আবু রাইহান, টিডিএন বাংলা:
বাংলা ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি আল মাহমুদ বলেছিলেন- ‘কবির কাজ হল সবার জন্য, পৃথিবীর সবার হয়ে নীরবে অশ্রুপাত করা।’ বাংলা কবিতায় আল মাহমুদের শ্রেষ্ঠত্ব আজ আর অস্বীকার করার উপায় নেই। সমালোচকদের চোখে আল মাহমুদ জীবনানন্দ দাশ পরবর্তী সবচেয়ে শক্তিশালী কবি। প্রায় ৫০ বছরের কবি জীবনে অসংখ্য লিখেছেন।গত শতাব্দীর পাঁচের দশক থেকেই বিস্ময় জাগানো মৌলিক একটি কাব্য ভাষায় শুরু হয়েছিল তাঁর কবিতা চর্চা। তাঁর কবিতার নতুন নতুন ভাবনা চমকে দিয়েছে কবিতার পাঠককে।তাঁর অধিকাংশই কবিতা কালোতীর্ণ স্বমহিমায় ভাস্বর।কবি আল মাহমুদের দৃষ্টিতে- ‘কবিতা হল মানব জীবনের সবচেয়ে নিগূঢ় স্বপ্ন, কল্পনার ভাষারূপ, ছন্দবদ্ধ ভাষা। আমি মনে করি কবিতা হল একটা জীবনে নিগূঢ় উপলব্ধি। ছন্দব্ধভাবে সুন্দর ভাষায় উপমা উৎপ্রেক্ষাসহ প্রকাশিত ভাষাই হল কবিতা। যে জীবন আমরা যাপন করতে পারিনা, কিন্তু স্বপ্নে করি। স্বপ্নে আমি চিন্তা করি এইরকমই আছি-এই স্বপ্নটার ভাষার রূপই হলো আসলে কবিতা, যা আমরা শব্দে প্রকাশ করি। বাস্তব জীবন খুবই কষ্টকর, মানুষ এর বাইরে একটা স্বপ্ন দেখে। বাস্তবতার মধ্যে থেকেই কবিতা, মানুষ যেটা স্বপ্ন দেখে তা বাস্তবতাকে ছাড়িয়ে যায়। আর এটা হলেই সেই স্বপ্ন কবিতা রূপ লাভ করে। এটা হল মানুষের একটা পরিশ্রুত জীবনের কল্পনা। পরিশ্রুত মানে জীবনের ছাঁকনি দিয়ে ছেঁকে যে জীবন রস বের হয় সেটাই কবিতা। অভিজ্ঞতা ছাড়া কাব্য হয় না। স্বপ্ন তো অভিজ্ঞতাকে জড়িয়েই তৈরি হয়। এ কারণে অভিজ্ঞতা ছাড়া কোন মহৎ কাব্য সৃষ্টি হয় না।কবিতাই আমার পুঁজি। কবিতার জন্যই যত খ্যাতি ও অখ্যাতি কবিতার জন্যই বাংলাদেশের গ্রামে গঞ্জে ঘুরে বেড়ানো, শহর থেকে শহরে, দেশ থেকে দেশান্তরে উড়াল। কবিতার জন্যই বাংলাদেশে এমন কোন নদী নেই যাতে আমি সাঁতার কাটিনি। নদীর সাথে নারীর উপমা কেন? না, কবিতার জন্যই। মানুষের সাথে মানুষের, এক দেশের সাথে অন্য দেশের, জাতির সাথে অপর জাতির সম্বন্ধে সূত্র খুঁজে বেড়ানো তো কবিতার জন্যেই। আমি পবিত্র কাবার চারিদিকে বারবার তাওয়াফ করেছি। সাফা থেকে মারওয়া পর্বতের দিকে দৌড়ে গেছি। সিজদায় উপুড় হয়ে পড়েছি। আল্লাহর কাছে বলেছি, প্রভু আমি একজন কবি, কবিকে করুনা করো। পবিত্র নগরী