নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর শৌর্য,বীরত্ব,দেশপ্রেম এবং আত্মত্যাগ নিয়ে নেতাজি বিশেষজ্ঞরা অনেক কথা বলেন! কিন্তু সুভাষচন্দ্র বসুকে নেতাজি হিসেবে যিনি তৈরি করেছিলেন এবং সুভাষচন্দ্র বসু যাঁকে রাজনৈতিক গুরু মেনে ছিলেন! সেই সর্বস্ব ত্যাগী বিপ্লবী দেশপ্রেমিক মাওলানা ওবাইদুল্লাহ সিন্ধির সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের বিষয়ে নেতাজি গবেষকদের সচেতন উদাসীনতা আমাদের বিস্মিত এবং ব্যথিত করে!
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে উলামায়ে কেরামদের অবদান পুস্তকে ঐতিহাসিক সুপ্রকাশ রায় লিখেছেন,“নেতাজীকে যিনি পূর্ণ স্বাধীনতার মন্ত্রে দীক্ষিত করেছেন তিনি হলেন ওবাইদুল্লাহ সিন্ধী। তিনিই নেতাজীর নাম দিয়েছিলেন মাওলানা জিয়াউদ্দীন। তিনিই ছদ্মবেশে প্রথমে কাবুলে তারপর বিভিন্ন দেশে পাঠান।”
মাওলানা ওবাইদুল্লাহ সিন্ধী এটা বুঝতে পেরেছিলেন যে বৈদেশীক আক্রমণের মাধ্যমেই ব্রিটিশদের এদেশ থেকে তাড়ানো সম্ভব। তাই তিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধকে হাতিয়ার বানিয়ে তুরস্কের সাহায্য নিয়ে ব্রিটিশ ভারত আক্রমণ করার পরিকল্পনা করেছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ বিশ্বাসঘাতকদের ষড়যন্ত্রে সব পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়। তাই ওবাইদুল্লাহ সিন্ধী চেয়েছিলেন আবার বৈদেশীক আক্রমণের মাধ্যমেই ব্রিটিশ ভারকে আক্রমণ করতে। কিন্তু এটা তাঁর পক্ষে আর দ্বিতীয়বার করা সম্ভব ছিল না এবং সেরকম কোন পরিস্থিতিও ছিল না। তাই তিনি এই কাজ করার জন্য নির্বাচন করেছিলেন সুভাসচন্দ্র বসুকে।মাওলানা ওবাইদুল্লাহ সিন্ধী দুরদর্শী রাজনীতিবিদ ছিলেন বলেই তিনি সুভাসচন্দ্র বসুকে চিনতে পেরেছিলেন।
সুভাসচন্দ্র বসু যে ব্রিটিশদের কারাগারে নজরবন্দী থাকাকালীন মৌনব্রত পালন করেছিলেন, অসুখের ভান করে একাকী গৃহে অন্তরিন থাকার পথ অবলম্বন করেছিলেন,তার সব পরিকল্পনা ছিল মাওলানা ওবাইদুল্লাহ সিন্ধীর। দাড়ি-টুপি শোভিত কাবুলীওয়ালার ছদ্মবেশ ধারণ করে মাওলানা জিয়াউদ্দীন সেজে চোস্ত উর্দূ বলতে বলতে ব্যবসার নাম করে অতি সঙ্গোপনে গভীর রাত্রিতে ভাইপো শিশির কুমার বসুকে সাথে নিয়ে গাড়িতে করে আফগানিস্তানের বর্ডার পর্যন্ত জার্মানির উদ্দেশ্যে যে দুর্গম পথে পাড়ি দিয়েছিলেন তার সমস্ত পরিকল্পনা ছিল মাওলানা ওবাইদুল্লাহ সিন্ধীর।
দেশের জন্য সর্বস্বত্যাগী স্বাধীনতা সংগ্রামী দেশপ্রেমিক মাওলানা ওবায়দুল্লাহ সিন্ধী ছিলেন পাঞ্জাবের সিন্ধ প্রদেশের মানুষ!১৮৮৪ সালে মাত্র ১২ বছর বয়সে শাহ ইসমাইল শহীদ দেহলবী রহঃ এর প্রণীত গ্রন্থ ‘তুফহাতুল হিন্দ’ বা ‘হিন্দুস্থানের উপহার’ নামক গ্রন্থটি পড়ে ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হন।পরবর্তীতে ‘আহওয়াতুল আখেরাত’ নামক গ্রন্থটি পড়ে তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন।এই গ্রন্থটির লেখকের নাম অনুসারে নিজের নাম রাখেন ওবায়দুল্লাহ!১৮৯৯ সালে দারুল উলুম দেওবন্দে এসে রেশমি রুমাল আন্দোলনের নায়ক মাল্টার বন্দী খ্যাত দেশপ্রেমিক শায়খুল হিন্দ মাওলানা মাহমুদুল হাসান’র ছাত্র হন।১৯১৫ সালে ১লা ডিসেম্বর তিনি মাওলানা মাহমুদুল হাসান’র নির্দেশে কাবুল গিয়ে ব্রিটিশদের ভারত ছাড়া করার লক্ষ্যে বিদেশের মাটি থেকে ব্রিটিশদের উপর আক্রমণ শানাতে প্রবাসী ভারতীয়দের সংঘবদ্ধ করতে ঝাঁপিয়ে পড়েন এবং সেইসঙ্গে ব্রিটিশ বিরোধী দেশগুলির সাহায্য পাওয়ার আশায় কুটনৈতিকদৈত্য শুরু করেন!গুরু মাওলানা মাহমুদুল হাসানের মতো তিনিও সশস্ত্র সংগ্রামকে ভারতের স্বাধীনতা লাভের একমাত্র পথ বলে মনে করতেন! বিদেশের মাটিতে স্বাধীন ভারত সরকার গঠনে তৎপর হয়ে ওঠেন।
রেশমি রুমাল আন্দোলন প্রেক্ষাপটে ব্রিটিশ গোয়েন্দা রিপোর্টে লেখা হয়েছিল— ‘মুসলমান জাতির এক অংশ তখনও (১৯১৪ – ১৯১৫) ইংরেজদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র আন্দোলনে লিপ্ত ছিল। জেহাদি আন্দোলনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছাড়াও আরও এক দল মুসলমান বিদেশি রাষ্ট্র কাবুল ও তুরস্কের সহায়তায় ইংরেজ বিতাড়নের ষড়যন্ত্র করছিল। তাদের নেতা ছিলেন দেওবন্দ মাদরাসার মাওলানা ওবায়দুল্লাহ ও তার সহকর্মী মাওলানা মাহমুদ হাসান (শায়খুল হিন্দ)। তারা হেজাজ ও কাবুলে উপমহাদেশীয় মুসলিম প্রবাসীদের সহায়তায় ও কাবুলের আমিরের সাহায্যে বিদ্রোহ ষড়যন্ত্র করেছিলেন।’ (Sedition Committee Report, P. 174)
ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস, জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ এবং মওলানা আবুল কালাম আজাদ, মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানি ও মওলানা গোলাম রসুল মেহের প্রমুখের মতো বিশেষ ব্যক্তিবর্গ ১৯৩৬ সালে ইংরেজ সরকারের কাছে আবেদন করেন মাওলানা সিন্ধিকে দেশে ফিরিয়ে আনতে!শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশ সরকার চাপে পড়ে বাধ্য হয়ে এই মহান বিপ্লবী স্বাধীনতা সংগ্রামীকে ১৯৩৮ সালের ১নভেম্বর দেশে ফেরার অনুমতি প্রদান করে।
ভারতের প্রথম স্বাধীন সরকার ‘হুকুমত এ আজাদ হিন্দ’ গড়ে উঠেছিল 1915 সালের 1 ডিসেম্বর আফগানিস্তানের কাবুলে! বিদেশের মাটিতে গড়ে ওঠা প্রথম স্বাধীন ভারত সরকারের রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন রাজা মহেন্দ্র প্রতাপ! এই সরকারের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন মাওলানা বরকতুল্লাহ ভূপালী, স্বরাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ছিলেন মাওলানা ওবায়দুল্লাহ সিন্ধি, বিদেশ মন্ত্রী ছিলেন ড. চম্পকরমন পিল্লাই, সমর বিষয়ক মন্ত্রী ছিলেন মাওলানা মহম্মদ বশির এবং যোগাযোগ মন্ত্রী ছিলেন মাওলানা রহমত আলী জাকারিয়া!এই স্বাধীন সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য মাওলানা ওবায়দুল্লাহ সিন্ধি তুরস্ক, রাশিয়া ও জাপানের সাথে যোগাযোগ করেন।আফগান সরকারকে তীক্ষ্ণ বুদ্ধি ও ব্যক্তিত্বের দ্বারা প্রভাবিত করেন এবং ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার অনুরোধ জানান। ব্রিটিশ শাসিত ভারতের সাথে ১৯১৯ সালে আফগানিস্তানে সেই সময় ক্ষমতাসিন আমানুল্লাহ খানের সঙ্গে যুদ্ধ বাঁধলে তিনি আফগানদের পক্ষ অবলম্বন করেন এবং ‘জুনুদুল্লাহ’ নামে নিজস্ব বাহিনী যুদ্ধে প্রেরণ করেন। মাওলানা ওবায়দুল্লাহ সিন্ধীর আশ্চর্য্য কূটকৌশলে আফগানরা এই যুদ্ধে ব্রিটিশদের পরাস্ত করে জয়লাভ করে এবং স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত হয়। মাওলানা ওবায়দুল্লাহ সিন্ধীর আশ্চর্য্য দুরদর্শীতার ফলে এই সফলতা অর্জন সম্ভব হয়।এই যুদ্ধে প্রায় ১৭০০ ব্রিটিশ সৈন্য মারা পড়েছিল।ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত হামফ্রে বলতে বাধ্য হন,“এ জয় আফগানিস্তানের নয় এ জয় ওবায়দুল্লাহর জয়।”পরবর্তীতে আন্তর্জাতিক চাপের কাছে আফগানিস্তান সরকার নতি স্বীকার করায় তাঁকে বাধ্য হয়ে কাবুল ছাড়তে হয়! কিন্তু তিনি হতাশ না হয়ে নতুন করে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রাম সংগঠিত করার লক্ষ্যে 1922 সালের অক্টোবর মাসে রাশিয়ার পথে যাত্রা করেন!
১৯২৩ সালে মাওলানা সিন্ধি রাশিয়া থেকে তুরস্কের আঙ্কারায় যান। সেখানে চার মাস থাকেন। তুরস্কে অবস্থানকালীন ইসমত পাশা, রউফ বেক প্রমুখ বিপ্লবীদের সাথে তার সাক্ষাৎ হয়। এরপর রাজধানী ইস্তাম্বুলে পৌঁছে তিন বছর অবস্থান করেন। এই সময় ইউরোপের ইতিহাস খুব মনোযোগের সাথে পড়েন।
বিশেষ করে অটোমান শাসনামল, গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা, ঔপনিবেশিক শক্তি ব্রিটেন ও ফ্রান্সের উত্থান— এসবের ওপর খুব মনোযোগ দেন।
১৯২৪ সালের ডিসেম্বরে ইস্তাম্বুল থেকে ‘স্বাধীন ভারত উপমহাদেশের সংবিধানের খসড়া’ শিরোনামে ভারতের ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রনীতির গঠনপ্রণালী প্রণয়ন করেন। যার মূল পয়েন্ট ছিল :
(১) ভারত উপমহাদেশের অধিকাংশই জাতিরাষ্ট্র। এর বেশিরভাগ অঞ্চলের ভাষা সংস্কৃতি ভূ-প্রকৃতি ও জাতি আলাদা, তাই এখানে ডোমিনিয়ন স্টেট কায়েম করতে হবে। এমনকি কোনো জাতির সদস্য সংখ্যা পূর্বকালের মতো পাঁচ-ছয় শ জন হয়ে যায়, তবুও।
(২) ওই রাষ্ট্রগুলো স্বায়ত্তশাসিত হবে।
(৩) শাসনব্যবস্থা যুক্তরাষ্ট্রতন্ত্রের নিয়মে হবে।
(৪) যুক্তরাষ্ট্র-সরকারের কাছে কেবল প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র নীতি, মৈত্রীচুক্তির অধিকার থাকবে।
(৫) ‘সব মানুষ সমান’ নীতিতে শিক্ষাব্যবস্থা মাতৃভাষায় এবং নিজস্ব লিখনরীতিতে হবে।
(৬) ধর্ম-বর্ণ-জাতি নির্বেশেষে প্রত্যেক নাগরিকের মাধ্যমিক পর্যন্ত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেওয়া বাধ্যতামূলক হবে।
(৭) সব নাগরিকের প্রাথমিক পর্যায়ের সামরিক প্রশিক্ষণ (NCC) বাধ্যতামূলক হবে।
(৮) উর্দু সব জাতিরাষ্ট্রের সরকারি ভাষা হবে।
(৯) আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ইংরেজি হবে সরকারি ভাষা।
(১০) প্রত্যেক জ্ঞানসম্পন্ন প্রাপ্তবয়স্ক নর-নারীর ভোট দেওয়ার অধিকার থাকবে।
(১১) কৃষক, কায়িক শ্রমিক, মেধাশ্রমিক, ব্যবসায়ী এবং কলখারখানার মালিকদের নিজ নিজ বিষয়ে লাভ-ক্ষতির সঠিক পরিমাণ পার্লামেন্ট সদস্যদের প্রত্যেক বৈঠকে উপস্থাপন করতে হবে, যেন পরিদর্শক সে-বিষয়ের কাজ করতে পারেন, এবং ক্রমশ দেশকে উন্নতির দিকে নিয়ে যেতে পারেন। (ইমামে ইনকিলাব হজরত মওলানা ওবায়দুল্লাহ সিন্ধি)
১৯২৬ সালের জুন মাসে মাওলানা সিন্ধি ইতালি ও সুইজারল্যান্ড হয়ে শেষমেশ সুলতান ইবন সৌদের আমলে হিজাজে গিয়ে পৌঁছান। আগস্ট মাসে তিনি মক্কায় অবস্থান গ্রহণ করেন, এবং আবার শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করেন।
১৯৩০ সালে শাহ ওলিউল্লাহ দেহলবির চিন্তাদর্শন বাস্তবায়নে যাঁরা চেষ্টাশ্রম ও সংগ্রাম করেছেন তাঁদের ওপর আরবি ভাষায় ‘আত তামহিদ লি আইম্মাতিত তাজদিদ’ নামে একটি কিতাব লেখেন। তারপর ‘শাহ ওলিউল্লাহ রুকআত’ বা পত্রাদির একটি ভূমিকা লেখেন।
