পড়াশোনার রাস্তাটা মাঝপথেই থমকে গিয়েছিল, কিন্তু থেমে থাকেনি স্বপ্নের উড়ান। মুর্শিদাবাদের কান্দির চাটরা গ্রামের সেই সাধারণ ছেলেটি আজ কলকাতার উদ্যোক্তাদের ভিড়ে নিজেকে আলাদাভাবে চিনিয়ে দিয়েছেন। তিনি কাজি মহসিন আজিম, সবার পরিচিত সুমন নামে। পড়াশোনা নয়, সৎ পথে অর্থ উপার্জন আর মানুষের পাশে দাঁড়ানোর তীব্র বাসনাই তাঁকে করে তুলেছে একজন সফল উদ্যোগপতি।
১৯৯২ সালের ৬ জানুয়ারি মুর্শিদাবাদের কান্দি থানার চাটরা গ্রামে এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম সুমনের। বাবা কাজি আদলে আজিম ওরফে ইদু মিঞা আর মা মমতাজ বেগমের মধ্যবিত্ত সংসারে বড় হওয়া সুমন ছোট থেকেই একটু অন্যরকম ছিলেন। পড়াশোনা করতেন ঠিকই, কিন্তু মন পড়ে থাকত অন্য কোথাও- যেখানে সাফল্যের আকাশ ডানা মেলে ডাকছে।



চাটরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে হাতেখড়ি। এরপর গোকর্ণ প্রসন্নময়ী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক (২০০৭) ও উচ্চ মাধ্যমিক (২০০৯) পাশ করেন। কিন্তু সেই পড়াশোনা যেন হৃদয়ের তৃষ্ণা মেটাতে পারছিল না। কান্দি বিমলচন্দ্র ল কলেজে ভর্তি হয়ে প্রথম সেমেস্টার পরীক্ষা দিয়েই বুঝলেন, বইয়ের পাতায় যতটা সময় দিচ্ছেন, তার চেয়ে বেশি সময় দিচ্ছেন স্বপ্নের রঙিন ক্যানভাস আঁকায়।
ব্যাঙ্গালোরে পড়তে গেলেন, কিন্তু সেখানে ঘোরাঘুরি করেই দিন কেটে গেল বেশি। আবার ফিরলেন বাড়ি। এরপর কান্দি রাজ কলেজে বিপিএড কোর্সে ভর্তি হলেন। কিন্তু কিছুদিন পর ফের কলেজ ছেড়ে দিয়ে শুরু করলেন কম্পিউটার হার্ডওয়ার ও নেটওয়ার্কিংয়ের উপর পড়াশোনা। মোবাইল রিপেয়ারিং কোর্সও করলেন। তবু মন ভরল না। যেন মনে হচ্ছিল, কাগজের সার্টিফিকেট নয়, জীবনগাথা লিখতে হবে অন্যভাবে।
চাচা মেরু মিঞার একটি কথা সুমনের জীবনে নতুন অর্থ এনে দিল। চাচা বলেছিলেন,“আমাদের পূর্বপুরুষরা বড় জমিদার ছিল, আমরা সব সময় মানুষের পাশে থেকেছি। তোকেও বড় হতে হবে।” এই কথাই যেন সুমনের ভেতরে আগুন জ্বালিয়ে দিল। বুঝলেন, বইয়ের পাতা দিয়ে নয়, কাজ দিয়েই বড় হতে হবে।
২০০৯ সালে কম্পিউটার আর মোবাইল রিপেয়ারিংয়ের কাজ শুরু করলেন। পরের বছরই তৈরি করলেন কম্পিউটার ট্রেনিং ইনস্টিটিউট। কিন্তু বছর খানেক চালিয়ে বুঝলেন, শুধু এটুকুতে তাঁর স্বপ্ন পূরণ হবে না। আরো বেশি ইনকাম করতে হবে, আরো বেশি মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে।
২০১৩ সালে শুরু করলেন পাক্ষিক পত্রিকা ‘বঙ্গদূত’। কিন্তু পত্রিকার ব্যবসা যেন পয়সার বদলে কেবলই খরচ নিয়ে আসছিল। বাবা বললেন, “এত টাকা খরচ করে লাভ কী?” সুমনের মাথায় তখন নতুন স্বপ্নের আলো জ্বলছে। বুঝলেন, আরো বড় কিছু করতে হবে।

টিডিএন বাংলার সঙ্গে গল্প করতে করতে মহসিন আজিম সুমন স্মৃতির অলিগলি ধরে হারিয়ে গেলেন ছোটবেলায়। কথা বলতে বলতে হঠাৎই চোখের কোনায় একটুখানি জল চিকচিক করে উঠল। তিনি বললেন, "একদিন ছোটবেলায় বড় দুষ্টুমি করেছিলাম। চামটি হাতে নিয়ে পাখি মারতে গিয়েছিলাম… ঠিক পাখি নয়, তখন তো মনে হয়েছিল খেলায় মেতেছি। কিন্তু যখন সেই পাখিটা মাটিতে পড়ে নিথর হয়ে গেল, তখন বুঝলাম এটা খেলা নয়, এটা একটা প্রাণের শেষ।"
একটু থেমে তিনি গভীর নিশ্বাস ফেললেন। “সেদিন পাখিটার ছোট্ট দুটো চোখের দিকে তাকিয়ে মনে হয়েছিল, আমি কী করলাম! আজো সেই পাখিটার কথা মনে পড়ে। বুকের ভেতরটা কেমন করে ওঠে। বুঝতে পারি, এইভাবে একটা প্রাণ কেড়ে নেওয়া ঠিক হয়নি।”
টিডিএন বাংলার সংবাদদাতার সামনে বসে তিনি যেন নিজের ছোটবেলাকে আবার চোখের সামনে দেখতে পেলেন। “শিখেছি সেইদিন থেকেই, কোনো প্রাণই ছোট নয়। ওদেরও বাঁচার অধিকার আছে। আজো সেই পাখিটার স্মৃতি আমাকে শেখায়- দয়া করতে, ভালোবাসতে।”
২০১৪ সালে পাসপোর্ট করে সুমন রওনা দিলেন সৌদি আরবের রিয়াদে। সেখানে গিয়ে মোবাইল ও কম্পিউটার সেল সার্ভিসের ব্যবসা শুরু করলেন। নতুন দেশ, নতুন পরিবেশ- কিন্তু সুমনের লক্ষ্য একই। অর্থ উপার্জন করতে হবে সৎ পথে, আর সেই অর্থ কাজে লাগাতে হবে মানুষের কল্যাণে।

