ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন ছিল এক দীর্ঘ ও সংগ্রামমুখর অধ্যায়, যেখানে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল ভারতীয় একত্রিত হয়ে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। এই আন্দোলনে ভারতীয় মুসলিমদের অবদান ছিল অসামান্য। মুসলিম সমাজের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা স্বাধীনতা আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন এবং তাঁদের আত্মত্যাগ ভারতীয় ইতিহাসের এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় হয়ে আছে।
মুসলিমদের ভূমিকা ও অবদান
১. ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় ছিল ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহ, যা ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম হিসেবে পরিচিত। এই বিদ্রোহে ভারতীয় মুসলিমদের বিশাল ভূমিকা ছিল। বিদ্রোহের অন্যতম নেতা ছিলেন বাহাদুর শাহ জাফর, যিনি ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন। এছাড়া মৌলভী আহমদুল্লাহ, বেগম হযরত মহল, আজিমউল্লাহ খান প্রমুখ ব্যক্তিরা এই বিদ্রোহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।
২. খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলন
১৯১৯ সালে মহাত্মা গান্ধী ও মুসলিম নেতাদের নেতৃত্বে খিলাফত আন্দোলন শুরু হয়। এই আন্দোলনের অন্যতম প্রধান নেতা ছিলেন মৌলানা মোহাম্মদ আলী, মৌলানা শওকত আলী, হাকিম আজমল খান, মৌলানা আবুল কালাম আজাদ প্রমুখ। তাঁরা ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে উজ্জীবিত করেছিলেন এবং অসহযোগ আন্দোলনের মাধ্যমে জনগণকে সংগঠিত করেছিলেন।
৩. ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ও মুসলিম নেতারা
ভারতের জাতীয় আন্দোলনে মুসলিম নেতারা কংগ্রেসের সাথে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। মৌলানা আবুল কালাম আজাদ ছিলেন কংগ্রেসের অন্যতম প্রধান নেতা এবং স্বাধীনতা আন্দোলনের এক গুরুত্বপূর্ণ কণ্ঠস্বর। তিনি অহিংস আন্দোলন ও সাম্প্রদায়িক ঐক্যের পক্ষে সক্রিয় ছিলেন। এছাড়া রফি আহমেদ কিদওয়াই, হাকিম আজমল খান, আসফ আলী, ড. মুখতার আহমেদ আনসারি প্রমুখ কংগ্রেসের মাধ্যমে স্বাধীনতা সংগ্রামে যুক্ত ছিলেন।
৪. বিপ্লবী আন্দোলনে মুসলিমদের ভূমিকা
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে শুধু অহিংস সংগ্রামই নয়, সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনেও মুসলিম নেতাদের অংশগ্রহণ ছিল। আশফাকউল্লাহ খান ছিলেন হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতির প্রতীক এবং কাকোরি ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম নেতা। এছাড়া উসমান মির্জা, রসূল খান, বড়কা খাঁ প্রমুখ স্বাধীনতা সংগ্রামে সক্রিয় ছিলেন।
৫. স্বাধীনতা পরবর্তী ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি
ঐতিহাসিকদের মতে, ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে মুসলিমদের ভূমিকা অনস্বীকার্য।
বিখ্যাত ঐতিহাসিক বিপিন চন্দ্র তাঁর লেখায় উল্লেখ করেছেন, “ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে মুসলিম নেতাদের অংশগ্রহণ জাতীয় আন্দোলনকে আরও বেগবান করেছিল।” অন্যদিকে, এস. এন. ব্যানার্জি উল্লেখ করেছেন, “মৌলানা আজাদের মত নেতারা জাতীয় সংহতির প্রতীক ছিলেন এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতিটি ধাপে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।”এই বিষয়ে আলোচনা করতে গেলে বলতে হয়,দারুল উলূম দেওবন্দ মাদ্রাসা ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এটি শুধু একটি ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই ছিল না, বরং ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে অন্যতম প্রভাবশালী কেন্দ্র হিসেবেও পরিচিত ছিল।
দেওবন্দ মাদ্রাসার অবদান নিম্নরূপ—
১. রাজনৈতিক ও সামাজিক চেতনার বিকাশদেওবন্দ
মাদ্রাসার আলেমরা ভারতের জনগণের মধ্যে স্বাধীনতার চেতনা জাগিয়ে তুলেছিলেন। তারা ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ইসলামের আলোকে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানাতেন।
২. রেশমি রুমাল আন্দোলন (১৯১৩-১৯১৭)
শেখুল হিন্দ মাহমুদ হাসান দেওবন্দের অন্যতম প্রধান নেতা ছিলেন, যিনি “রেশমি রুমাল আন্দোলন” (Silk Letter Movement) পরিচালনা করেন। এটি ছিল ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে একটি গোপন বিপ্লবী আন্দোলন, যার মাধ্যমে বিভিন্ন স্থানে বিদ্রোহ সংগঠিত করার পরিকল্পনা করা হয়েছিল।
৩. জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ ও অসহযোগ আন্দোলন
১৯১৯ সালে দেওবন্দের আলেমরা “জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ” সংগঠন গঠন করেন, যা মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিল। এই সংগঠন ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে অহিংস প্রতিবাদ এবং স্বরাজের পক্ষে জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
৪. খিলাফত আন্দোলনে ভূমিকা
দেওবন্দের আলেমরা খিলাফত আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে ব্রিটিশ বিরোধী গণআন্দোলনকে আরো শক্তিশালী করেন। মাদ্রাসার অনেক ছাত্র ও শিক্ষক এই আন্দোলনে জড়িত ছিলেন।
৫. মৌলানা হুসাইন আহমদ মাদানীর নেতৃত্ব
দেওবন্দের অন্যতম প্রধান আলেম মৌলানা হুসাইন আহমদ মাদানী ভারতীয় জাতীয়তাবাদকে সমর্থন করেন এবং হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের ওপর জোর দেন। তিনি ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন এবং স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেন।
৬. শিক্ষা ও আদর্শিক আন্দোলন
দেওবন্দ মাদ্রাসা শিক্ষার মাধ্যমে জাতীয়তাবাদী চেতনা তৈরি করে এবং ইসলামের আলোকে স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্য আলেমদের প্রস্তুত করে। এটি ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে মতাদর্শগত ও নৈতিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সহায়ক হয়। দেওবন্দ মাদ্রাসার আলেমরা শুধুমাত্র ধর্মীয় শিক্ষায় সীমাবদ্ধ ছিলেন না, তারা ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সক্রিয় সৈনিক ছিলেন। তাদের আত্মত্যাগ, বুদ্ধিবৃত্তিক অবদান ও রাজনৈতিক আন্দোলন ব্রিটিশদের ভারত থেকে বিতাড়িত করার সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
পরিশেষে বলা যায়ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে ভারতীয় মুসলিমদের অবদান অবিস্মরণীয়। তাঁরা শুধু রাজনীতির মাধ্যমে নয়, বিপ্লবী কর্মকাণ্ড, অসহযোগ আন্দোলন, সমাজ সংস্কারসহ নানা দিক থেকে স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তাঁদের আত্মত্যাগ ও সংগ্রামের ফসল হিসেবে ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীনতা লাভ করে। আজও তাঁদের এই অবদান ভারতীয় ইতিহাসে গৌরবময় অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে।