মুদাসসির নিয়াজ
বিশ্বের অন্যতম ধনকুবের পরিবারের অজানা সত্যকাহিনি, যা জানলে অনেকেই শিউরে উঠবেন। এই ইহুদি পরিবার বহু যুদ্ধের নেপথ্য কুশীলব। বিশ্বজুড়ে ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থার আঁতুড়ঘর এই পরিবার। এই পরিবার এতটাই প্রভাবশালী যে, অনেক দেশের রাজা, রাষ্ট্রপ্রধানকে পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করত এরা। যুদ্ধাস্ত্র কিনতে, এমনকী যুদ্ধরত দুই দেশকেই ঋণ দিয়েছে এই পরিবার। যে কোনও দেশের সরকার বদলে দেওয়া, যে কোনও দেশের সঙ্গে যুদ্ধ লাগিয়ে দেওয়ার মতো জটিল কঠিন বিষয় ছিল এদের কাছে জলবৎ তরলং।
অষ্টাদশ শতাব্দীতে অর্থের সমার্থক শব্দ ছিল রথসচাইল্ড পরিবার। সবক্ষেত্রে গোপনীয়তা রক্ষা করা এই রহস্যময় ধনাঢ্য পরিবারের দেওয়ালে কান পাতলে শোনা যায় বহুমুখী ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব। এই পরিবারের স্থপতি মায়ার আমসেল রথসচাইল্ড এর জন্ম ১৭৪৪ সালে জার্মানির জুডেনগাসে এক ইহুদি পরিবারে। তার বাবা ছিলেন এক ধণাঢ্য সূদী কারবারী মহাজন। ১২ বছর বয়সে অনাথ হয়ে জার্মানির হ্যানোভার শহরে একটা ব্যাঙ্কে ইন্টার্ন হিসেবে কাজ শুরু করেন। এছাড়া প্রাচীন রোম, পার্সিয়া এবং বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের বিরল মুদ্রা সংগ্রহ করতেন। ১৯ বছর বয়সে ফ্রাঙ্কফুর্টে ফিরে এসে বাবার রেখে যাওয়া ব্যবসায় যোগ দেন এবং একটি ব্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠা এবং বিরল মুদ্রার ব্যবসা শুরু করেন। এর সূত্র ধরেই হেসের ক্রাউন প্রিন্স উইলহেমের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে নানান সুবিধা ও আনুকূল্য লাভ করেন।
উইলহেম ছিলেন পাহাড়প্রমাণ সম্পদের উত্তরাধিকারী। পরে তিনি রাজা হন। ১৭৬৯ সালে রাজা উইলহেমের কাছে ‘ক্রাউন এজেন্ট’ উপাধি পান রথসচাইল্ড। তাঁর পাঁচ পুত্রের নাম আমসেল, সালমন, নাথান, কার্ল ও জ্যাকব। ফরাসি বিপ্লবের সময় মায়ারের ব্যাঙ্কিং ব্যবসা ফুলে-ফেঁপে ওঠে। তখন মার্চেন্ট ব্যাঙ্ক খোলার জন্য এক ছেলেকে ফ্রাঙ্কফুর্টে রেখে, বাকি চারজনকে পাঠিয়ে দেন ইউরোপের চার দেশের চার সমৃদ্ধ শহর নেপলস, প্যারিস, ভিয়েনা ও লন্ডনে। ১৯ শতকের প্রথম দিকে এই পরিবার ছিল ইউরোপের শীর্ষ ধনকুবের। ১৮১২ সালে মৃত্যুর আগে উইল করে যান মায়ার রথসচাইল্ড। লিখে যান, বাইরের কেউ তাদের ব্যবসায় ঢুকতে পারবে না।
