সাবের আলি কলেজ স্ট্রিটে পুরাতন বই ঘাটছিল। যদি ভালো কোন বই চোখে পড়ে যায়, আর মিলে যায় কম দামে! এভাবেই তো সে এর আগে “এ হিস্ট্রি অফ স্যারাসিনস” এর ইংলিশ ভার্সন পেয়ে গিয়েছিল একদিন। পেয়েছিল খুব কম দামে।
সে এসেছে সাপ্তাহিক “নতুন গতি” পত্রিকার বাৎসরিক সাহিত্যানুষ্ঠানে। একাই এসেছে। অনুষ্ঠান শুরু হবে বিকেল চারটায়। সে পোঁছে গেছে দশটার মধ্যে। এইটুকু সময় কলেজ স্ট্রিটে থাকবে। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের “চিলেকোঠার সেপাই” নজরে পড়ল। সে ঝুকে বইটা হাতে নিতে যাবে এমন সময় পেছন থেকে,,আচমকা কেউ একজন তার নাম ধরে ডাক দিলেন। সে পেছন ফিরে তাকাল।
আরেকবার তিনি বললেন, “সাবের না? মালদা?”
সাবের বলল, “আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে। আমি ঠিক আপনাকে চিনতে পারছি না। আগে কি কোথাও দেখা হয়েছিল?”
“তুমি সাবের তো? মালদা বাড়ি?”
“হ্যাঁ। কিন্তু…..”
“আমি আশরাফ মুন্সি।”
সাবের এমনভাবে আশরাফ মুন্সি উচ্চারণ করল যেন সে চেনার চেষ্টা করছে।
এখনও চিনতে পারেনি ভেবে আশরাফ সাহেব বললেন,”আলোকপুর হাসপাতালের ডাক্তার। এনামুল তোমার বন্ধু না?”
“এনামুল নামে আমার দুটো বন্ধু আছে। আপনি কার কথা বলছেন?”
শেষে হাল ছেড়ে দিয়ে আশরাফ সাহেব বললেন,”আচ্ছা, ঠিক আছে। তোমাকে সাবেরের মত মনে হল তাই!”
সাবের একটু হাসার চেষ্টা করল। কিন্তু হাসিটা ঠিকমত হল না। আশরাফ সাহেব চলে গেলেন।
সাবের তাঁকে ঠিকই চিনেছিল। একসময় এই আশরাফ সাহেব তার গুরু হয়ে উঠেছিলেন। দশ-বারো বছর আগের কথা।
একদিন সাবেরকে এনামুল বলল, “আলোকপুর হাসপাতালে একজন ডাক্তার এসেছেন। আশরাফ মুন্সি। খুব ভালো ব্যবহার। সারাদিন ডিউটি করেন। আউটডোর ছাড়াও সকাল-বিকাল চেম্বার করেন। কোন ফিজ নেন না। কেউ দু’-দশ দিলে রেখে দেন। তবে বেশি দিতে গেলে ফেরত দিয়ে দেন। রোগীরা তাকে ভীষণ শ্রদ্ধা করেন। সেখানকার লোকেদের কাছে তিনি রীতিমত হিরো বনে গেছেন।”
“তুমি এতকিছু জানলে কি করে?”
“দাদার কীরকম বন্ধু হয় । দাদাই বলেছে। দাদা তোমার-আমার কথাও তাঁকে বলেছে। বলেছে, আমরা নাকি বই পাগল।”
কথাটা শুনে আগ্রহ বাড়ল সাবেরের। সে যেন তাঁর সম্পর্কে আরো কিছু শুনতে চাই।
তার আগ্রহ দেখে এনামুল বলতে লাগল, “অল্প বয়স। সদ্য একটা ছেলে হয়েছে। হাওড়ায় বাড়ি। কলকাতায় বিয়ে করেছেন।”
“তুমি দেখেছো?”
“দেখেছি। আমাদের বাড়ি এসেছিলেন একদিন। লাইব্রেরি দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলাম। দেখে অত্যন্ত খুশি হয়েছিলেন।”
“আচ্ছা!”