আঠারো মাস পর দেশে ফিরলেন সুমন। তবে এবার আর গ্রামের ঘরে ফেরার ইচ্ছে হলো না। চোখে তখন নতুন স্বপ্ন- ব্যবসা করতে হবে বড় মাপের। ২০১৬ সালে কলকাতায় শুরু হলো তাঁর নতুন পথচলা।
তারপর আর পিছনে তাকাননি। দিনরাত এক করে পরিশ্রম শুরু করলেন। তিল তিল করে গড়ে তুললেন EME একাডেমি। সঙ্গে শুরু করলেন ‘ এক নজরে ‘ নামে মাসিক পত্রিকা।
উদ্দেশ্য ছিল স্পষ্ট- গ্রামের ছেলেমেয়েদের দক্ষতার প্রশিক্ষণ দিয়ে চাকরির উপযোগী করে তোলা। অনেকেই যাঁরা ভালো রেজাল্ট করেও চাকরি পাচ্ছিল না, সুমনের প্রতিষ্ঠান থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে তাঁরা চাকরি পেতে শুরু করলেন। গরিব ঘরে আলো জ্বলল, পরিবারে ফিরল হাসি।
সুমন জানালেন, “আমাদের এখান থেকে পাঁচ হাজারের বেশি ছেলেমেয়ে চাকরি পেয়েছে। এটা আমার জীবনের সবচেয়ে বড় সুখ।”
সুমন উপার্জিত টাকা কাজে লাগাতে চান সমাজের কল্যাণে। তাই ব্যবসা থেকে আয় করা অর্থের বড় অংশ খরচ করছেন সমাজের উন্নতিতে। সুমন টিডিএন বাংলাকে বললেন, “আমার ব্যবসার মূল উদ্দেশ্য মানুষকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।”
আরো বড় কাজের ইচ্ছে আছে সুমনের। ভবিষ্যতে শিল্প কলকারখানা করার পরিকল্পনা রয়েছে, যাতে আরো বহু ছেলেমেয়ে কাজ পায়। পাশাপাশি দরিদ্র ছাত্রছাত্রীদের জন্য একটি মিশন করার ইচ্ছাও আছে তাঁর।

ব্যবসার সঙ্গে বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলনে তিনি অংশ নেন। ওয়াকফ ইস্যুতেও পথে নামতে দেখা গেছে।
খাওয়া-দাওয়া নিয়ে তেমন কোনও বিলাসিতা নেই সুমনের। খিদে পেলে যা সামনে পান তাই খান। শখ বলতে ক্রিকেট খেলা আর বই পড়া। তবে ব্যবসার জন্য অনেক বেশি ঘোরাঘুরি করতে হয়, আর এই ঘোরাঘুরিতে তাঁর দারুণ আনন্দ।
বাবা মায়ের জন্য কতটা সময় দেন? সুমনের জবাব, এটা অত্যন্ত দুঃখের যে তেমনভাবে সময় দিতে পারিনি। আমার মনে হয়েছে, বাবা মায়ের স্বপ্ন, সমাজের স্বপ্নের কথা ভেবে আরো বেশি পরিশ্রম করতে হবে। একদিন সবার সঙ্গে দেখা হবে, অনেক আড্ডা হবে, তবে মাঝে মাঝে গ্রামের বাড়ি যাই। কিন্তু আমার সমাজের জন্য অনেক কাজ বাকি, তাই বেশি ঘোরাঘুরি, আরাম আয়েশ না করে শুধু কাজ আর কাজ করে যাচ্ছি। শৃঙ্খলার মধ্যে থেকে কাজের সফলতা পেয়েছি। আপনারা দোয়া করবেন, যেন আরো বড় ব্যবসায়ী হতে পারি আর সেই টাকা সমাজের জন্য খরচ করতে পারি।

শ্যামলা রঙের, পাঁচ ফুট তিন ইঞ্চি লম্বা সেই অচেনা গ্রামের ছেলেটি আজকের দিনে কলকাতার ব্যবসায়ীদের ভিড়ে আলাদাভাবে পরিচিত। কাজি মহসিন আজিম শুধু একজন সফল উদ্যোগপতি নন- একজন স্বপ্নবাজ মানুষ, যিনি সাফল্যকে শুধু নিজের জন্য নয়, সমাজের জন্য উৎসর্গ করেছেন।
তিনি প্রমাণ করে দিয়েছেন, পড়াশোনার সার্টিফিকেট নয়, সাফল্যের আসল মাপকাঠি হলো পরিশ্রম, সততা এবং সমাজের জন্য কিছু করার ইচ্ছা। নিজের কথা বলতে গিয়ে সুমন বলেন,“শৃঙ্খলা আর পরিশ্রমই আমার সফলতার মূল চাবিকাঠি। আপনারা দোয়া করবেন, যেন আরো বড় ব্যবসায়ী হতে পারি আর সেই টাকা সমাজের জন্য খরচ করতে পারি।”