এই পরিবারের সদস্যরা সব ব্যাপারে ভীষণ গোপনীয়তা রক্ষা করে চলেন। তাই আম্বানি, আদানি থেকে জুকেরবার্গ, ইলন মাস্ক, জেফ বেজোস, বিল গেটসদের নাম মিডিয়ায় নিত্যদিন চর্চা হলেও ধনকুবের রথসচাইল্ড পরিবারের খবর নৈব নৈব চ। একসময় রাজনৈতিক কারণে ডেনমার্কে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন উইলহেম। তার আগে তিনি রথসচাইল্ডকে ৬০ হাজার পাউন্ড দিয়ে চলে যান।। তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমান মায়ার রথসচাইল্ড সেই অর্থ দিয়ে চার ছেলেকে ইউরোপের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ শহরে পাঠিয়ে দেন মার্চেন্ট ব্যাঙ্ক খুলতে। পাঁচটি রাজ পরিবারের সঙ্গে রথসচাইল্ডদের ব্যবসা ছিল। চতুর্থ পুত্র নাথান’কে লন্ডনে পাঠান। সেখানে তিনি টেক্সটাইল ব্যবসা ও শেয়ার কেনাবেচা করতেন। ইতিমধ্যে ‘এন.এম রথসচাইল্ড অ্যান্ড সন্স লিমিটেড’ নামে ব্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠা করে বিভিন্ন যুদ্ধে নানা দেশকে ঋণ দিত। ১৮১১ সালে নেপোলিয়ন বনাম ইংল্যান্ড যুদ্ধে তিনি ব্রিটিশ সরকারকে অর্থ জোগাতেন, আবার গোপনে নেপোলিয়নকেও দিতেন।
ওয়াটার-লু যুদ্ধে ইংল্যান্ডের রাজার কাছে খবর আসে, নেপোলিয়ন হারছেন। সেই গোপন খবর উল্টে দিয়ে নাথান গুজব রটান, ইংল্যান্ডের অবস্থা খারাপ, শিগগির সরকারের বন্ড মূল্যহীন হয়ে যাবে। সবাই হুড়মুড় করে বন্ড বিক্রি শুরু করে। একদিনেই ধসে পড়ে লন্ডন স্টক এক্সচেঞ্জ। সেই সুযোগে নাথান খুব কম দামে প্রচুর বন্ড কিনে বিরাট মুনাফা করেন।। তবে যুদ্ধ, রাজনীতি, পারিবারিক কোন্দল ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা গত ১০০ বছরে বেশ খানিকটা কমিয়ে দিয়েছে রথসচাইল্ড পরিবারের জৌলুশ। নেপলস, অস্ট্রিয়া ও ভিয়েনায় বন্ধ হয়ে গেছে তাদের ব্যাঙ্কিং ব্যবসা। তবুও বর্তমানে এদের সম্পদের পরিমাণ অন্তত ৫০ হাজার কোটি ডলার। তবে ফোর্বস-এর তালিকায় এই পরিবারের একজনও নেই। কারণ, তাদের সম্পদ এখন প্রায় ৫০০ উত্তরাধিকারীর মধ্যে ভাগ হয়ে গেছে। তবুও এখন তারা বিশ্বের এক চতুর্থাংশ সম্পদের মালিক।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে নেপোলিয়ন বোনাপার্টের সঙ্গে ফ্রান্সের ধারাবাহিক যুদ্ধ শুরু হয় ব্রিটেন ও তার জোটসঙ্গীদের। ১৮০৩ থেকে ১৮১৫ পর্যন্ত চলেছিল এই ভয়াবহ যুদ্ধ। ইউরোপকে গ্রাস করতে শুরু করেছিল নেপোলিয়নের ফ্রান্স। নেপোলিয়নের হাত থেকে নিজের সম্পদ রক্ষার্থে হেসে-কাসেলের রাজা উইলিয়াম বিপুল অর্থ পাচার করে দেন বন্ধু মায়ারের কাছে। ধূর্ত মায়ার সেই অর্থ পাঠিয়ে দেন লন্ডনে থাকা পুত্র নাথানের কাছে।
ওদিকে, দীর্ঘ এক দশক ধরে ফরাসিদের সঙ্গে যুদ্ধ চলায় তলানিতে এসে ঠেকেছিল ব্রিটিশ রাজকোষ। টান পড়েছিল যুদ্ধের রসদে। সেই সময় যুদ্ধ চালাতে ১৮১৩ সালে ব্রিটেনের রাজা তৃতীয় জর্জকে ৯.৮ মিলিয়ন পাউন্ড ধার দেন নাথান। পুরো অর্থটাই ছিল রাজা উইলিয়ামের। নতুন রসদ পেয়ে খাদের মুখ থেকে আবার লড়াইয়ে ফিরে আসে ব্রিটিশ সেনারা।। ব্রিটিশ রাজ পরিবারের নয়নমণি হয়ে যান নাথান। সুযোগসন্ধানী নাথান যুদ্ধের খরচ তোলার জন্য ব্রিটেনের রাজাকে বাজারে ‘ওয়ার বন্ড’ ছাড়তে পরামর্শ দেন। নাথান নিজেও কিনেছিলেন প্রচুর বন্ড। ১৮১৫ সালের ১৮ জুন ওয়াটার-লু যুদ্ধে পরাজিত হয় নেপোলিয়ানের ফ্রান্স। ঘটনাচক্রে সেই সময় বেলজিয়ামেই ছিলেন নাথান। ব্রিটিশদের যুদ্ধ জয়ের খবর সবার আগে নাথানের কাছে পৌঁছে দিয়েছিল তারই গুপ্তচর। তখনও অবশ্য অবিশ্বাস্য জয়ের খবর পৌঁছয়নি লন্ডনে।
প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যেই নাথান নৌকাযোগে রাতের অন্ধকারে ইংলিশ চ্যানেল পার হন। লন্ডনে ফিরেই কম দামে বেচতে শুরু করেন ওয়ার বন্ড। নাথানের কাণ্ড দেখে চমকে যান অন্যান্য লগ্নিকারীরা। যুদ্ধে ব্রিটিশদের পরাজয় আসন্ন ভেবে নিজেদের বন্ডগুলো জলের দরে বেচে দেন তাঁরা। সেই সব বন্ড কিনে নেন নাথান ও তাঁর চার ভাই। সেদিনই সন্ধ্যায় লন্ডনে ওয়াটার-লু যুদ্ধ জয়ের সংবাদ আসে। উল্কাগতিতে বেড়ে যায় বন্ডের দাম। আকাশছোঁয়া দামে বন্ড বেচতে শুরু করেন রথসচাইল্ডরা। নাথানের কিস্তিমাত করে দেওয়া চালে রথসচাইল্ড পরিবার একদিনেই কামিয়ে নেয় প্রায় ১৫০ মিলিয়ন পাউন্ড। এদিকে, যুদ্ধ জয়ের পর ব্রিটিশ রাজার কাছ থেকে চড়া সুদ-সহ ধার দেওয়া অর্থ ফেরত পান নাথান। এই লেনদেন থেকে নাথান কামিয়ে নেন বিপুল অর্থ।
এরপর রথসচাইল্ড পরিবার পা বাড়ায় আমেরিকার দিকে। গ্রাস করতে শুরু করে মার্কিন অর্থনীতি। আমেরিকার প্রথম জাতীয় ব্যাঙ্কের নিয়ন্ত্রণ বকলমে ছিল নাথান এরই হাতে। প্রথমদিকে তার ফন্দি ধরতে পারেনি আমেরিকা। কিন্তু বিষয়টি বুঝতে পারার পর অর্থনীতি থেকে নাথানের অদৃশ্য হাত সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে ওয়াশিংটন। তখন ক্ষিপ্ত হয়ে নাথান বলেন, “আমেরিকা যদি এটা করে, তাহলে ইতিহাসের সবথেকে ভয়াবহ যুদ্ধ দেখতে হবে ওয়াশিংটনকে।” আমেরিকার ওপর অসন্তুষ্ট ব্রিটেনকে ক্রুদ্ধ নাথান বলেছিলেন, “নির্বোধ আমেরিকানদের উচিত শিক্ষা দিতে হবে। আমেরিকাকে আবার ব্রিটিশ কলোনি বানিয়ে দেব আমি।”
