নৌমানকে ফোন লাগালেন তারেক সাহেব। রিং হতে লাগল।
নৌমান আয়ুর্বেদিক ডাক্তার। চিকিৎসা এবং ওষুধ দুইই তার কাছে পাওয়া যায়। বছর তিনেক থেকে তার এই কারবার। যখন সে এই কারবার করবে বলে ঠিক করল, তারেক সাহেবের কাছে গিয়ে তার পরিকল্পনার কথা বলল। তিনি সব শুনে তাকে উৎসাহিতই করলেন। নৌমান বলল, "আপনাকে কিছু টাকা ধার দিতে হবে। আমি সময় মতো আদায় দিয়ে দেব।''
তারেক সাহেব জিজ্ঞেস করেছিলেন, "কত দিতে হবে আমাকে?"
নৌমান বলেছিল, "পঞ্চাশ হাজার দিলেই হবে।"
বিনা বাক্যব্যয়ে পঞ্চাশ হাজার টাকা নিজের একাউন্ট থেকে নৌমানের একাউন্টে ট্রান্সফার করে দিয়েছিলেন তিনি। তিন বছর হয়ে গেল অথচ সেই টাকা ফেরত পাননি। বরং আরো কয়েকবার দশ-পাঁচ করে নিয়ে সেই টাকার পরিমাণ এসে দাঁড়িয়েছে পঁচাশি হাজারে।
ফেরত দেওয়ার কথা তাকে কয়েকবার মনেও করিয়ে দিয়েছেন। সে বলেছে, "দিয়ে দেব। আর ক'টা দিন সময় দিন।" তারেক সাহেব সময় দিয়েছেন। সেই সময় কবে শেষ হবে তিনি নিজেও জানেন না। অবশ্য তাঁর ততটা প্রয়োজনও ছিল না।
শুধু নৌমানকে নয়, কম- বেশি সাতজনকে তিনি টাকা ধার দিয়ে রেখেছেন। কাউকে কম, কাউকে বেশি। কেউ সময় মতো দেয়, কেউ দেয় না। কেউ একবার ফেরত দিয়ে পুনরায় নেয়। এটাকে জীবনের অঙ্গ হিসেবেই ধরে নিয়েছেন তারেক সাহেব। এটুকু উপকার তো করতেই হবে! শিক্ষক মানুষ তিনি!
সবথেকে বেশি উপকার করেছিলেন জাহাঙ্গীরকে। তারেক সাহেব যখন এই অঞ্চলে চাকরি নিয়ে এসেছিলেন তখন জাহাঙ্গীর খুব ছোট। স্কুল পড়ুয়া। যে বাড়িতে ভাড়ায় উঠলেন সেই বাড়ির পেছনের অংশে থাকত তারা। তার মা ও সে। বাবা মারা গিয়েছেন বছর দুই আগে। পেছনের অংশটা তাদেরই। সামনের অংশটা ছিল তার মামার। ব্যবসায় লস খেয়ে বিক্রি করে দিলে ভিনজেলার একজন শিক্ষক মকবুল হোসেন সেটা কিনে নেন। সেই শিক্ষকের অংশে থাকতেন তিনি। বহুদিন থাকার ফলে প্রতিবেশীর মত হয়ে গিয়েছিলেন। সুবিধা-অসুবিধায় একে-অপরের পাশে দাঁড়ানোটা তখন কর্তব্যের মধ্যেই পড়ত।
দীর্ঘ পাঁচ বছর থাকলেন তিনি এই বাড়িতে। মকবুল সাহেব একদিন বললেন, বাড়ি ছেড়ে দিতে। তাঁর বসবাসের জন্যই বাড়িটা দরকার। ছেড়ে দিলেন। গিয়ে উঠলেন পাশের এক বাড়িতে। আরো পাঁচ বছর কেটে গেল। মকবুল সাহেব বাড়ি বিক্রি করে ফিরে গেলেন নিজের জেলায়। সেই বাড়ি কিনে নিতে গেল জাহাঙ্গীররা। বারো লাখ টাকা দাম। ছয় মাস সময় নিলেন জাহাঙ্গীরের মা। জমি বিক্রি করে, সোনা বন্ধক রেখে নয় লাখ জোগাড় হল। পাঁচ মাস হয়ে গেল অথচ বাকি তিন লাখ টাকা জোগাড় করতে পারলেন না। নিরুপায় হয়ে তারেক সাহেবের কাছে গেলেন মা ও ছেলে। ধার চাইলেন টাকা।