১৯৩৭ সালে মক্কায় নির্বাসিত তুর্কি আলেম মুসা জারুল্লাহ মওলানা সিন্ধির তফসির সংকলন করে প্রকাশ করেন। (ই.ফা.বা., ইসলামী বিশ্বকোষ)
১৯৩৯ সালের জানুয়ারিতে তিনি পাসপোর্ট হাতে পান। তারপর হজ আদায় করে প্রায় পঁচিশ বছরের নির্বাসন শেষে মার্চের ৭ তারিখে মাওলানা সিন্ধি করাচি বন্দরে এসে পৌঁছান।
সুদীর্ঘ প্রবাস-জীবনের কত কথাই-না দেশবাসীকে বলার ছিল!দেশে ফিরে সেসব কথা বলার জন্য ব্যাকুল হলেন। কিন্তু তাঁর কথা মানুষের মনঃপুত হলো না। অথচ তাঁরা জানত না মাওলানার জীবনে কত তিক্ত অভিজ্ঞতা এবং সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগানো কত যে জরুরি ছিল।
তিনি বলেছিলেন, ‘তোমরা এ যে খেলনার ঘর তৈরি করেছ এবং একেই আসমান বলে বিশ্বাস করে নিয়েছ, কালের প্রবাহের মুখে এ টিকে থাকতে পারবে না। তোমাদের সভ্যতা-সংস্কৃতি, তোমাদের সমাজ, তোমাদের চিন্তাধারা, তোমাদের রাজনীতি এবং তোমাদের অর্থনীতি— সবকিছুর মধ্যে ঘুণ ধরেছে। তোমরা একেই ইসলামি সভ্যতা নাম দিয়েছ!কিন্তু এতে ইসলামের কোনো চিহ্ন নেই। তোমরা তোমাদের গোঁড়ামিকেই ধর্মের নামে চালিয়ে নিচ্ছ। মুসলমান হতে চাও তো ইসলাম কী আগে বোঝ। তোমরা যাকে ইসলাম বলছ ইসলামের সাথে তার কোনো সম্পর্ক নেই। তোমাদের নেতৃবৃন্দ পদমর্যাদালোভী। তোমাদের শাসকবৃন্দ ভোগবিলাসী এবং তোমাদের জনসাধারণ বিভ্রান্ত। জাগো! পরিবর্তন আনো! নয়তো যুগ তোমাদের চিহ্ন পর্যন্ত মিটিয়ে দেবে।’ (শাহ ওয়ালীউল্লাহ ও তাঁর রাজনৈতিক চিন্তাধারা)
মাওলানা ওবায়দুল্লাহ সিন্ধী দেশের স্বাধীনতার জন্যে দীর্ঘ ২৫ বছর ব্রিটিশদের কারাগারে বন্দী জীবন কাটাতে বাধ্য হয়েছেন এবং সহ্য করেছেন অমানুষিক শারিরিক ও মানসিক যন্ত্রনা।মাওলানা মাহমুদুল হাসান মাল্টার জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার দশ বছর পর মাওলানা ওবায়দুল্লাহ সিন্ধীকে দেশের মাটিতে আনা হয়। যতদিন মাওলানা মাহমুদুল হাসান জীবিত ছিলেন ততদিন মাওলানা ওবায়দুল্লাহ সিন্ধীকে দেশে ফিরতে দেওয়া হয়নি। কারণ ব্রিটিশ বেনিয়ারা জানত মাওলানা মাহমুদুল হাসান ও মাওলানা ওবায়দুল্লাহ সিন্ধী একত্রে থাকলেই ব্রিটিশদের কাছে এক বড় বিপদ। মাওলানা ওবায়দুল্লাহ সিন্ধীকে দেশে এনেও ব্রিটিশরা শান্তিতে থাকতে পারেনি। নপুংসকের মতো অশীতিপর বৃদ্ধ এই মহান দেশপ্রেমিক মাওলানাকে গ্রেফতার করে কারাগারে বিষ খাইয়ে হত্যা করে ইতিহাসে নিকৃষ্টতম কান্ড ঘটায় ব্রিটিশ শাসকরা।আমাদের দুর্ভাগ্য হলো আমাদের দেশের তথাকথিত ভাড়াটে দালাল ইতিহাসবিদরা সচেতনভাবে এই সমস্ত মানুষদের দেশের জন্য আত্ম বলিদান এর ইতিহাস কে আড়াল করে রেখেছেন!তাই দেশের বর্তমান প্রজন্মের মানুষজন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর দেশপ্রেমের কথা জানেন কিন্তু তাঁর রাজনৈতিক গুরু মাওলানা ওবায়দুল্লাহ সিন্ধীর আত্মত্যাগের কথা জানতে পারেন না!
মাওলানা ওবায়দুল্লাহ সিন্ধীর স্বাধীনতা সংগ্রামের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে মাওলানা আবুল কালাম আজাদ মাওলানা জহীরুল হককে একটি চিঠিতে লেখেনঃ-স্নেহের মওলুবী জহীরুল হক,
আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহ
আজাদী উপলক্ষে আপনার প্রতি প্রেরিত পত্রের জন্য শুভেচ্ছা জানাই। পত্র পড়ে স্মৃতি-পটে ভাসে শুধু মওলানা উবাইদুল্লাহ সিন্ধীর স্মৃতি। সে ঘটনা অনেক লম্বা। সংক্ষেপে করলেও যথেষ্ট সময়ের প্রয়োজন। ১৯১৪ সালের বিশ্বযুদ্ধের সময় শাহ ওয়ালীউল্লাহর কাফেলার নেতা হযরত মওলানা মাহমুদুল হাসান রাঃ অত্যন্ত কঠিন পরিস্থিতিতে মওলানা ওবায়দুল্লাহ সিন্ধীকে কাবুল প্রেরণ করেন। সেখানে মওলানা ওবায়দুল্লাহ বিভিন্ন রাষ্ট্রে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে কাজ করবার সুযোগ লাভ করেন। তারমধ্যে জার্মান, ফ্রান্স ও জাপানের এমন সব কর্মী নেতা ছিলেন যাঁরা পরবর্তীকালে শাসন ক্ষমতার উচ্চ পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। ……
পঁচিশ বছর নির্বাসন দণ্ড ভোগ করে ১৯৩৯ এ তিনি যখন এখানে আসেন তখন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। তিনি তাঁর নিজস্ব পরিকল্পনা কংগ্রেসের কাছে পেশ করে সর্ব ভারতীয় সংগ্রামের প্রোগ্রাম রচনা করেন। সেই সময় গান্ধীজী পর্যন্ত ওই প্রোগ্রামের বিরোধীতা করেন। তাহলেও ‘ভারতছাড়ো’ আন্দোলনটুকু অনুমোদন লাভ করে।
দ্বিতীয় দফায় উথলা হতে দিল্লী পর্যন্ত আট মাইল সড়কের কোন একটি জন মানব শূন্য স্থানে তাঁর সঙ্গে সুভাষের দেখা হয়। তার পরের সাক্ষাৎটি হয়েছিল কলকাতার বালিগঞ্জ এলাকায়। এখানেই তিনি সুভাষকে জাপান যাত্রার জন্য রওনার ব্যবস্থা করেন। জাপান সরকারের নামে অন্তর্বর্তী কালীন সরকারের যাত্রী হিসাবে তিনি একটি পরিচয়পত্র দেন এবং সেখানকার প্রধান সেনাপতির নামে একটি ব্যক্তিগত বিশেষ বার্তা পাঠান। এই সুভাষ সেখানে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে জাপান সরকারের সৈন্য বিভাগ ও তাঁর প্রতি আস্থা স্থাপন করতে পেরেছিলেন। ……
শেষ পর্যন্ত ভয়ঙ্কর বিষ প্রয়োগে মওলানা সাহেবের জীবন শেষ করা হয়।
১৯৪৫ সালের ১লা সেপ্টেম্বর পুরো এক বছর ন’দিন পর সরকারী ভাবে স্বীকার করা হয় মওলানা সাহেব নিহত হয়েছেন। স্বাভাবিক এমনি একটি বিপ্লবীকে ওজনের তুলাদণ্ডের এক পাল্লায় রেখে অন্য পাল্লায় সারা পৃথিবী চাপালেও এই বিপ্লবীর সমান হয় না। ….আপনার সম্মানীয় মাতার প্রতি রইল আন্তরিক সালাম।
