রহমানের (আসল) বান্দা তারাই, যারা পৃথিবীর বুকে নম্রভাবে চলাফেরা করে, এবং মূর্খরা তাদের সাথে কথা বলতে থাকলে বলে দেয়, তোমাদের সালাম।
মাস্টার মুহাম্মদ মান্নাফ সাহেব ছিলেন আমাদের একান্ত ঘনিষ্ট আত্মীয়। ছোটো বেলা থেকে আমরা তাঁকে চাচাজি বোলে ডাকতাম। তিনি ছিলেন অসাধারণ ঠান্ডা মাথার মানুষ। জীবনে কখনো তাঁকে উত্তেজিত হয়ে বাজে আচরণ করতে দেখা যায়নি। একান্ত রেগে গেলে তিনি সেখান থেকে চলে যেতেন। তিনি যখন কোন মিটিং এ বসতেন অনেক সুদূর প্রসারী লক্ষ্য নিয়ে কথা বলতেন। যখন দেখতেন সিদ্ধান্ত উল্টো দিকে যাচ্ছে তখন স্পষ্ট বলে দিতেন এর মধ্যে আমি কোন কল্যান দেখছিনা, তোমরা যেটা ভালো মনে করবে করো।
বড় মাপের মানুষ জন তাঁকে জেনুইন জেন্টল ম্যান বা নিপাট ভদ্রলোক মনে করতেন। তিনি অতি সহজ সরল জীবন যাপন করতেন। তিনি গ্রামের মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। জমি জায়গা পুকুর খাল কম ছিলনা। তাছাড়া ছাত্র জীবন শেষ করতে না করতেই চাকরীতে জয়েন করে ছিলেন। ঢোলা হাইস্কুল সুন্দর বন এলাকার নামকরা স্কুল। সেই স্কুলের ডাক সাইটে অঙ্কের শিক্ষক। চাইলে জীবনটাকে অন্যভাবে সাজাতে পারতেন। কিন্তু তিনি জীবনটা কাটিয়েছেন একজন দরবেশের মত। ঢোলা হাই স্কুলের এক কোণে ছিল মাটির দেয়াল আর খড়ের ছাউনি দেওয়া একটা কুড়ে ঘর। চার দিকের দেওয়াল থেকে নোনা ধরা মাটি খসে পড়ত। মেঝেটাও ছিল মাটির। এটাই ঢোলা হাই স্কুলের বোর্ডিং রুম। তার এক কোণে সিট বেঞ্চের থেকে একটু চওড়া একটা তক্তাপশ। এটাই ছিল মান্নাফ সাহেবের জীবনের স্বর্ণ যুগ। চাকরি জীবনের প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর তিনি এখানে কাটিয়েছেন। এই ভাঙ্গা ঘরে বসে তিনি স্বপ্ন দেখে ছিলেন এক সুন্দর সমাজের, সুন্দর পৃথিবীর। চেয়েছিলেন সুশিক্ষা প্রাপ্ত একটি সভ্য শালীন ভদ্র সমাজ। এই সমাজ গড়ার টানে তিনি ছুটে বেড়িয়েছেন দিক বিদিক। একদিকে জামাআত কর্মীদের নিয়ে ঢোলায় গড়ে তুলছেন গুলিস্তানের মত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। অপর দিকে বাংলা ইসলামী প্রকাশনী ট্রাষ্টকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য ছুটছেন কলকাতায়। জাফর সাহেবের ইন্তেকালের পর তখন বিশাল শূন্যতা। এগিয়ে যেতে হলো মুহাম্মদ মান্নাফ সাহেবকে। তিনি মোটেই ব্যবসা জগতের লোক নন। কিন্তূ তাঁর নিষ্ঠা ও অমায়িক ব্যবহার সব দুর্বলতাকে ঢেকে দিয়ে প্রতিষ্ঠানে কাজের পরিবেশ ফিরিয়ে আনে। কয়েক বছরের মধ্যে অভাবনীয় উন্নতি লক্ষ্য করা যায়। তাফহীমুল কুরআন এর সেট, আদাবে জিন্দেগী, পথের সম্বল, ইত্যাদী গুরুত্ব পূর্ন বইগুলি সেই সময় প্রকাশিত হয়। সাপ্তাহিক মিজান ওয়েব মেশিনে ছাপা শুরু হয়। অফিসে কম্পিউটার নিয়ে আসা হয়। বাংলায় ইসলামের দাওয়াত পৌঁছে দেওয়ার জন্য নানান পরিকল্পনা গৃহীত হয়। বিভিন্ন পূজা মণ্ডপে বইয়ের স্টল লাগানো, কলকাতা বইমেলায় অংশ গ্রহন, জেলা বইমেলা গুলিতে অংশ গ্রহন করে গ্রামে গ্রামান্তরে ইসলামী সাহিত্য পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা হয়।
মরহুম কবি সুলতান আলী সাহেব অসাধারণ সমীহ করতেন মান্নাফ সাহেবকে। ব্যক্তিগত আলাপ চারিতায় তিনি প্রায়ই বলতেন নূরুল ইসলাম খান সাহেবের তীক্ষ্ণ ধী শক্তি, মান্নাফ সাহেবের অমায়িক ব্যবহার আর ডাক্তার রইসুদ্দিন সাহেবের মিষ্টি হাসির তুলনা হয়না।
আমার মনে পড়ছে বাংলা আসাম সম্মেলনের কথা। সম্মেলনের প্রথম দিন থেকেই যেন একটা উত্তেজনা ভাব। চারদিক থেকে ডেলিগেট আসতে শুরু করেছে যে কয়টি কাউন্টার খোলা হয়েছে তারা হাফিয়ে উঠছে। সামাল দিতে পারছেনা। চট জলদি মান্নাফ সাহেব উঠে পড়লেন কয়েক মিনিটের মধ্যে কাউন্টার অনেকগুলি বেড়ে গেল। প্রথম দিনের মধ্যেই সমস্ত হিসাব নিকাশ কমপ্লিট করে তিনি জমা করে দিলেন। কীভাবে সংকট মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নিতে হয় তা তিনি দেখলেন।
একবার মারকাজের এক দায়িত্ব শীল আমাকে বললেন, মান্নাফ সাহেব শিক্ষক মানুষ। ব্যাবসা বোঝেন এমন একজনকে বি আই পি টির দায়িত্ব দেওয়া উচিত। আমি তৎকালীন আমীর এ হালকা ডাক্তার রায়িসুদ্দিন সাহেবকে কথাটা বললাম। ডাক্তার সাহেব সেই ব্যাক্তির কাছে প্রস্তাব নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব আমাকে দিলেন। মান্নাফ সাহেব বিষয়টা শোনার পর বললেন এভাবে প্রস্তাব নিয়ে গেলে কোন আত্ম সম্মান বোধ সম্পন্ন ব্যক্তি তা গ্রহণ করবেননা। সত্যিই যদি তাঁকে দায়িত্ব দিতে হয় তাহলে আমি রিজাইন দিচ্ছি। আমার রিজাইন আপনি গ্রহণ করুন, তার পর মিটিং ডেকে সিদ্ধান্ত নিয়ে তারপর প্রস্তাব পাঠান। তিনি দেখালেন পদের প্রতি কত নির্লোভ ছিলেন তিনি। সেই সাথে সাথে পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে যে এটিকেট বজায় রেখে চলতে হয় তাও আমরা শিখলাম।
আমি তখন এস আই ওর দায়িত্বে। একটি সাংগঠনিক জটিলতায় আমীর এ হালকার সঙ্গে আমার দ্বিমত হয়। ডাক্তার সাহেব আমাকে অনেক বোঝালেন, আমি অনড়। পরদিন সকালে দেখি মান্নাফ সাহেব হাজীর। তিনি কোন ভূমিকা না করেই বললেন ডাক্তার সাহেব যেটা বলছেন সেটাই করো। আমাদের উপর তাঁর ব্যাক্তিত্বের প্রভাব এমন ছিলো যে না করতে পারলামনা।
তিনি বাসে কলকাতায় যেতে ভালো বাসতেন। আমি বলতাম ট্রেন তো বেশী আরাম দায়ক। তিনি বলতেন মাঝে মাঝে নেমে অনেকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করা যায়। যাতায়াতের পথে দাওয়াতী কাজ করতে করতে তিনি যেতেন।
ঢোলা এলাকায় একজন বিচ্ক্ষণ মানুষ হিসেবে তাঁর সমাদর ছিল প্রশ্নাতীত। এলাকার মানুষের পরিবারিক সালিশি করতে সব সময় তিনি ছুটে যেতেন। তিনি অনেক কিছুই আগাম অনুমান করতেন। কোন দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ার আগেই তিনি অনেক জায়গায় পৌঁছে যেতেন। কোথাও কোন গোলমাল হচ্ছে মানুষ যদি জানতে পারতেন মান্নাফ সাহেব সেখানে আছেন তাহলে তারা নিশ্চিন্ত হতেন। মান্নাফ সাহেব যখন আছেন কোন বড় খারাপ কিছু হবেনা।
১৯৯২সালে যখন বাবরী মসজিদ ভেঙ্গে ফেলা হলো চারদিকে প্রচণ্ড উত্তজনা। মান্নাফ সাহেব মুনীরুদ্দিন শাহ ও বাজারের অন্যদের নিয়ে চার মাথার মোড়ে মাইক লাগিয়ে বক্তব্য শুরু করলেন। এলাকার যত গুণীজন আসেন সবাইকে দিয়ে তিনি শান্তির আহ্বান জানালেন। বক্তব্য রাখতে থাকলেন ঈমাম, উলামা, পাদ্রী, পুরোহিত, রাজনৈতিক নেতা, প্রশাসনিক কর্তা ব্যক্তি সকলেই। ছুটে এলেন এস ডি ও , ডি এম। এই পরিস্থিতিতে কখন কী হয়ে যায়। মান্নাফ সাহেবের সঙ্গে কথা বলার পর তাঁরা আশ্বস্ত হলেন। বলে গেলেন ঢোলা নিয়ে আমরা নিশ্চিন্ত। যেখানে মান্নাফ সাহেবের মত মানুষ আছেন সেখানে আমরা ভরসা রাখতে পারি।
তিনি ছিলেন অতিথি বৎসল। সহজ সরল। নিজের কাজ সব সময় নিজেই করতেন। কেউ যখন বলতো এসব আপনি কেন করেন? অন্য কাউকে দিতে পারেননা? তিনি ছোট্ট করে বলতেন আমার ভালো লাগে। নিজের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত তিনি নিজের কষ্ট লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করেছেন। সব সময় খোঁজ নিয়েছেন অন্যের। তিনি ছিলেন সত্যিকারের মুমীন সুলভ মানুষ। আল্লাহ্ রববুল আলামীন তাঁকে ক্ষমা করে দিন। তাঁকে জান্নাতের মেহমান বানিয়ে দিন। আমীন।