সৈয়দ তানভীর নাসরীন
বিবি ওম্মাতুল সালাম, আমজাদি বেগম, আমিনা তোইয়াবজি, সুফিয়া সোম— পরপর সারি সারি নাম, একাধিক স্মরণীয় নারীচরিত্র। ইতিহাস হয়তো যাঁদের কথা তেমনভাবে জানে না, বা যাঁদের কথা বলাও হয় না। যেমন ধরুন, আমজাদি বেগম স্বামীর সঙ্গে লন্ডনে রাউন্ড টেবিল কনফারেন্সে গিয়েছিলেন। গান্ধীজির ‘ইয়ং ইন্ডিয়া’ পত্রিকায় যাঁকে নিয়ে আলাদা নিবন্ধ লেখা হয়েছিল। স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য, দেশের জন্য তিনি ঠিক কত টাকা সংগ্রহ করেছিলেন, সেই হিসেব ‘ইয়ং ইন্ডিয়া’ও দিতে পারেনি। কিংবা সুফিয়া সোম, জাতীয় কংগ্রেসের মহিলা শাখার প্রধান, খান আবদুল গফফর খানের ভ্রাতুষ্পুত্রকে বিয়ে করেছিলেন। সেই বিয়ে আসলে সুফিয়ার নিজের সম্প্রদায় ভেঙে বেরিয়ে আসা এক সামাজিক বিপ্লব ছিল। যে বিপ্লবকে কুর্নিশ জানিয়ে চিঠি দিয়েছিলেন স্বয়ং মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী। কিংবা আমিনা তোইয়াবজি, গুজরাটের যে মুসলমান মহিলাকে গান্ধীজি তাঁর চরকা কমিটির প্রধান করেছিলেন। এরকম অসংখ্য নাম ছড়িয়ে আছে যে বইতে, সেই বইয়ের নাম ‘লহু বোলতা ভি হ্যায়’ বা ‘ব্লাডস স্পিকস টু’। সৈয়দ শাহনওয়াজ আহমদ কাদরির এই বই আসলে স্বাধীনতা সংগ্রামে মুসলমানদের ভূমিকার বিষয়ে আলোকপাত করে। সৈয়দ শাহনওয়াজ আহমেদ কাদরি একজন রাজনীতিক। কিন্তু ইতিহাসের অজানা যে অধ্যায়কে তুলে আনার ব্রত তিনি নিয়েছেন, তাকে কুর্নিশ না জানিয়ে উপায় নেই।
সৈয়দ শাহনওয়াজ আহমেদ কাদরির এই বই ‘লহু বোলতা ভি হ্যায়’, যার ইংরেজি অনুবাদের নাম ‘ব্লাড স্পিকস টু’, সম্প্রতি পড়ে আমি মুগ্ধ হয়ে গিয়েছি। দীর্ঘ সময় ধরে যাঁরা ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন, সেই সমস্ত অবিস্মরণীয় চরিত্রকে কাদরি সাহেব শুধু যে তুলে এনেছেন তা নয়, তাঁদের দুষ্প্রাপ্য ছবি তিনি নিজের সংকলনে নিয়ে এসেছেন। সেই তালিকায় যেমন আসফাকুল্লা খান আছেন, অরুণা আসফ আলির মতো বহু আলোচিত চরিত্ররা আছেন, তেমনই আছেন কত নাম না জানা চরিত্র।
বইটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল হিন্দি ভাষায়, কিন্তু তারপরে শাহনওয়াজ কাদরির সেই বই অনুবাদ হয়েছে উর্দুতে এবং পরবর্তীকালে ইংরেজিতেও। এই বই সম্পর্কে অবশ্য আমার খুব বেশি বলার দরকার নেই, যে বইয়ের ভূমিকা লেখেন রাজিন্দর সাচার, যে সাচার কমিটির রিপোর্ট গোটা ভারতবর্ষে মুসলমানদের অবস্থান নিয়ে হুলুস্থুল ফেলে দিয়েছিল। সেই বই যে মুসলিম জীবনে বা স্বাধীনতা সংগ্রামে মুসলমানদের ভূমিকার উপর আলাদা করে আলোকপাত করবে, তা বলাই বাহুল্য। এবং রাজিন্দর সাচার, ভারতবর্ষের মুসলমানরা যাঁকে চিরস্মরণীয় করে রাখবে, তিনি এই বইয়ের ভূমিকাতেও লিখেছেন, যে সৈয়দ শাহনওয়াজ আহমেদ কাদরির এই বই ইতিহাসের এক