” তার ক’দিন বাদে ডাক্তারবাবু অনেকগুলো বই পাঠিয়ে দিয়েছিলেন লাইব্রেরির জন্য। একদিন গিয়ে দেখে এসো।”
এনামুলের বাড়ি সাবেরের পাশের গ্রামে। তারা কয়েকজন মিলে একটা লাইব্রেরি করেছে। সাবের যথাসাধ্য তাদের সাথ দিয়েছে। সেও সেই লাইব্রেরির একজন বড় পাঠক। তারা সহপাঠী। সাবেরের দাদার সঙ্গে এনামুলের দাদার বন্ধুত্ব। ফলে ওদের পরিবারের সঙ্গে সাবেরের যথেষ্ঠ ঘনিষ্ঠতা।
একদিন ফোন এলো এনামুলের। অনুনয়ের সুরে বলল, “কাল ডাক্তারবাবু আসবেন আমাদের বাড়ি। আমি নিতে যাব ট্যাক্সি নিয়ে। যাবে আমার সাথে?”
“অবশ্যই যাব। কেন যাব না?” আমি যাওয়ার জন্য এক পায়ে খাড়া। এই অপেক্ষাতেই ছিলাম।
গিয়ে দেখি তিনি হাসপাতালে ডিউটি করছেন। প্রচুর রোগী। তিনি মনকাড়া হাসি দিয়ে আমাদের আপ্যায়ন করলেন। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর তিনি কোয়ার্টারে নিয়ে গেলেন। হাসপাতাল সংলগ্ন দুটি রুম। সেখানেই থাকেন পরিবার নিয়ে।
ভাবি চা-নাস্তা করালেন। সাবের-এনামুল ডাক্তার বাবুর ছেলেকে নিয়ে কিছুক্ষণ খেলল। রোগী দেখা হয়ে গেলে ডাক্তারবাবু এলেন এবং দ্রুত তৈরি হয়ে বেরিয়ে গেলেন।
তেইশ কিমি রাস্তা। আমি বসলাম সামনে। ওরা সবাই পেছনে। রাস্তায় কথা-বার্তা হয়ে থাকলো। এনামুলদের গ্রামের আগেই সাবেরদের গ্রাম। সাবের নেমে গেল। ওরা চলে গেল। যাওয়ার সময় সাবেরকে ডাক্তারবাবু বললেন, “আমাদের সঙ্গে গেলে হত না?”
সাবের লাজুক ভঙ্গিতে হাসল। বলল, “আপনি বরং ভাবিকে নিয়ে ফেরার সময় আসুন আমাদের বাড়ি।”
ডাক্তারবাবু এসেওছিলেন। একা। ভাবীদের আনেননি। হেঁটে চলে এসেছিলেন এনামুলকে সঙ্গে নিয়ে। সাবের ছিল না বাড়িতে। বড় দিদির বাড়িতে চলে যেতে হয়েছিল একটা কাজে।
তারপরেও বেশ ক’বার সাক্ষাৎ হয়েছে সাবেরের। কথাও হয়েছে ফোনে। তার দু’বছরের মাথায় ডাক্তারবাবু ট্রান্সফার নিয়ে চলে যান হাওড়ায়। একটা ভালোলাগা জন্মেছিল। জন্মেছিল শ্রদ্ধাবোধ। সেই টানেই মাঝে-মাঝে ফোন করত সাবের। কখনও রিসিভ হত, কথা হত। কখনও হত না। সেই কথা বলাও কমে গেল একসময়। সময় গড়িয়ে চলল আপন গতিতে।
সাবেরের যখন একটা ফুটফুটে মেয়ে হল, নার্সিংহোম থেকেই জনে জনে ফোন করে খবর দিতে লাগল পরিচিত সকলকে। সেই সূত্রেই ফোন লাগিয়েছিল ডাক্তার আশরাফ বাবুকে। তিনি ফোন ধরে বললেন, “কে বলছেন?”
“আমি সাবের।”
“কোথা থেকে?”
“বহরমপুর থেকে। এনামুলের বন্ধু।”
“কিছু বলবেন?”
“আমার মেয়ে হয়েছে।”
“ও আচ্ছা।”
নির্লিপ্ত এই উত্তরে দমে গেল সাবের। যে উচ্ছ্বাস নিয়ে সে ফোন করেছিল তা কোথায় মিলিয়ে গেল। কতক সময় পার হল। সাবের আর কিছু বলতে পারল না। আশরাফ সাহেবও কিছু জিজ্ঞেস করলেন না আর। ফোনটা কেটে গেল। তার শুধু মনে হতে থাকল, “বড়র পিরিতি বালির বাঁধ।”
সেদিন থেকেই আশরাফ সাহেবকে মন থেকে মুছে দিয়েছিল সাবের। তাই, আজ তাঁকে চিনতে পেরেও না চেনার ভান করে এড়িয়ে গেল সে। যে বাঁধ বালির, তাকে ভেঙে যেতে দেওয়ায় ভালো, জোর করে আটকে রাখার কোন প্রয়োজন নেই!