ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা, যা মানুষের পার্থিব ও আধ্যাত্মিক জীবনের জন্য সমান গুরুত্ব প্রদান করে। ইসলামে শিক্ষা এবং জীবিকার ব্যবস্থা, উভয়কেই অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। একজন মুসলিমের জন্য জ্ঞান অর্জন ফরজ (অবশ্যক) করা হয়েছে এবং জীবিকা অর্জনের জন্য ব্যবসাকে সুন্নত হিসেবে সুপারিশ করা হয়েছে। নবী করিম (সা.) নিজেও জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ব্যবসা করে অতিবাহিত করেছেন। যা সততা ও বিশ্বস্ততার জন্য এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। আজকের দিনে মুসলমানরা শিক্ষায় পিছিয়ে, ব্যবসায় বিমুখ। ইসলামিক দৃষ্টিভঙ্গি কিন্তু অন্য কথা বলে।
ইসলামিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে যদি আলোকপাত করা হয়, তাহলে দেখা যায়, পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন: “পড়ো তোমার প্রভুর নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন।” (সুরা আলাক: ১) এই আয়াতটি ইসলামের প্রথম অবতীর্ণ নির্দেশ, যা শিক্ষা অর্জনের উপর আলোকপাত করে। ইসলামে শিক্ষাকে শুধু দুনিয়াবি উন্নতির মাধ্যম হিসেবে নয়, বরং আখিরাতের সফলতার জন্যও অপরিহার্য বলে গণ্য করা হয়েছে। নবী করিম (সা.) বলেছেন: “জ্ঞান অন্বেষণ করা প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর জন্য ফরজ।” (ইবনে মাজাহ: ২২৪) তবে ইসলামি শিক্ষার পাশাপাশি দুনিয়াবি জ্ঞানও অর্জনের উপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে, যাতে মানুষ নিজেদের জীবিকা ও সমাজব্যবস্থাকে উন্নত করতে পারে। এক্ষেত্রে মুসলিম সমাজ যতটা আধ্যাত্বিক বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করে পার্থিব জীবনে ব্যক্তি, সমাজ ও কওমের প্রতি তেমন দায়বদ্ধ নয়। এই দায় থেকে অব্যাহতি চেয়ে ইসলাম পরিপূর্ণতা পায় না। তাই ইসলাম দ্বীন ও দুনিয়া উভয়বিধ বিষয়ের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেছে। এই জন্য নবী নিজেই ব্যবসায় যুক্ত হয়েছেন। মুসলিমদের ব্যবসায় যুক্ত হওয়ার জন্য অনুপ্রাণিত করেছেন। তাই ইসলামে ব্যবসার গুরুত্ব অপরিসীম। এটি নবীজির জীবনের বহু মুখী আদর্শের একটি আদর্শ।
ইসলামে ব্যবসা একটি সম্মানজনক পেশা, যা ইসলামে উৎসাহিত করা হয়েছে। নবী করিম (সা.) বলেছেন: “সত্যবাদী ও বিশ্বস্ত ব্যবসায়ী কিয়ামতের দিনে নবী, সত্যবাদী ও শহীদদের সঙ্গে থাকবে।” (তিরমিজি: ১২০৯) তার কারণ নবীজির জীবনে ব্যবসার ভূমিকা অনন্য। তিনি অত্যন্ত সততা ও বিশ্বস্ততার সঙ্গে ব্যবসা পরিচালনা করেছেন। হজরত খাদিজা (রা.)-এর সম্পদ নিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করে তিনি এক উজ্জ্বল উদাহরণ স্থাপন করেন। তার সততা ও ন্যায়পরায়ণতা মক্কার মানুষের কাছে তাকে “আল-আমিন” উপাধিতে ভূষিত করেন।
বর্তমান পরিস্থিতি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়,
বর্তমান বিশ্বে বিশেষ করে ভারত ভূখণ্ডে মুসলমানদের একটি বড় অংশ শিক্ষায় যেমন পিছিয়ে রয়েছে, তেমনি তাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থানকে দুর্বল করে তুলেছে। অন্যদিকে, ব্যবসা-বাণিজ্যে তাদের অনীহা এবং ঝুঁকি গ্রহণে অনাগ্রহও একটি বড় সমস্যা। আসলে ইসলামের শিক্ষাগুলো সঠিকভাবে অনুধাবন ও অনুসরণ করলে এই সমস্যাগুলোর সমাধান সম্ভব।
ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে সমাধানের পথ খুঁজে আমরা আমাদের জীবন ও জীবিকাকে একটি ধারাবাহিক ইসলামী জীবন পদ্ধতি হিসাবে গ্রহণ করতে পারি। এর জন্য মুসলিম সমাজকে ব্যবসায় উৎসাহিত করতে হবে। নবীজির আদর্শ অনুসরণ করে সততা ও ন্যায়পরায়ণতার ভিত্তিতে ব্যবসায় অংশ নেওয়া মুসলিম সমাজের জন্য একটি অনিবার্য বিষয় হিসাবে দেখা দিয়েছে। এযুগে পুঁজি ব্যবস্থায় বৃহৎ ব্যবসা করা সবার পক্ষে সম্ভব নাও হতে পারে। তাই ছোট ব্যবসার উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে। এক দিনে হয়তো বড় শহরে মূল স্থানে ব্যবসা করার সুযোগ তেমন ভাবে হয়ে উঠবে না। তাই গ্রামীণ এলাকার ছোট বা বড় গঞ্জ গুলিতে ছোট ব্যবসা শুরু করা যেতে পারে। এই সমস্ত দোকানে স্বল্প লাভ রেখে কম মূল্যে ভালো মানের পণ্য সরবরাহ করা। এতে মানুষ যদি নিজের এলাকায় বড় শহরের সমান মূল্যে জিনিস পত্র কিনতে পারে তাহলে মানুষ আকৃষ্ট হবে। এতে করে একদিন ব্যবসা বৃদ্ধি পাবে।
এছাড়া যৌথ উদ্যোগ মুসলিম সমাজ একটি স্থায়ী পদ্ধতিগত দিক গুলি বিচার বিশ্লেষণ করে মার্কেট কমপ্লেক্স তৈরি করা যেতে পরে। একই ছাদের তলায় বিভিন্ন ধরনের দোকান স্থাপন করা। যাতে করে মানুষ তার সমস্ত প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র একই কমপ্লেস এসে সংগ্রহ করতে পারে। যেমন, মুদিখানা, কাপড়ের দোকান, ওষুধের দোকান। হার্ডওয়ার সহ একাধিক প্রয়োজনীয় দোকান সমুহ। এখানে থেমে না থেকে মানবিক সুবিধা প্রদান করা দরকার। মার্কেটে প্রস্রাব-পায়খানা ও নামাজের জন্য জায়গা রাখা, যা খরিদ্দারদের আকৃষ্ট করবে।
যাদের হাতে একটু অর্থ আছে তারা ছোট বড় শিল্প স্থাপন করতে পারেন। বড় শিল্প সম্ভব না হলে কুটির শিল্প স্থাপন করা, তেমন সমস্যা হবে না। এতে যেমন নিজের পরিবার চলবে তেমনি কিছু কিছু বেকার যুবক যুবতির কর্মসংস্থান হবে। এটা করতে পারলে চতুর্মুখী সুবিধা পাওয়া যাবে। এক, একটি সুন্নত আদায় হল। দুই, নিজের পরিবারের জীবিকার ব্যবস্থা হলো। তিন, আরোও কিছু ছেলে মেয়েকে জীবিকার ব্যবস্থা করে দেওয়া সম্ভব হল। চার, এতে রাষ্ট্র গঠনে নিজের ভূমিকা স্থাপন করা সম্ভব হল।
এই পরিপ্রেক্ষিতে কোরআন ও হাদিসের নির্দেশনা সুস্পস্ট। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে: “আর আমি কিছু মানুষকে অপর কিছু মানুষের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছি তাদের কাজের মাধ্যমে, যাতে তারা একে অপরের কাছ থেকে কাজ করিয়ে নেয়।” (সুরা যুখরুফ: ৩২) এখানে স্পষ্ট যে, জীবিকা অর্জনের জন্য বিভিন্ন পেশার মধ্যে ব্যবসা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। হাদিসে নবী করিম (সা.) আরও বলেছেন: “তোমাদের কেউ কখনো তার হাতের কাজকে হালাল উপার্জনের চেয়ে উত্তম খাবার খাবে না।” (বুখারি: ২০৭২)
ইসলামে এত সুস্পস্ট নির্দেশ থাকা সত্বেও কেন মুসলিম সমাজ পেছনে পরে আছে। তার জন্য কারণ কি ? দায়ী কে ? সেই বিশ্লেষণে না গিয়ে এটুকু বলা যেতে পারে। বড় দেরি হয়ে গেছে। আর নয়, আজ থেকে কাজ শুরু করা। কেননা, ইসলাম একটি ভারসাম্যপূর্ণ জীবনব্যবস্থার শিক্ষা দেয়। শিক্ষাকে ফরজ করে এবং ব্যবসাকে উৎসাহিত করে এটি মানুষের উন্নতির জন্য একটি পথ দেখায়। পথ দেখায় দেশের কল্যাণের। মুসলমানদের উচিত, শিক্ষায় মনোযোগী হওয়া এবং ব্যবসায়ের প্রতি আগ্রহী হওয়া। নবীজির সুন্নত অনুসরণ করে সৎ ও ন্যায়নিষ্ঠ ব্যবসায় অংশগ্রহণ করলে তা শুধু দুনিয়ার উন্নতি নয়, আখিরাতের সফলতাও নিশ্চিত করবে।
আসুন, আমরা নিজেদের জীবনে এই শিক্ষাগুলো বাস্তবায়িত করি এবং মুসলিম সমাজকে উন্নতির দিকে এগিয়ে নিয়ে যাই