মদিনার গলিপথ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে জান্নাতুল বাকির কবরগুলোর পাশ দিয়ে যেতে যেতে আমি কবি হাসসান ইবনে সাবিতের কথা কত ভেবেছি। এই নগরীতেই তো দেড় শতাব্দী আগে বাস করতেন হাসসান। মসজিদুন নবীর মিম্বরে দাঁড়িয়ে তাঁর সদ্য লেখা কবিতায় আল্লাহ ও রাসূলের প্রশংসা করে সাম্য ও মৈত্রীর আহ্বান আবৃত্তি শুরু করতেন। তখন জগতের সেরা মানুষ হযরত মোহাম্মদ সা: পর্যন্ত কবির প্রতি প্রীত হয়ে উঠতেন। হাসসান ইবনে সাবিতের কত অপরাধকে তিনি মার্জনা করেছেন। একবার ইজিপ্টের কপটিক আর্কবিশপ আল্লাহর নবী হযরত মোহাম্মদ সা: এর উদ্দেশ্যে কিছু মূল্যবান মিশরীয় উপহার সামগ্রীর সাথে দুজন কিবতি যুবতীকে উপঢৌকন হিসেবে পাঠান।তাদের একজন উম্মুল মোমেনীন (বিশ্বাসীদের মাতা) মারিয়া কিবরিয়া যাকে আল্লাহর রাসূল স্ত্রী রূপে গ্রহণ করেন।অপরজন শিরিন কিবতিয়া-যাকে নবীকরীম কবি হাসসান ইবনে সাবিতের সাথে বিয়ে দেন তাঁর অসাধারণ কবি প্রতিভার স্বীকৃতি স্বরূপ। সবই তো কবিতার জন্য। আমি কতজনকে হাসসানের কবরটা কোথায় দেখিয়ে দেওয়ার জন্য মিনতি করেছি।কিন্তু কেউ পারেনি।পরে ভেবেছি না থাক, কবির কবরের চিহ্ন,সীমাবদ্ধ এপিটাফে উৎকীর্ণ কবির প্রশংসা, তাঁর কবিতা তো রয়েছে তরঙ্গের ফেনোচ্ছাস নিয়ে।আর তা কাল থেকে কালান্তরে লাফিয়ে পড়ছে।যা গুঞ্জরিত হবে অনাদিকালের মানব-মানবীর হৃদয় কন্দরে।আমি কবি ও কবিতাকে এভাবেই দেখি।আমার কবিতার প্রধান বিষয় হল নারী।আমি একসময় ভাবতাম একজন কবি পুরুষের কাছে নারীর চেয়ে সুন্দর আর কি আছে? না কিছু নেই। পৃথিবীতে যত জাতির কবিতায়,যত উপমা আছে আমি আমার সাধ্যমত পরীক্ষা করে দেখেছি সবই নারীর সাথে তুলনা করেই। দয়িতার দেহের উপমা দিতে কবিরা পৃথিবী নামক এই গ্রহটাকে চষে ফেলেছেন।এমন নদী, পর্বত বা প্রান্তর নেই, যার সাথে কবিরা তাদের প্রেমিকার স্তন, উরু, অলকদাম বা নিতম্বের তুলনা দেননি। এভাবেই মানুষ তার প্রিয় মানবীর রহস্য ও রূপের সাথে প্রকৃতির রহস্য সৌন্দর্যের সম্মেলন ঘটিয়েছেন এবং প্রকৃতির রহস্য উন্মোচন করতে গিয়ে উপনীত হয়েছেন আধ্যাত্মিকতায়, ধর্মে।আমার কবিতার আরেক প্রধান বিষয় হলো প্রকৃতি। আমি নিঃসর্গরাজি অর্থাৎ প্রকৃতির মধ্যে এমন একটা সংযুক্ত প্রেমের মঙ্গলময় ষড়যন্ত্র দেখতে পাই যা আমাকে জগত রহস্যের কার্যকারণের কথা ভাবায়। এক ঝাঁক পাখি যখন গাছ থেকে গাছে লাফিয়ে বেড়ায়। মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে আসে পতঙ্গ ও পিঁপড়ের সারি আর মৌমাছিরা ফুল থেকে ফুলে মধু শুষে ফিরতে থাকে আমি তখন শুধুই এই আয়োজনকে সুন্দরী বলি না বরং অন্তরালবর্তি এক গভীর প্রেমময় রমন ও প্রজনন ক্রিয়ার নিঃশব্দ উত্তেজনা দেখে পুলকে শিহরিত হই। মনে আদিম মানুষের মত অতিশয় প্রাথমিক এক দার্শনিক জিজ্ঞাসা জাগে-কে তুমি আয়োজক? তুমিও কবি? না কবিরও নির্মাতা? তবে তুমি যে অনি:শেষ সুন্দর আমি তার সাক্ষ্য দিচ্ছি। আমার সাক্ষ্য গ্রহণ করো প্রভু। এভাবেই আমি ধর্মে এবং ধর্মের সর্বশেষ ও পূর্ণাঙ্গ বীজমন্ত্র পবিত্র কোরআনের উপনীত হয়েছি।’
‘তোমার সিজদা দেখে এ ঘরের পায়রা ডেকে ওঠে/গম্বুজের ভিতরে যেন দম পায় সুপ্ত এক দরবেশের ছাতি,/কি শীতল শ্বাস পরে! শান্ত শামাদানের সম্পূটে/বাতাসে যেন নিভে গেল ফজরের মগ্ন মোমবাতি।/তুমি কি শুনতে পাও অন্য এক মিনারে আযান?/কলবের ভিতর থেকে ডাক দেয়, নিদ্রা নয়, নিদ্রা নয়, প্রেম/সমুদ্রে খলিয়ে ওযু বসে থাকে কবি এক বিষণ্ণ, নাদান।/সবারই আর্জি শেষ! বাকি এই বঞ্চিত আলেম।/তোমার সালাত শেষে যেদিকে ফেরাও সালাম/বামে বা দক্ষিণে, আমি ওমুখেরই হাসির পিয়াসী,/এখন ও তোমার ওষ্ঠে লেগে আছে আল্লাহর কালাম/খোদার দোহাই বল ও ঠোঁটেই আমি ভালোবাসি।/আমার রোদনে যেন জন্ম নেয় সর্বলোকে ক্ষমা/আরশে ছড়িয়ে পড়ে আলো হয়ে আল্লাহর রহম,/পৃথিবীতে বৃষ্টি নামে, শষ্পে ফুল, জানো কি পরমা/আমার কবিতা শুধু ওই দুটি চোখের কসম।’
কবি আল মাহমুদ লিখেছিলেন, ‘সাম্প্রতিক কবিতার প্রতি আমার গভীর আস্থা ও সন্দেহ ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে। এই জ্বর ছাড়াতে পারে একমাত্র কালের প্রতিভাবান কবিত্ব শক্তি। তেমন কবি আমাদের নেই এটা সত্য নয়। আমি কিছু কিছু লক্ষণে তাদের চিনতে পারলেও দৃঢ়মূল শনাক্ত করার মতো শক্তি আমার কোথায়। আমি আগামীকালকেই ঈর্ষা করি না। জীবনানন্দ দাশ কি জানতেন যে তার মৃত্যুর পর শামসুর রাহমান বা আল মাহমুদ বলে কোনও কবি এসে বাংলা ভাষার মৌচাকে মধু সংযোগ করবে? না জীবনানন্দ তা জানতেন না। তার রচনায় এমন কোনও আশাও ব্যক্ত করে যান নি। নতুনত্বের স্ফুরণ অন্তত কাব্যে চিরকালই অভাবিতপূর্ব- আকস্মিক। প্রতিভাবান কবিত্ব শক্তি তার কালকে জিজ্ঞাসা করে আবির্ভূত হন না এবং কোনও হিসাব দিয়ে কোনও জবাবদিহি করে অস্তমিতও হন না। প্রকৃত কবিতার কবিতার ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত থাকেন এমন কথা আমি সাহিত্যের ইতিহাসে খুঁজে পাইনি। আমি নিজেও নিঃসঙ্গচিত্তে আমার আয়ুষ্কাল অতিক্রম করে যাচ্ছি।’
‘যা আমি নিয়ে এসেছিলাম আমার ভাঙ্গা সুটকেসের ভেতর, তা তো একটি একটি করে আমার জাতিকে আমি দেখিয়েছি। আমার দ্রষ্টব্য দেখে তারা কখনও হাততালি দিয়েছে, কখনও অশ্রুসিক্ত হয়েছে।কাব্য কোনও সময়ই কোনও প্রতিযোগিতার ব্যাপার ছিল না। ঈর্ষার ব্যাপার ছিল না। ছিল আনন্দের বিষয়। ভবিষ্যতেও তাই থাকবে।’
‘কেন জানি মনে হয় আমি যেভাবেই যাই শেষ পর্যন্ত তোমার কাছে গিয়েই পৌঁছুব।/সবাই যেমন বলে মুল্লার দৌড় মসজিদ পর্যন্ত। তুমিই আমার মনজিল।/কী হবে তখন যখন আমার দিশেহারা চোখ তোমাকে দেখতে পাবে?/হাসপাতালের চোখের রোগীদের দেখেছি। অপারেশনের ব্যান্ডেজ খুলতে তাদের সে কী কাঁপুনি।/সত্যি যদি চোখ মেলে কাউকে না দেখে?/আমিও ভয় পাই।/যদি শেষ পর্যন্ত তোমার কাছে গিয়ে না পৌঁছুতে পারি?/ধরো, পৌঁছেও যদি তোমাকে না পাই? /কিংবা আছো কিন্তু আমার সাথে কোনো অজ্ঞাত কারণে দেখা করলে না।/ ভাবো তখন আমার আর কি থাকবে?/যা ফেলে এসেছি তা কোনোদিনই যেমন ফিরে পাবো না/তেমনি সামনে থাকবে, না পাওয়ার অন্ধকার।/ না ফেরার এক দীর্ঘ পথ।/ আর যাপনের অনুপযোগী এক অসহনীয় আয়ুষ্কাল।/দেখো, আমি যা ফেলে এসেছি এর নাম দুঃখ।/আমি যা বহন করে এনেছি এর নাম জ্বালা।/আমার ভার নামাবার জন্য তুমি ছাড়া কেউ কি আছে?…’
কবি আল মাহমুদের সর্বশেষ প্রার্থনা এক আধ্যাত্মিক আকুতির উচ্চারণে মথিত হয়ে জীবনাবেদনকে গ্রথিত করে অন্তিম উপসংহারে। সাফল্য প্রত্যক্ষ করে আত্মিক সফলতার প্রত্যাশায়।কবির মনের বিশ্বস্ত উচ্চারণ-‘কোন এক ভোরবেলা, রাত্রিশেষে শুভ শুক্রবারে/মৃত্যুর ফেরেশতা এসে যদি দেয় যাওয়ার তাকিদ;/অপ্রস্তুত এলোমেলো এ গৃহের আলো অন্ধকারে/ভালোমন্দ যা ঘটুক মেনে নেবো এ আমার ঈদ।/…আমার যাওয়ার কালে খোলা থাক জানালা দুয়ার/যদি হয় ভোরবেলা স্বপ্নাচ্ছন্ন শুভ শুক্রবার।’ কবি আল মাহমুদ পরিতৃপ্তির বিশ্রাম নিতে অনন্ত শূন্যে মিলিয়ে গিয়েছেন।আর আমরা যারা তাঁর গুণগ্রাহী পাঠক তাদেরকে রেখে গেলেন অপরিতৃপ্তির গভীর অন্ধকারে।