তিনি বললেন, "তিন লাখ টাকা! এত টাকা তো আমার কাছে নেই।" এত টাকা কাছে থাকার কথাও না। জাহাঙ্গীর বলল,"আপনি আপনার নামে পার্সোনাল লোন করে আমাদের টাকা দেন। আমরাই লোনের কিস্তি শোধ করব।" তিনি মুখের উপর 'না' বলতে পারলেন না।
স্কুল থেকে যাবতীয় কাগজ নিলেন, জাহাঙ্গীরকে সঙ্গে নিয়েই তিন-চার দিন ব্যাংকে গেলেন, ইন্সপেক্সন হল। সার্ভিস চার্জ লাগবে তিন হাজার টাকা। সেই টাকা জাহাঙ্গীরের কাছে নেই। তারেক সাহেব সেই টাকাও দিলেন। লোন হয়ে গেলে টাকা তুলে ব্যাংকেই জাহাঙ্গীরের হাতে ধরিয়ে দিলেন।
বাড়ি কেনা হয়ে গেল। জাহাঙ্গীরের মা তারেক সাহেবকে গিয়ে বললেন,"ভাড়া যখন থাকতেই হবে, আমাদের নতুন বাড়িতে গিয়েই থাকো।" সেই বাড়িতে আগেও ছিলেন তিনি। ফলে রাজি হয়ে গেলেন। মাসিক ছাব্বিশ শো টাকা ভাড়ার বাড়ি ছেড়ে তিন হাজার টাকা ভাড়ার চুক্তিতে তিনি নতুন বাড়িতে উঠে এলেন।
মাসিক কিস্তি পড়ল সাড়ে ছয় হাজার টাকা। সেই টাকা কাটতে লাগল তারেক সাহেবের সালারি একাউন্ট থেকে। বাড়ি ভাড়া তিন হাজার। বাকি সাড়ে তিন হাজার টাকা বাড়তি দিতে হতে লাগল তাঁকে। জাহাঙ্গীর কখনো দশ কখনো বিশ হাজার জমা দিয়ে ব্যাংকে লোনের পরিমান কমাতে লাগল। একসময় শোধ হল টাকা। শোধ হওয়ার পর দেখা গেল কিস্তি বাবদ প্রায় পঁয়ষট্টি হাজার টাকা তাঁর একাউন্ট থেকে কাটা হয়ে গেছে।
জাহাঙ্গীরের মা বললেন, "টাকাটা শোধ দেব ভাড়া থেকেই। তবে পুরোটা কাটলে আমাদের অসুবিধা হবে। ভাড়া বাবদ দু'হাজার টাকা কেটে নিয়ে একহাজার আমাদের হাতে দিও।" তাতেও তিনি রাজি হলেন। সেই টাকা শোধ না হতেই জাহাঙ্গীর এসে বলল, "মামা, সোনা বন্ধক রেখে টাকা নিয়েছি। সেই টাকা শোধ দিতে হবে। আপনি পঁচাত্তর হাজার টাকা লোন করে আরেকবার দিন। আগেরবারের মত এবারও শোধ করে দেব।"
তারেক সাহেব আমতা আমতা করতে লাগলেন। একজনকে আর কতবারই বা এভাবে টাকা দেয়া যায়! তারপরও তিনি দিলেন। সেই টাকাও শোধ হল একসময়।
তারপর শুরু হল অন্যভাবে সাহায্য নেয়া। মাসের দশদিন না যেতেই আজ দু'শো, কাল পাঁচশো করে নিয়ে মাস পূর্ণ হওয়ার আগেই ভাড়ার টাকা নেয়া হয়ে যায় ওদের। এটাকে তারেক সাহেব কিছুই মনে করেন না। দিতে যখন হবেই, হয় কিছুদিন আগে, নয় পরে!