মাইলফলক হিসেবে থেকে যাবে। রাজিন্দর সাচার যে এই বিষয়ে বাড়িয়ে বলেননি, সেটা এই দীর্ঘ সংকলনকে দেখলেই বোঝা যায়। এই সংকলনে যেমন মুসলমান মহিলাদের নিয়ে আলাদা পরিচ্ছেদ আছে, যাঁরা স্বাধীনতা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন, তেমনই সিপাহী বিদ্রোহে ধরে ধরে নাম উল্লেখ করে বলা আছে কে কোন যুদ্ধে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন, এবং পরবর্তীকালে শহিদ হয়েছিলেন।
সৈয়দ শাহনওয়াজ আহমেদ কাদরি ব্যক্তিগত জীবনে রাজনীতিক এবং রাজনারায়ণের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন। উত্তরপ্রদেশে তিনি এখনও রাজানারায়ণ চর্চা কেন্দ্রেরই অন্যতম পথিকৃৎ। আমরা, যারা ভুলে গিয়েছি যে রাজনারায়ণ কে, তাদের মনে করিয়ে দেওয়া যাক গত শতকের সাতের দশকে যিনি ইন্দিরা গান্ধীর বৈধতাকে চ্যালেঞ্জ করে এলাহাবাদ হাই কোর্টে মামলা করেছিলেন এবং যে মামলায় ভারতবর্ষের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী হেরে যাওয়াই আসলে জরুরি অবস্থার সূচনা করেছিল। ভুলে গেলে চলবে না, যে রাজনারায়ণ ১৯৭৭ সালে রায়বেরেলি থেকে ইন্দিরা গান্ধীকে লোকসভা নির্বাচনে হারিয়েও দিয়েছিলেন। মাথায় লাল ফেট্টি বাঁধা রাজনারায়ণ তাই ভারতের ইতিহাসের এক বর্ণময় চরিত্র।
রাজনারায়ণ পরবর্তীকালে জনতাদল সরকারের মন্ত্রী হন, আবার সেই সরকার থেকে তিনি বেরিয়েও যান। অনেকেই বলেন, যে মোরারজি দেশাই সরকারের পতনের পিছনে রাজনারায়ণের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। সেই রাজনারায়ণের ঘনিষ্ঠ অনুগামী সৈয়দ শাহনওয়াজ আহমেদ কাদরি আসলে একটি অসামান্য কাজ করে ফেলেছেন। আমি রাজনারায়ণের রাজনৈতিক ইতিহাসকে আমি এখানে তুলে আনলাম এই কারণেই, এটা বোঝানোর জন্য, যে কাদরি সাহেব রাজনৈতিকভাবে দীর্ঘদিন কংগ্রেসের সঙ্গে হাঁটেননি, কিন্তু আজকের পৃথিবীর বাস্তবতা মেনে এবং তিনিও বোঝেন বলেই কংগ্রেস শাসিত রাজ্যগুলি অর্থাৎ কর্ণাটক কিংবা তেলেঙ্গানায় তাঁর বই নিয়ে তুমুল আলোচনা কিংবা তর্কবিতর্ক চলছে। তেলেঙ্গানা সরকারের একাধিক মন্ত্রী উপস্থিতি থেকে কাদরি সাহেবের বইয়ের ইংরেজি সংস্করণের উদ্বোধন করেছেন এবং এই বই স্বাধীনতা আন্দোলনে মুসলিমদের ভূমিকার বিষয়ে কী অসামান্য কাজ হিসেবে স্বীকৃত হবে, সেকথা শতমুখে বলেছেন।
এই বইতে তাই স্বাধীনতা সংগ্রামে মুসলমান মহিলাদের অবদানের কথা বলতে গিয়ে কাদরি সাহেব বারবার দেখিয়েছেন, কাকে গান্ধীজি ডেকে নিয়ে কোনও কাজের দায়িত্ব দিয়েছেন, কার বিবাহতে গান্ধীজি অভিনন্দন জানিয়ে চিঠি লিখেছেন।
