো পৌষ মাস, তো কারো সর্বনাশ!’ সাত্তারের তৃণমূল সরকারে গুরুত্বপূর্ণ পদপ্রাপ্তি কি কংগ্রেসের জন্য ‘সর্বনাশ’ নয়? কারণ, সোমেন মিত্র সিপিএমে যে প্রাক্তন মন্ত্রীকে দলে টেনে সংখ্যালঘুদের বার্তা দিতে চেয়েছিলেন, মুর্শিদাবাদের নেতা অধীর চৌধুরী সেই সাত্তারকেই ‘গুরুত্বহীন’ করে দিয়ে কার্যত তাঁকে অন্য পথ বেছে নিতে বাধ্য করলেন। পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেসের মূল ভোট ব্যাঙ্ক যে দুটি জেলায় ছিল, সেই মুর্শিদাবাদ এবং মালদহে এখন রাহুল গান্ধির দলের কী হাল, তা নিশ্চয়ই নতুন করে বলে দিতে হবে না। ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনে ওই দুটি জেলা থেকে কংগ্রেস একটি আসনও পায়নি, বরং সংখ্যালঘুরা উপুড় করে ভোট দিয়েছিল তৃণমূলকে।
মুসলমানদের সেই ‘সবক’ শেখানো থেকেও শিক্ষা না নিয়ে অধীর চৌধুরী পরের তিন বছর এমনতর রাজনীতি করেছেন, যাকে রাজ্যের শাসকদল, তৃণমূল ‘বিজেপির বি-টিম’ বলে দেগে দিতে পেরেছিল। বিজেপিও যখন চায়নি, তখন অধীর চৌধুরী পশ্চিমবঙ্গে রাষ্ট্রপতি শাসন চেয়েছেন! ‘ইন্ডিয়া’ জোটের প্রশ্নে বহরমপুরের প্রাক্তন সাংসদের রাজনৈতিক লাইনকে যখন স্বয়ং দলের সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়্গে নস্যাৎ করে দিয়েছেন, তখন পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ কংগ্রেস ভবনের বাইরে কংগ্রেসের দলিত নেতার ছবিতে কালি লাগানো হয়েছে। অধীর চৌধুরী সার্থকভাবে পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেসকে সেই জায়গায় নিয়ে যেতে পেরেছেন, যেখানে সংখ্যালঘুরা আর হাত চিহ্নের মধ্যে ‘নির্ভরতা’ বা ‘আশ্রয়’ খোঁজে না এবং তারই পরিণতিতে বহরমপুরে রাজনীতিতে নবাগত ক্রিকেটার ইউসুফ পাঠানও হারিয়ে দিয়েছেন বহরমপুরের ‘রবিন হুড’ অধীর রঞ্জন চৌধুরীকে। কিন্তু তাতেও কি অধীর চৌধুরীর ‘বিজেপির চাইতেও বড় বিজেপি’ হয়ে ওঠা থেমেছিল? তিনি যদি সংখ্যালঘু মানুষদের স্বার্থরক্ষার কথা ভাবতেন, তাহলে হরিয়ানায় নিহত পশ্চিমবঙ্গের যুবক সাবির মল্লিকের ক্যানিংয়ের বাড়িতে রাহুল গান্ধির প্রতিনিধি হিসেবে একবারের জন্যেও পৌঁছে যেতেন।
‘সংখ্যালঘু মন’ বোঝা আব্দুস সাত্তার যত দিন কংগ্রেসে ছিলেন নিরন্তর দলের মধ্যে এইসব নিয়ে মুখ খুলেছিলেন। এবং কংগ্রেস সূত্রে যত দূর জানি মুর্শিদাবাদ এবং মালদহে সংখ্যালঘু ভোটকে কীভাবে কংগ্রেসের দিকে সংহত করা যায়, সেই বিষয়ে নিরন্তর ‘দলীয় মেমো’ দিয়েছেন। কিন্তু কংগ্রেস নেতৃত্বের ‘উপেক্ষা’ হয়তো সাত্তারকে ঠেলে দিল তৃণমূলের দিকে, আর দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে অভ্যস্ত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সুযোগ বুঝে ২০২৬-এর বিধানসভা নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে নিজের প্রশাসন এবং দলকে সাজানোর জন্য সাত্তারকে ‘তুলে নিলেন’। সাত্তার যেটা বোঝেন এবং হয়তো যে কাজটা তিনি করতে পারেনও, সেটাই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর কাছে প্রত্যাশা করছেন।
কয়েকদিন আগে পুপুল জয়কারের লেখা ইন্দিরা গান্ধির জীবনী পড়তে গিয়ে দেখেছিলাম ভারতের রাজনীতির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য মহিলা চরিত্রের আস্তিনের তাস ছিল দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা। এবং কোন সিদ্ধান্ত আমজনতার মন জয় করবে, সেটা অনুধাবন করতে পারা। যেদিন ইন্দিরা মন্ত্রিসভায় তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী মোরারজি দেশাইকে দফতরবিহীন মন্ত্রী করে দিয়েছিলেন, তার পরের দিনই ব্যাঙ্ক জাতীয়করণের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে রাজনৈতিক বিরোধীদের হতবাক করে দিয়েছিলেন। তৃণমূল বা আরও নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বহরমপুরে অধীরকে হারালেন, হরিয়ানায় নিহত সাবির মল্লিকের স্ত্রীকে ডেকে চাকরি দিলেন আর এবার সাত্তারকে বেছে নিলেন সংখ্যালঘু উন্নয়নে সরকারের মুখ্য উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করতে। এরপরে পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যালঘুরা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপরে আস্থা রাখবে না তো কাকে নির্ভরযোগ্য মনে করবে? (লেখক বিশিষ্ট সাংবাদিক ও কলামিস্ট)