১৮১২ সালে শুরু হওয়া ব্রিটেন-আমেরিকা যুদ্ধের নেপথ্যেও ছিল নাথান। যুদ্ধে ভেঙে পড়া মার্কিন অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে ১৮১৬ সালে গঠন করা হয় আমেরিকান সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক। যার প্রধান লগ্নিকারী ছিলেন নাথান। স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে ইসরাইল, ব্রাজিল ও রোডেশিয়ার (জিম্বাবুয়ে) আত্মপ্রকাশের সঙ্গে সরাসরি জড়িত এই পরিবার। দু-দুটো বিশ্বযুদ্ধ থেকেও তারা প্রচুর মুনাফা লুটেছিল। বিশ্বযুদ্ধে উভয় পক্ষকেই চড়া সুদে ঋণ দিত তারা। যুদ্ধ শেষে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলিকে নতুন করে গড়ে তোলার জন্যও ঋণ দিত। এভাবে ক্রমশ ঋণের জালে জড়িয়ে যেত দেশগুলি। সুদ-সহ ঋণ পরিশোধ করা ওইসব দেশের পক্ষে সম্ভব হত না। এভাবেই বিভিন্ন দেশের সরকারকে হাতের মুঠোয় রাখত রথসচাইল্ডরা। আজও তাদের পাতা ঋণের ফাঁদ থেকে বেরোতে পারেনি অনেক দেশ।
এখনও এই পরিবার নানা দেশে প্রায় কুড়িটার মতো ব্যাঙ্ক পরিচালনা করে। সুইস ব্যাঙ্কগুলির ওপরেও আছে এদের একচ্ছত্র আধিপত্য। ব্যাঙ্কিং ব্যবসা ছাড়াও তারা চালায় রিয়েল এস্টেট, সুরা, হিরে, জাহাজ, খনি, সুপারস্টার হোটেল, বিলাসবহুল প্রাসাদ-অট্টালিকা, বহুতল অফিস, স্টেডিয়াম, ফুটবল ক্লাব, ক্যাসিনো, কর্পোরেট অফিস, আবাসন, খনি, এমনকী বহু দ্বীপও। এছাড়াও এদের হাতে আছে অজস্র বিলাসবহুল প্রাইভেট জেট, জাহাজ, ইয়ট ও হেলিকপ্টার। এদের বিপুল বিনিয়োগ ও শেয়ার আছে অ্যাপল, মেটা (ফেসবুক), আমাজন, স্টারবাকস, ব্লুমবার্গ, ব্যাঙ্ক অফ আমেরিকা, পেপসিকো, জনসন, ফাইজারের মতো অসংখ্য নামজাদা বহুজাতিক কোম্পানিতে। এদের অর্থানুকুল্যেই গড়ে উঠেছে বহু খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়, ইনস্টিটিউট ও গবেষণাগার। এদের হাতে আছে বিভিন্ন দেশের ১৮০০ স্থাবর সম্পত্তি। ইহুদি হয়েও খ্রিস্টানদের পবিত্র ভ্যাটিকান সিটিকে প্রতি বছর মোটা অনুদান দেয় এই পরিবার।
রথসচাইল্ড পরিবারকে আরও বেশি রহস্যময় করে তুলেছে এদের জীবনযাত্রা। প্রায় দুশো বছর ধরে সমাজ থেকে স্বেচ্ছায় নিজেদেরকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে পরিবারটি। অন্দরমহলে বাইরের লোকের প্রবেশ নিষেধ। এই পরিবারে সাধারণত প্রাক্তন কর্মচারীদের বংশধরদেরই নেওয়া হয় বিভিন্ন পদে। অঢেল সম্পত্তি ধরে রাখতে বরাবরই এই পরিবারে তুতো ভাই-বোনদের মধ্যেই বিয়ের রীতি ছিল। পরে পরিবারের বাইরে বিয়ে হলেও পাত্র-পাত্রীর ইহুদি হওয়া বাধ্যতামূলক। তবে বৈবাহিক সূত্রে আত্মীয় হলেও বাইরের লোকদের সঙ্গে ব্যবসার ওপর ছিল কঠোর নিষেধাজ্ঞা। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের স্ত্রী এমা রথসচাইল্ড, এই পরিবারেরই কন্যা।