মাসিক ভাড়া বেড়ে একবার তেত্রিশ শো হল। সেটা আরো একবার বেড়ে চার হাজার হল। দিন যাচ্ছে। ভাড়া বাড়বে এটাই স্বাভাবিক। তবে ভাড়ার যেখানে চাহিদা নেই সেই তুলনায় ভাড়াটা বেশিই হল। তাও তিনি মেনে নিলেন। বাড়ি চেঞ্জ করলে কম ভাড়াতেই বাড়ি পেয়ে যাবেন। অনেক খালি বাড়ি আশেপাশে। অনেকে ডাকেনও। কিন্তু সবকিছু নিয়ে টানাটানি করতে ইচ্ছে নেই বলেই তিনি বেশি ভাড়া দিয়ে এই বাড়িতেই থেকে গেছেন। তাছাড়া এতদিনের একটা সম্পর্ক।
"মানুষের উপকার করলে বাঁশ খেতে হয়" একথা তারেক সাহেব শুনে এসেছেন এতদিন। কিন্তু বাঁশটা যে এত তাড়াতাড়ি তিনি খাবেন ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করতে পারেননি। একদিন সুমন, তাঁর প্রাক্তন ছাত্র, ফোন করে বলল,"স্যার, আমার এক বান্ধবী, বর্ষা, আমাদের এদিকে প্রাইমারী স্কুলে চাকরি পেয়েছে। সে ভাড়ার জন্য একটা বাড়ি খুঁজছে। আপনি এই ব্যাপারে একটু সাহায্য করবেন।" তিনি স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে উত্তর দিলেন, "অবশ্যই করবো। আশপাশে অনেক বাড়িই খালি পড়ে আছে। তাদের একটা নিশ্চয়ই হয়ে যাবে।"
সেদিনই বিকেলে ওরা এলো। বাড়ি দেখতে। স্কুল করে আর ফেরেনি বাড়ি। তারেক সাহেবের সঙ্গে দেখা করার জন্য অপেক্ষা করছিল। তিনি বাড়ি ফিরতেই তারাও এলো। তিনজন। সামনে গ্রীষ্ম। সকালে স্কুল হবে। বাড়ি থেকে এত সকালে এসে স্কুল করা সম্ভব নয়। তাই যত দ্রুত সম্ভব ভাড়া বাড়ি ঠিক করে এসে উঠতে হবে।
চা খেতে খেতে তারেক সাহেব স্ত্রী শিলিকে নির্দিষ্ট করে বলে দিলেন, কার কার বাড়ি দেখাতে নিয়ে যেতে হবে। বর্ষা বলল, "স্যার, আমি ইতিপূর্বে কোনদিন কোথাও একা থাকিনি। এমন বাড়ি দেখুন যেন আমার কোন অসুবিধা না হয়। রান্না করাও জানি না তেমন। পেয়িং গেস্ট হিসেবে থাকতে পেলে আরো ভালো হয়।"
তারেক সাহেব শিলিকে বললেন, "তবে মাফি চাচার বাড়ি নিয়ে যাও। ওরা এরকমই একজন ভাড়াদার খুঁজছেন।"
শিলি বর্ষাকে উদ্দেশ্য করে বলল, "তুমি বরং আমার কাছেই থেকে যাও। কোথাও যেতে হবে না তোমাকে।"
কথাটা শুনে বর্ষা হাতে চাঁদ পেল যেন। লাফিয়ে উঠল। বলল, "আমি তাই বলতে চাইছিলাম ভাবি। আমি এখানেই থাকব। আপনার সঙ্গে রান্না করে খাবো।"
শিলি বলল,"দু'মাসের জন্য অন্যের বাড়ি থাকলে সবকিছু বাড়ি থেকে বয়ে নিয়ে আসতে হবে। খাট, বিছানা-চাদর, ওভেন-বাসনপত্র, অনেক ঝামেলা।"
তারপর তারেক সাহেবের দিকে ফিরে বলল,"থেকে যাক কেমন?"
