সুমন ভট্টাচার্য, টিডিএন বাংলা: দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিজেপি শাসিত রাজ্য সরকারগুলির ‘বুলডোজার রাজ’কে রুখতে সুপ্রিম কোর্টের বুধবারের রায় শুধু যে ঐতিহাসিক তা নয়, ভারতবর্ষে মুসলিমদের নিশানা করে যেসব বৈষম্যমূলক আচরণ গেরুয়া শাসিত রাজ্যগুলিতে হচ্ছিল, তা থামানোর জন্য সবচেয়ে সদর্থক প্রয়াস। সুপ্রিম কোর্টের দুই বিচারপতি বি আর গাভাই এবং কে ভি বিশ্বনাথ বুধবার যে রায় দিয়েছেন, তা যে শুধু সংখ্যালঘুদের মনে আস্থা ফেরাবে তাই নয়, ভারতবর্ষের প্রান্তিক মানুষ, দরিদ্র মানুষ আবারও ভারতের সংবিধান এবং বিচারব্যবস্থার প্রতি আস্থা ফিরে পাবেন। সুপ্রিম কোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ বুধবার মনে করিয়ে দিয়েছেন, যে ‘এক্সিকিউটিভ’ অর্থাৎ শাসক কখনোই বিচারব্যবস্থার জায়গা নিয়ে নিতে পারে না। যদি কেউ অভিযুক্ত হয়, কিংবা তাঁর দোষ প্রমাণ হয়ে গেলেও তাঁর বাড়ি বুলডোজার দিয়ে ভেঙে দেওয়া পুরোপুরি ‘অসাংবিধানিক কাজ’। উত্তরপ্রদেশে যোগী আদিত্যনাথের সরকার এবং মধ্যপ্রদেশে শিবরাজ সিং চৌহানের সময় থেকে শুরু হওয়া ‘ট্রেন্ড’কে যদি আমরা মাথায় রাখি, তাহলে আমাদের মনে রাখতে হবে যে, কারও বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ উঠলেই, বা পুলিশ প্রশাসন কেউ কোনও অপরাধে জড়িত বলে মনে করলেই তাঁর বাড়ি যেভাবে বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়ার প্রবণতা মাথাচাড়া দিচ্ছিল, সুপ্রিম কোর্ট বুধবারের রায়ে তাকে পরিষ্কারভাবে ‘সংবিধান বিরোধী’ বলে চিহ্নিত করে দিয়েছেন। একইসঙ্গে যেসব সরকারি আধিকারিক এইভাবে মানুষের বাড়ি বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়ায় নেতৃত্ব দেবেন, তাঁদের বেতন থেকে টাকা কেটে নিয়ে গৃহহারাদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথাও সুপ্রিম কোর্ট বলেছেন।
সুপ্রিম কোর্টের এই রায় ঠিক সেই সময় এলো যখন ভারতবর্ষের দুটি রাজ্যে ঝাড়খণ্ডে এবং মহারাষ্ট্রে বিধানসভার নির্বাচন হতে চলেছে। আর সেই নির্বাচনে ভোট পাওয়ার লক্ষ্যে মরিয়া গেরুয়া শিবিরের নেতারা, এমনকি স্বয়ং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ পর্যন্ত যা যা বলছেন, তাকে বিরোধীরা পরিষ্কারভাবেই ‘অসাংবিধানিক’ আখ্যা দিচ্ছে। ঠিক সেই সময় সুপ্রিম কোর্টের দুই বিচারপতি বি আর গাভাই এবং কে ভি বিশ্বনাথের ডিভিশন বেঞ্চের রায় বলে দিল গেরুয়া শিবিরের নেতারা যে, নিজেদেরকে সংবিধান বা আদালতের বাইরে ‘সুপ্রিম অথরিটি’ বলে মনে করছিলেন, এবং ভক্তকুলও সেই প্রচার করে চলেছিল, তাকে সুপ্রিম কোর্ট কোনওভাবেই মান্যতা দেয় না। বরং ডিভিশন বেঞ্চ মনে করিয়ে দিয়েছে যে, সরকারকে মনে রাখতে হবে, কোথায় ‘এক্সিকিউটিভ’-এর দায়িত্ব শেষ হয় আর কোথায় বিচার ব্যবস্থার কাজ শুরু! উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থানের মতো বিভিন্ন রাজ্যে ‘বুলডোজার জাস্টিস’-এর নামে যে আসলে সংখ্যালঘুদের নিশানা করা হচ্ছে, সেই অভিযোগ তুলে বেশ কয়েকটি মুসলিম সংগঠন সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিল। তারই পরিপ্রেক্ষিতে বুধবার সুপ্রিম কোর্ট শুধু ঐতিহাসিক রায় দিল না, সংবিধানের ১৪২ তম ধারাকে অনুসরণ করে পরিষ্কারভাবে নীতিপ্রণয়ন করে দিল, কীভাবে এবং কোন কারণে কারও বাড়ি ভাঙা যাবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, গেরুয়া শিবিরের এই যে রাজনীতি, সংখ্যালঘুদের নিশানা করার প্রবণতা এবং ‘বুলডোজার রাজ’কে মহিমান্বিত করা, তার ছোঁয়া পশ্চিমবঙ্গেও এসে পৌঁছেছিল। বিচারপতি থাকার সময় অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গ সরকারকেও উত্তরপ্রদেশ থেকে বুলডোজার ‘ধার’ করে আনার পরামর্শ দিয়েছিলেন। আমরা সবাই জানি, সেই বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় শুধু পরবর্তীকালে বিজেপিতে যোগ দিয়ে সাংসদ হননি, টেলিভিশন ইন্টারভিউতে ‘গান্ধী না গডসে’— কাকে বেছে নিতে তিনি চাইবেন, সেই প্রশ্নের উত্তরেও তিনি দ্বিধা দেখিয়েছিলেন। অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গে ‘বুলডোজার রাজ’ চালু করতে চাওয়া অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় নিজে ‘গান্ধী এবং গান্ধীর হত্যাকারী’র মধ্যে কোনদিক ঝুঁকে, তা আমাদের বুঝে নিতে হবে।
কিন্তু বুধবারের সুপ্রিম কোর্টের রায় একেবারে পরিষ্কার করে দিল যে, যোগী আদিত্যনাথ, শিবরাজ সিং চৌহানের মতো নেতারা যে ‘ইনস্ট্যান্ট জাস্টিস’ বা তাৎক্ষণিক বিচারের দায়িত্ব পালন করে হাততালি কুড়োতে চাইছিলেন, তা কোনওভাবেই সংবিধান সম্মত নয়। অর্থাৎ, বুলডোজার দিয়ে কারও বাড়ি ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া, কোনও বিচার বা শাস্তি দেওয়ার পদ্ধতি হতে পারে না। সুপ্রিম কোর্টের দুই বিচারপতি মনে করিয়ে দিয়েছেন যে, কারও বাড়ি ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে এবং সেই বাড়ির মহিলা, শিশুরা রাস্তায় দাঁড়িয়ে কাঁদছেন, এটা হৃদয় বিদারক দৃশ্য। এবং যে-কোনও ব্যক্তির বাড়ি তাঁর অনেক দিনের স্বপ্ন বা চেষ্টার, পরিশ্রমের ফসল। শুধুমাত্র কোনও অপরাধের সঙ্গে কারও নাম জড়িয়ে গিয়েছে বলে, তাঁর বাড়ি পুলিশ বা প্রশাসন ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে পারে না। সুপ্রিম কোর্টের রায় আসার পরই যেমন কংগ্রেস সোচ্চারে এই রায়কে সমর্থন করে সংখ্যালঘু এবং প্রান্তিক মানুষদের ‘স্বার্থরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ’ বলে মন্তব্য করেছে, তেমনই স্বাগত জানিয়েছেন বাম নেত্রী বৃন্দা কারাত। দিল্লিতে বুলডোজার দিয়ে যখন সংখ্যালঘুদের