ইতি
আবুল কালাম আজাদ।
মাওলানা ওবায়দুল্লাহ সিন্ধী মাওলানা আবুল কালাম আজাদেরও আদর্শিক গুরু ছিলেন।
১৯৪১ সালের জানুয়ারিতে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু তার সান্নিধ্যে উপস্থিত হন। নেতাজি কংগ্রেসের মতো ইংরেজদের নীতিতে স্বাধীনতা চাচ্ছিলেন না, একই ভাবধারার নেতা ছিলেন মাওলানা সিন্ধিও। সুভাষচন্দ্র বসু বুঝেছিলেন নরমপন্থী কংগ্রেসের সাথে থেকে পূর্ণ স্বাধীনতা লাভ করা কখনো সম্ভব নয়। তাই তিনি চরমপন্থী নীতিকে অনুসরণ করে কংগ্রেস ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন।
সুভাষচন্দ্র বসু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান থেকে যে জাপানে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন তার মূলেও ছিল মাওলানা ওবায়দুল্লাহ সিন্ধীর পূর্ব অভিজ্ঞতা। মেজর হামিদের সহযোগিতা নিয়ে অতি গোপনে সাবমেরিনে চড়ে দেশ ত্যাগ করেছিলেন। বিদেশ যাওয়ার পথে মাওলানা ওবায়দুল্লাহ সিন্ধীর পরামর্শকে কাজে লাগিয়েছিলেন। মাওলানা ওবায়দুল্লাহ সিন্ধী গুরু মাওলানা মাহমুদুল হাসানের নির্দেশে মক্কা, হেজাজ, তুরস্ক প্রভৃতি দেশে সংগঠন তৈরী করে ভারতবর্ষকে স্বাধীন করতে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সরাসরি লড়াই সংগ্রামের পথ বেছে নিয়েছিলেন। অনুরূপভাবে সুভাষচন্দ্র বসুও জাপান, জার্মান, ফ্রান্স, কাবুল প্রভৃতি বিদেশী শক্তির সাহায্য নিয়ে ভারতকে ব্রিটিশ শাসন মুক্ত করতে বিদেশ থেকে সরাসরি লড়াই সংগ্রামের পথ বেছে নিয়েছিলেন। সুভাষচন্দ্র বসু বিদেশনীতির মূলেও ছিল মাওলানা ওবায়দুল্লাহ সিন্ধীর পরিকল্পনা। মাওলানা ওবায়দুল্লাহ সিন্ধী বৃটিশবিরোধী স্বাধীনতার লড়াইয়ে তাঁর পরিকল্পনা ও প্রস্তাব সুভাষচন্দ্র বসুকে যেমন দিয়েছিলেন, এবং তেমনি কংগ্রেসকেও দিয়েছিলেন।
মহাত্মা গান্ধীসহ তৎকালীন কংগ্রেস নেতৃত্ব তা গ্রহণ করেনি! কিন্তু সুভাষচন্দ্র বসু তাঁর রাজনৈতিক গুরু, মাওলানা ওবায়দুল্লাহ সিন্ধীর একান্ত অনুগত শিষ্য হিসেবে ভারতের মুসলিম বিপ্লবীদের মতো ইংরেজদের বিরুদ্ধে পূর্ণ স্বাধীনতার লড়াইকেই আমৃত্যু অনুসরণ করেছেন।বিপ্লবী স্বাধীনতা সংগ্রামী সত্যেন সেন তাঁর “ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে মুসলমানদের ভূমিকা” পুস্তকেকে লিখেছেন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে মুসলিমদের অবদানকে অবহেলা করে বিস্মৃতির তলায় চাপা দেওয়া এক জাতীয় অপরাধ!