বড় ছেলে হোস্টেলে। ঘর ফাঁকাই আছে। থাকতে কোন সমস্যা নেই। দুটো মাস তো! তিনি বললেন, " সমস্যা একটাই। কমোন বাথরুম। বর্ষা যদি মানিয়ে নিয়ে থাকতে পারে তাতে আমাদের কোন আপত্তি নেই।"
সুমন বলল, "স্যার, এটা সবথেকে ভালো হবে। ও নিরাপত্তা পাবে।"
বর্ষা বলল,"আমি আর কোথাও যাবো না স্যার। এখানেই ভাবির সঙ্গে থাকব আমি।"
তারেক সাহেব বললেন,"তাহলে মালিকের সঙ্গে কথা বলে দেখি তারা কী বলেন। বাড়ি তো আমার না। আমিও ভাড়ায় থাকি।"
"হ্যাঁ স্যার, কথা বলুন। আমি আপনাকে ফোন করে খোঁজ নেব।" কথাটা বলে ফোন নম্বর নিয়ে উঠে পড়ল বর্ষা। উঠে পড়ল সকলে।
বাড়ির মালকিন আপত্তি করবেন না ধরে নিয়েই কথাটা বললেন তারেক সাহেব। তিনি বললেন,"তোমরা যদি মানিয়ে নিয়ে থাকতে পারো তবে থাকো। আপত্তি কিসের। তবে ছেলের সঙ্গে কথা বলে দেখি, কী বলে ও।"
পরদিন সকালে বাড়ির মালকিন এসে জানালেন,"ছেলে বলেছে, আপনারা যে চার হাজার ভাড়া দিচ্ছেন তাই দেবেন, ওকে বলবেন দু'হাজার দিতে।"
"তার মানে বলতে চাইছেন, দু'জন মিলে ছয় হাজার ভাড়া তাই তো?'
মালকিন চুপ থাকেন। বোঝা যায় এটা তার ছেলের কথা হলেও সায় আছে তারও।
শিলি ফোঁস করে উঠে। বলে,"আপনাদের লোভ তো কম নয়। এ বাড়ির ভাড়া ছয় হাজার? কথাটা বলার আগে আপনাদের একবারও মনে হল না, এতবড় উপকার নিয়ে বসে আছেন, যখন কেউ আপনাদের টাকা ধার দেয়নি তখন আমরা পৌঁনে চার লাখ টাকা নিজেরা রিস্ক নিয়ে লোন করে দিয়েছি এই বাড়ি কিনতে, আর এখন এই তার প্রতিদান?"
মালকিন প্রথমে নিরুত্তর থাকেন। পরে বলেন, "ছেলে যদি না মানতে চায় তাহলে আমি কী করব! ও আমার কোনো কথা শুনে নাকি!"
তারেক সাহেব বললেন,"থাক, আর কথা বাড়াতে হবে না। বর্ষাকে বলে দিও অন্য কোনো বাড়ি দেখে নিতে।" ভীষণ খারাপ লাগল তাঁর। শুধু কি তাই? জাহাঙ্গীর যখন ব্যবসা শুরু করল, বহরমপুর থেকে মাঝেমধ্যেই ফোন করে বলতে লাগল,"মামা! আমার নম্বরে তিন হাজার টাকা ফোনপে করে দেন তো। বাড়ি এসে দিচ্ছি আপনাকে।" তারেক সাহেব দিতেন। বার কয়েক দেওয়ার পরও যখন পুনরায় বহরমপুর থেকে ফোন করে টাকা চাইলো, বললেন,"আমার সালারি একাউন্ট। আমাকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে স্টেটমেন্ট জমা দিতে হয়। আমি তো এভাবে রোজ-রোজ টাকা ট্রান্সফার করতে পারি না। ব্যবসা করলে টাকা সঙ্গে নিয়ে যেতে হবে।" সেই জাহাঙ্গীর এত উপকার নেওয়ার পরও কেমন করে এমন কথা বলতে পারে ভেবে অবাক হলেন তারেক সাহেব।
লোন করে যখন টাকা নিল, জাহাঙ্গীর তারেক সাহেবকে বললেন, "কথাটা কাউকে বলবেন না মামা।" কাউকে তিনি এযাবৎ বলেনওনি। কিন্তু আজ তাঁর মনে হল, কথাটা বলে দরকার। ক'জনকে জানানো দরকার। তার মানসিকতার ঘৃণ্য দিকটা তুলে ধরা দরকার। তাদের বাড়ির সামনে যে মুদিখানা, সেই মুদির সলিমুদ্দিনকে বলবে বলে জাহাঙ্গীরের সামনেই তিনি কথা তুললেন।
তারেক সাহেব বললেন,"যখন কেউ টাকা ধার দিল না, আমাকে এসে ধরল, আমি লোন করে টাকা নিয়ে দিলাম, পৌনে চার লাখ টাকা, আর এখন সেই জাহাঙ্গীর সব সুবিধা নেওয়ার কথা দিব্যি ভুলে গেল।"
জাহাঙ্গীর বলে উঠল,"এসব কথা এখন উঠছে কেন? এত বছর পর!"
"তুমি উঠিয়েছো বলে উঠছে।"
সলিমুদ্দিন বললেন,"এত টাকা আপনি দিয়েছেন, জানি না তো!"
"কেই বা জানে! কাউকে জানালে তো? তবে এখন সবার জানা দরকার।"
"কী হয়েছে? কিছু হয়েছে?"
"একজন আমাদের সঙ্গে থাকতে চেয়েছিল। শিক্ষিকা। মর্নিং স্কুল হবে। দূর থেকে এসে স্কুল ধরতে পারবে না বলে দুটো মাস ভাড়ায় থাকতে চেয়েছিল আমাদের সাথে। জাহাঙ্গীর বলেছে, আপনাদের চার হাজার বাদ দিয়ে ওকে মাসে আরো দু'হাজার দিতে হবে। তবেই থাকতে পাবে।"
ইতিমধ্যে আরো ক'জন এসে জড়ো হয়েছে। সলিমুদ্দিন বললেন,"এটা কেমন কথা! উনি ভাড়া নিয়েছেন। কাকে রাখবেন না রাখবেন সেটা তাঁর ব্যাপার। এত কিছু সুবিধা নেওয়ার পরও এ কেমন মানসিকতা!" উপস্থিত সকলেই বলল, "ঠিকই তো! এটা জাহাঙ্গীর ঠিক বলেনি।"
"সুবিধা শুধু আমি নিয়েছি? উনি নেননি? কম ভাড়ায় এত সুন্দর বাড়ি দিয়েছি। আগের বাড়ি থেকে তো তাঁকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছিল। আমরা সেখান থেকে তাঁদের উদ্ধার করেছি।" জাহাঙ্গীর গলার স্বর উঁচু করে বলল।
তারেক সাহেব বললেন,"দেখো জাহাঙ্গীর। নিজের লজ্জা ঢাকতে অন্যকে মিথ্যা অপবাদ দিও না। কেউ আমাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করেনি। তোমরা বলেছিলে বলেই আমরা এসেছিলাম। যথেষ্ট বেশি ভাড়া দিয়েই এসেছিলাম। এখনো চার হাজার টাকা মাসে ভাড়া দিই। আছে আশেপাশে এত ভাড়া কোথাও?"
"চার হাজার টাকায় আপনাকে ছ'টা ঘর দিয়েছি। এত কমে কোথায় পাবেন? পাঁচ-সাড়ে পাঁচের ভাড়া আমার হাতে আছে। আপনি বেরিয়ে যান আমি বেশি ভাড়ায় লোক ঢুকিয়ে দিচ্ছি।"
আকাশ থেকে পড়লেন তারেক সাহেব। ছ'টা ঘর! তিনি জানতে চাইলেন,"ছ'টা ঘর? ছ'টা ঘর কোথায় পেলে তুমি? দু'টো বেডরুম আর একটা ছোট্ট মতো বৈঠকখানা।"
"চিলেকোঠা একটা। আপনি বাইক রাখেন একটা ঘরে। এগুলো ধরবেন না?"
"চিলেকোঠা? এটা ঘর? এর আলাদা করে ভাড়া লাগে? জানতাম না তো?"
"তাহলে তালা মেরে রাখেন কেন? খুলে দেবেন । আমরা ব্যবহার করবো।"
"ওটা সেফটির জন্যই তালা দিয়ে রাখতে হয়। আর বাইক রাখি তো তোমার সঙ্গে। তাও আড়াই বছর ধরে। আগে তো আমার বাইক ছিল না। বাড়ি ভাড়া দিয়েছো, গাড়ি রাখার জায়গা দেবে না? নাকি গাড়িটা মাথায় করে নিয়ে দোতলায় উঠতে হবে?"
সলিমুদ্দিন বললেন, "এসব কথা বাদ দাও জাহাঙ্গীর। তুমি বাড়তি দু' হাজার টাকা চাওয়াটা ভুল করেছো। মাস দুয়েকের জন্য কেউ যদি থাকতে চায়, আর মাষ্টার মশাই যদি থাকতে দেন, তোমার আপত্তি কিসের? সুবিধা নিবে আর সুবিধা দেবে না এটা হয় কখনো?"
"মাসে চার হাজার টাকা দিতে পারছেন না বলে আরেকটা ভাড়া ঢুকাচ্ছেন। দুই দুই করে দু'জনে চার হাজার দেবেন।"
তারেক সাহেব ফুঁসে উঠলেন,"কী বললে তুমি? মেয়েটার সঙ্গে ভাড়া নিয়ে কোন কথায় হয়নি আমার। সে দেবে কি না, কত দেবে সেটা তার ব্যাপার। দু'মাস তার থেকে টাকা নিয়ে ভাবছো আমার বিশাল টাকা বেচে যাবে। এতদিনে আমাকে এই চিনলে তুমি?"
"আপনি যে বলছেন, পৌঁনে চার লাখ টাকা দিয়ে সাহায্য করেছি, সুদটাতো আমাকে দিয়ে হয়েছে নাকি?"
"সুদ তো তোমাকে দিতে হবেই। তুমি লোন করিয়েছো। সেটাও তো কেউ তোমাকে দেয়নি। নিজের রিস্কে সালারি একাউন্ট দেখিয়ে লোন করে দিয়েছি, আমার একাউন্ট থেকে মাসে মাসে সাড়ে ছ'হাজার করে কিস্তি কেটেছে, অথচ বাড়ি ভাড়া ছিল তিন হাজার। আমি কত টাকা বাড়তি শোধ করেছি জানো না?"
লোক জমে যায় একেক করে অনেকেই। তারাও দু'পাঁচ কথা বলে উঠে প্রয়োজনে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে শিলি। তারেক সাহেবকে হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে চায় বাড়ি। আসে জাহাঙ্গীরের মাও। তিনিও টানেন ছেলেকে বাড়ির দিকে। বলেন, "বাড়ির কথা বাড়িতে হবে। সবার মাঝে কেন?" শিলি উত্তর দেয়, "সেই পর্যায়ে রেখেছেন পরিস্থিতি? আপনাদের চেহারাটা মানুষের সামনে তুলে ধরাই দরকার।" একথাটা গায়ে লাগে জাহাঙ্গীরের। সকলের সামনে তার বড়ত্বের উচ্চতা ধসে যায় নিমেষে। সে বেপরোয়া হয়ে উঠে। বলে, "টাকা দিয়ে বারো পার্সেন্ট সুদ খেয়েছেন তার বেলা?" এ কথায় ধাক্কা খান তারেক সাহেব। বলেন,"সুদ তুমি আমাকে দিয়েছো নাকি ব্যাংককে দিয়েছো?" জাহাঙ্গীর মুখের উপর বলে,"সে একই হল।"
শিলি একটা হ্যাচকা টান দেয় তারেক সাহেবকে। বলে,"চলো, নির্লজ্জদের সাথে কথা বলার কোন মানে নেই। সাপের মুখে ঘা পড়েছে, ও এখন যেভাবে হোক ফোঁস মারার চেষ্টা করবে। বাদ দাও।" তারপর জনতার উদ্দেশ্যে বলেন,"জানেন, ওর নাতি হয়েছে। দেখতে যাবে। খালি হাতে যায় কী করে! হাতে টাকা নেই। পাঁচ পয়সা থাকেও না কখনো। মেয়ের বাড়ি হোক বা অন্য কোথাও, আমাদের কাছ থেকেই টাকা ধার নিয়ে যায়। আমাকে এসে বললো, তোমার ছেলের একটা আংটি দাও। নাতিকে দেখে আসি। কাউকে কিছু বলো না। আমি এক-দুই বছরের মধ্যে নাতিকে আংটি বানিয়ে দেব। আর তোমার আংটি ফেরত দিয়ে দেব। সেই আংটি আড়াই বছর পর ফেরত দিয়েছে।" তারেক সাহেব একরাশ ঘৃণা নিয়ে বাড়ি আসেন। সলিমুদ্দিনের দোকানে তখনো গুঞ্জন চলতেই থাকে।
লোকে বলে, উপকার করলে বাঁশ খেতে হয়। তিনি হাড়ে হাড়ে টের পেলেন। তাঁর বাঁশ খাওয়ার আরো বাকি আছে। তিনি তো আর একজনকে টাকা ধার দিয়ে উপকার করেননি! করেছেন অনেককেই। সবার কাছ থেকেই বাঁশ তাঁর প্রাপ্য। তাই তিনি ফোন লাগিয়েছেন আয়ুর্বেদিক ডাক্তার নৌমানকে। ওপার থেকে ফোন রিসিভ করে নৌমান বলল,"হ্যাঁ, বলুন মাস্টার মশাই।"
তারেক সাহেব অত্যন্ত ধীরে ধীরে কেটে কেটে স্পষ্ট করে বললেন, "বাঁশটা কবে দেবে? বাঁশ?"
নৌমান কথার আগাপিছু কিছুই বুঝতে পারে না। সে পাল্টা প্রশ্ন করে জানতে চাইলো," কি বললেন, বাঁশ?"
তারেক সাহেব বললেন,"হ্যাঁ, বাঁশ।" তারপর হা হা হা করে অট্টহাসিতে ফেটে পড়েন।
কিছু না বুঝেই সেই হাসিতে যোগ দিয়ে হা হা হা করে নৌমানও হাসতে থাকে। তারপর কেটে কেটে সেও স্পষ্ট করে বলে, "মাস্টার মশাই, সামনেই ইয়ার এন্ডিং। কোম্পানীকে টাকা শোধ দিতে হবে। কয়েকমাসের জন্য যদি কুড়ি-পঁচিশ হাজার টাকা দিতেন তাহলে খুব উপকৃত হতাম। জানি, আপনি না করবেন না।