বস্তি উচ্ছেদের চেষ্টা হয়েছিল, তখন আমরা এই বৃন্দা কারাতকেই দেখেছিলাম, তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে আদালতের থেকে স্থগিতাদেশ নিয়ে এসে প্রশাসনের ‘যথেচ্ছাচার’কে রুখতে। সুপ্রিম কোর্ট যেভাবে ‘বুলডোজার রাজ’কে অসাংবিধানিক বলেছেন, যেসব সরকারি অফিসাররা এই ধরনের কাজে যুক্ত থাকবেন তাঁদের বেতন থেকে ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার হুশিয়ারি দিয়ে দিয়েছেন, তা অবশ্যই গেরুয়া শিবিরের জন্য বড় ধাক্কা। কারণ গেরুয়া শিবির বা তাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ভারতবর্ষকে যে ‘পুলিশ রাষ্ট্র’-এ পরিণত করতে চান এবং সেখানে কেউ বিরোধিতা করলেই ইজরায়েলের কায়দায় বুলডোজার দিয়ে সেই বিরোধিতাকে গুঁড়িয়ে দিতে চান। এই দিন সুপ্রিম কোর্ট সেই প্রয়াসে জল ঢেলে দিলেন। ‘বুলডোজার রাজ’কেই পরিষ্কারভাবে অসাংবিধানিক বলে দিলেন।
গোটা পৃথিবী জানে প্যালেস্টাইনের ভূখণ্ডে ইজরায়েল কী অত্যাচার চালায়। প্যালেস্টিনিয়দের স্বাধীন রাষ্ট্রের আকাঙ্ক্ষাকে, ইজরায়েলের গায়ের জোরে জমি দখলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকে নেতানিয়াহুর সরকার ট্যাঙ্ক পাঠিয়েই গুঁড়িয়ে দিতে চায়। সেই ট্যাঙ্কের আঘাতে গুঁড়িয়ে যায় প্যালেস্টিনিয়দের বাড়ি, হাসপাতাল, স্কুল— সবই। ভারতবর্ষেও মুসলিমদের শায়েস্তা করতে গেরুয়া শিবির সেই একই পথে হেঁটে ‘বুলডোজার রাজ’ চালু করেছিল। সিএএ, এনআরসির বিরুদ্ধে যখন মুসলিমরা রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করেছেন, তখন সেই আন্দোলনের অনেক নেতার বাড়িই যোগী আদিত্যনাথের সরকার বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দিয়েছে। যোগী প্রশাসনের অজুহাত ছিল ওই মুসলিমদের বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগ রয়েছে। পরবর্তীকালে সেই একই ‘ধারা’ অনুসরণ শুরু হয় শিবরাজ সিং চৌহানের মধ্যপ্রদেশে এবং তারপরে হেমন্ত বিশ্বশর্মা শাসিত অসমে। সব ক্ষেত্রেই ‘বুলডোজার বিচার’-এ কোপ পড়ছিল সংখ্যালঘুদের ঘাড়ে। রাজনৈতিক এবং সামাজিকভাবে আরও তাৎপর্যের বিষয় ছিল বিভিন্ন রাজ্যের বিজেপি নেতারা এই ‘বুলডোজার রাজ’কেই ‘রোল মডেল’ হিসেবে তুলে ধরে নিজেদের মেরুকরণের রাজনীতিতে শান দিচ্ছিলেন। তাঁরা প্রচার করা চেষ্টা করছিলেন যে, ‘বেয়াড়া’ মুসলিমদের শিক্ষা দিতে এটাই সেরা পদ্ধতি। ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনে যোগী আদিত্যনাথ শাসিত উত্তরপ্রদেশে বিজেপির ভরাডুবির পরেও গেরুয়া শিবির এই বিষয়ে ‘শিক্ষা’ নেয়নি। কিন্তু এবার সুপ্রিম কোর্ট শুধু ‘বুলডোজার রাজ’কে অসাংবিধানিকই বলল না, কোন পরিস্থিতিতে এবং কীভাবে নোটিশ দিয়ে কারও বাড়ি ভাঙা যেতে পারে, বলে দিল দেশের সর্বোচ্চ আদালত। (লেখক বিশিষ্ট সাংবাদিক ও কলামিস্ট)