সৈয়দ শাহনওয়াজ আহমেদ কাদরির সঙ্গে আমার পরিচয় সমাজ মাধ্যমেই অর্থাৎ ফেসবুকের মাধ্যমে। আমিও যেহেতু ইতিহাস নিয়ে চর্চা করি এবং স্বাধীনতা আন্দোলন, দেশভাগ, মুসলমান মহিলারা যেহেতু আমারও চর্চার বিষয়, সেই কারণেই হয়তো কাদরি সাহেব আগ্রহ ভরে বইটি আমার কাছে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু এই বই যে যে-কোনও ইতিহাসের ছাত্রীর কাছে এক হারানো ‘রত্ন ভাণ্ডার’। স্বাধীনতা সংগ্রামে কোন মুসলমান মহিলা চরকা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, কে প্রথম ভারত ছাড়ো আন্দোলনে গ্রেফতার হয়েছিলেন, সেইসমস্ত তথ্যের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ রয়েছে কাদরি সাহেবের বইতে। আমাদের মনে রাখতে হবে, গত শতকের যে সময়টিকে নিয়ে কাদরি সাহেব কাটাছেঁড়া করেছেন, সেই সময় ভারতবর্ষে শুধু রাজনৈতিক আন্দোলন, স্বাধীনতা আন্দোলন তৈরি হচ্ছিল না, একইসঙ্গে সামাজিকভাবে আমরা এক নতুন পথে হাঁটছিলাম। এবং অস্বীকার করার জায়গা নেই, সেই হাঁটার প্রধান পথপ্রদর্শক ছিলেন মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী। এই বইতে তাই স্বাধীনতা সংগ্রামে মুসলমান মহিলাদের অবদানের কথা বলতে গিয়ে কাদরি সাহেব বারবার দেখিয়েছেন, কাকে গান্ধীজি ডেকে নিয়ে কোনও কাজের দায়িত্ব দিয়েছেন, কার বিবাহতে গান্ধীজি অভিনন্দন জানিয়ে চিঠি লিখেছেন। এইসবই আসলে প্রমাণ করে, যে সেই সময় স্বাধীনতা আন্দোলনের পাশাপাশি সামাজিক যে পরিবর্তনগুলো হয়ে চলেছিল, সেগুলোও কীভাবে ভারতীয় সমাজ এবং ভারতের রাষ্ট্রব্যবস্থাকে প্রভাবিত করেছিল। সেই কারণেই হয়তো কাদরি সাহেবের এই বই এত অমূল্য।
সংখ্যাতত্ত্বের দিক থেকে বলা যায়, যে কাদরি সাহেব তাঁর ‘ব্লাডস স্পিকস টু’ তে প্রায় ১৫০ দুষ্প্রাপ্য ছবি ব্যবহার করেছেন, ২৪০০ এমন মানুষদের কথা তুলে এনেছেন, যাঁদের কথা আমরা হয়তো খুব একটা জানতাম না। অরুণা আসফ আলি, সীমান্ত গান্ধী কিংবা মৌলানা আবুল কালাম আজাদ হয়তো ইতিহাসে বহু চর্চিত নাম এবং হয়তো তাঁরা তাঁদের কাজের জন্যই চর্চিত। কিন্তু তাঁদের বাইরে যে অসংখ্য চরিত্র ছড়িয়ে আছে, তাঁদের খুঁজে বের করার কাজটা সৈয়দ শাহনওয়াজ আহমেদ কাদরি খুব যত্নসহকারে করেছেন। এবং করেছেন এমন একটা সময়, যখন ভারতবর্ষের হিন্দুত্ববাদী আন্দোলনগুলি মুসলিমদের দেশপ্রেম বা জাতীয় আন্দোলনে তাদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। এই বই তাই আসলে একটি ‘মাইলফলক’ই বটে। রাজিন্দর সাচার ঠিকই বলেছেন, ইতিহাস এই বইকে অন্য অনেক কারণে মনে রাখবে। ভারতবর্ষের মুসলমানদের যখন কথায় কথায় পাকিস্তান যেতে বলা হয় বা তাদের দেশপ্রেম বা স্বাধীনতা আন্দোলনে তাদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়, তখন এই বই এক অসামান্য ডকুমেন্টেশন যে আসফাকুল্লা খান থেকে অরুণা আসফ আলিরা কীভাবে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের চরিত্রকে বদলে দিয়েছিলেন, সেখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন।