সুবিদ আব্দুল্লাহ, টিডিএন বাংলা
রাতের অন্ধকারে যখন নিঃশব্দে নামছে আকাশের ছায়া, তখন মালদার কমলাবাড়ি যদুপুর কচিকাঁচা মিশনে এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের সাক্ষী হয়ে থাকছে সময়। রমজানের পবিত্রতায় ছাত্রীদের জন্য সেহরির আয়োজন করছেন রতন ও বাবলু, আর সন্ধ্যার আলোয় ইফতার সামলাচ্ছেন পিকু ও গৌরাঙ্গ। একপাশে বসে ইফতার করছে মেহেক, শিরিন, চৈতি, তারাময়ী—ধর্মের বিভাজন যেখানে বিলীন, সেখানে হৃদয়ের বন্ধনই প্রধান।
এই অনন্য সম্প্রীতির দৃশ্য দেখতে হাজির হয়েছিলাম মিশনে, ঠিক ইফতারের মুহূর্তে। কচিকাঁচাদের হাসিমুখ, আতিথেয়তার উষ্ণতায় ভরা চারদিক। মাঠের মাঝখানে পরিপাটি করে আসন পাতছেন সবার প্রিয় কৃষ্ণকাকু, সঙ্গে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন ইতিকণা মাসি। যেন এক অপূর্ব মিলনমেলা, যেখানে ধর্মের দেয়াল পেরিয়ে একে অপরের সঙ্গে মিলিত হয়েছে মানুষ হিসেবে, বন্ধুরূপে।
চৈতি জানায়, “প্রতিদিনের ইফতার আমাদের জন্য শুধু খাবারের আয়োজন নয়, এটি আমাদের জানার জানালাও। এখানে এসে আমার সহনাগরিক মুসলিম বন্ধুদের ধর্মীয় অনুশীলন কাছ থেকে দেখার সুযোগ পাচ্ছি। আগে বাবার মুখে শুনেছি, প্রতিবেশীদের কাছ থেকেও পেয়েছি নানা ভুল তথ্য। কিন্তু এখানে এসে বুঝেছি, সহাবস্থানই আসল শিক্ষা।”
তারাময়ী এক গাল হাসি দিয়ে বলে, “আমরা হয়তো রোজা রাখি না, কিন্তু সেহরি-ইফতারে নিয়মিত অংশ নিই। এতে করে শুধু তাদের উপোস থাকার কষ্টই নয়, তাদের আত্মশুদ্ধির যাত্রাকেও অনুভব করতে পারি। আগামীতে কেউ যদি আমাদের মুসলিম বন্ধুদের সম্পর্কে ভুল ধারণা দিতে চায়, আমরা জানিয়ে দেব, সম্প্রীতির আলোয় আমাদের দৃষ্টি উন্মোচিত।”
মিশনের প্রধান শিক্ষক নৌসাদ আলি বলেন, “মালদা বরাবরই সম্প্রীতির জেলা। সেই ঐতিহ্য ধরে রাখতে আমরাও বদ্ধপরিকর। আমাদের শিক্ষার্থীরা যে বন্ধনের দৃষ্টান্ত স্থাপন করছে, তা গোটা সমাজের জন্য শিক্ষণীয়।”
হোস্টেল সুপার সাহেনা পারভিন জানান, “মেহেক নাজের পাশের বিছানায় ঘুমোয় তারাময়ী মণ্ডল। রাত থেকে সকাল অবধি একসঙ্গে থাকা, একসঙ্গে বেড়ে ওঠা, একে অপরের ধর্মীয় রীতি-নীতি কাছ থেকে দেখা—সবটাই তাদের মনকে প্রশস্ত করছে। ধর্মীয় গোঁড়ামির জায়গা নেই এখানে।”
মিশনের ম্যানেজিং ডিরেক্টর মুহাম্মদ জিয়াউল হক বলেন, “আমাদের মিশনের দুটি ক্যাম্পাস—একটি মহবতপুরে, অন্যটি মালদা শহরের কমলাবাড়িতে। এখানে ৭০০ শিক্ষার্থী পড়াশোনা করে, যার মধ্যে ২ শতাংশ হিন্দু সম্প্রদায়ের। আমরা তিরিশ বছর ধরে সম্প্রীতির পাঠ দিয়ে যাচ্ছি, যাতে জাতপাতের বিভেদ শিক্ষার্থীদের মনে জায়গা না পায়।”
মিশনের সম্পাদক জামাল সেখ দৃঢ়তার সঙ্গে জানান, “দেশভাগের আগ থেকেই মালদায় হিন্দু-মুসলমান একসঙ্গে বসবাস করছে। ছোট থেকে ধর্মবিদ্বেষ শেখার সুযোগ পাইনি, বড় হয়েও তা শিখিনি। তাহলে আমাদের ছাত্র-ছাত্রীদের শেখাব কীভাবে?”
কমলাবাড়ির কচিকাঁচারা যেন এক নতুন পৃথিবীর প্রতিচ্ছবি। বসন্তের রমজানে তাদের এই মিলনমেলা শুধু মালদাই নয়, গোটা দেশকে সম্প্রীতির এক অনন্য বার্তা দিচ্ছে। ধনী-গরিব, জাতি-ধর্ম ভুলে মানুষে মানুষে সৌহার্দ্য গড়ে তোলাই যদি হয় শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য, তবে মালদার কচিকাঁচা মিশন তার এক অনন্য নিদর্শন।