গত শতকের আটের দশকে এসেছিল টম ক্রুজ বা ডাস্টিন হফম্যানের বিখ্যাত ছবি ‘রেইন ম্যান’। ব্যারি লেভিনসন পরিচালিত সেই ছবি শুধু যে বক্স অফিসে তুমুল আলোড়ন ফেলেছিল তাই নয়, একাধিক অস্কার জিতে নিয়েছিল। অবাক বিস্ময়ে আমরা লক্ষ্য করেছিলাম ডাস্টিন হফম্যানের চরিত্রের দিকে, যে এমন কিছু করে ফেলতে পারে, যা আমরা আন্দাজ করতে পারি না। যেমন একটা গোটা টেলিফোন ডাইরেক্টরি মুখস্থ রাখা, ইন্টারনেট-স্মার্ট ফোন প্রাকযুগে, সেই প্রাক-গুগল পৃথিবীতে একটা মানুষ গোটা একটা টেলিফোন ডাইরেক্টরি মুখস্থ রাখছে, সেটা যে কত বড় বিস্ময়ের বিষয় ছিল, আমরা বুঝতাম না। কিন্তু পরে বুঝেছিলাম, ওই ছবিতে ডাস্টিন হফম্যানের চরিত্রটি আসলে অটিজমে আক্রান্ত। অটিজমের কারণেই তাঁর বিভিন্ন ধরনের সক্ষমতা, যে সক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে তার তুতো ভাই, তার সৎ ভাই টম ক্রুজ কোটি কোটি টাকার মালিক হতে চায়। ‘রেইন ম্যান’-এর পরে এসেছে আমির খানের ‘তারে জমিন পর’। কে ভুলে যাবে নন্দকিশোর অবস্তির সঙ্গে নিকুম্ভের সংযোগস্থাপনের সেই অসামান্য চিত্রায়ন? ‘তারে জমিন পর’ যখন ২০০৭ সালে এলো, তখন হয়তো এই বিশেষ মানুষদের নিয়ে চর্চা আর একটু বেড়েছে। আমরা ভাবতে শিখেছি, যে ওই শিশু বা কিশোর কেন আর পাঁচটা বাচ্চার মতো নয়। আর পাঁচজনের বাইরে গিয়ে একটা শিশু বা কিশোরকে বিচার করাটা হয়তো স্বাভাবিক হয়ে উঠছে।
কিন্তু সত্যিই আমরা কতটা শিখলাম ‘রেইন ম্যান’ থেকে ‘তারে জমিন পর’ আসতে আসতে? সেই কথা বোঝার জন্য, বা হয়তো বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে এই শিশু-কিশোররা কীভাবে ইন্টারঅ্যাক্ট করছে বা সংযোগস্থাপন করছে, তা বোঝার জন্য বিনায়ক রুকু ভট্টাচার্যের চিত্রপ্রদর্শনী দেখতে যাওয়াটা জরুরি। সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে যে সমস্ত বাবা-মা তাঁদের বিশেষভাবে সক্ষম ছেলেমেয়েদের বড় করে তুলছেন, তার মধ্যে সুমন ভট্টাচার্য বা সঙ্গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম আমরা এত দিনে অনেকেই জানি। সঙ্গীতার সন্তানের নাম আলপথ আর সুমনের সন্তানের নাম বিনায়ক রুকু ভট্টাচার্য। সুমন এবং সঙ্গীতা সোশ্যাল মিডিয়ায় মাঝে মাঝেই এসে অটিজম সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় শেয়ার করেন। জানানোর চেষ্টা করেন অন্য বাবা-মার সঙ্গে তাঁদের অভিজ্ঞতা। জানি না কতজন বাবা-মা সেই অভিজ্ঞতা থেকে শিখতে পারছেন বা নিজেদের এই ধরনের সন্তান থাকলে তাদের নিজেদের এগিয়ে নিয়ে যেতে প্রতিনিয়ত সাহায্য করছেন। কিন্তু বিনায়ক রুকু ভট্টাচার্য যে শেষ পর্যন্ত একটা আস্ত চিত্রপ্রদর্শনী করে ফেলবেন সেকথাটা তার অভিভাবকরাও চিন্তা করে উঠতে পারেননি! কিন্তু বিনায়ক রুকু সেই অসম্ভব কাজটাই সম্ভব করে দেখিয়েছেন। গোলপার্কে তাই তার প্রদর্শনী ঘুরে দেখাটা এক আলাদা অভিজ্ঞতা।
আমরা যারা শৈশবে ‘রেইন ম্যান’ দেখেছি আর ডাস্টিন হফম্যানের চরিত্রটির কথা মনে আছে কিংবা যারা বড় বয়সে ‘তারে জমিন পর’-এর দর্শিল সাফারির চরিত্রটি দেখতে গিয়েছি, তাদের সবার নিশ্চয়ই মনে আছে, যে ওই ছেলেটি যে আর পাঁচজনের মতো নয়, সেটা বুঝতে কত কষ্ট করতে হয়। আমার নিকট পরিবারের মধ্যে বেশ কয়েকজন অটিজমে ভুগছে বলে জানি, তাদের বাবা-মাদের কত কষ্ট করে বুঝতে হয়েছে, যে তাঁদের সন্তান আর পাঁচজনের মতো নয়। এটা বোঝার পর স্বাভাবিক জীবনে কীভাবে আপনি আপনার সন্তানকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন, কীভাবে বাকি সব জিনিসগুলিকে ধারণ করতে শেখাবেন, তা অবশ্যই একটা নিরন্তর চর্চা এবং অনুশীলনের বিষয়। যদি মনে থাকে, তাহলে আর একবার স্মরণ করে নেবেন, যে ‘তারে জমিন পর’-এ সেই কিশোরটি অবশেষে যখন স্কুলে একজন সহৃদয় শিক্ষককে পেয়েছিল, তখনই সে তার রাগ, দুঃখ, অভিমান সব ভুলে গিয়ে নিজের প্রতিভাকে সামনে তুলে ধরতে পেরেছিল। বিনায়ক রুকুর মা-ও বারেবারে সোশ্যাল মিডিয়ায় লেখেন, যে কীভাবে তিনি তাঁর সন্তানকে অর্থাৎ রুকুকে এই আঁকার মধ্যে দিয়ে আবিষ্কার করেছেন। রুকু যে বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে তার নিজস্ব জগতের সম্পৃক্ততাকে তৈরি করে, তার অনেকটাই তৈরি হয় ছবির মধ্যে দিয়ে। কখনও সেই ছবি কোলাজ, কখনও সেই ছবি আঁকা, আবার কখনও অন্য কিছু। কিন্তু রুকুর কথা আমরা জানতে পারি তার আঁকা ছবির মধ্যে দিয়েই।
আজকের পৃথিবীত যেহেতু অটিজম নিয়ে অনেক সচেতনতা বাড়ছে, সেইজন্যেই এই বিশেষভাবে সক্ষম শিশু কিশোরদেরকে কীভাবে সমাজের সঙ্গে ক্রমাগত সংযোগরক্ষা করানো যায় সেই নিয়ে আলোচনা এবং চর্চাও বাড়ছে। পশ্চিমের দেশগুলি অবশ্যই অনেকটা এগিয়ে। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশেও এই নিয়ে চর্চার বা সামাজিক সুরক্ষা বলয় তৈরিতে কোনও কার্পণ্য নেই। যেমন আমাদের দীর্ঘ মালদ্বীপ বাসের সময় আমরা দেখেছি, যে সেখানে অটিজম নিয়ে কত চর্চা হয় এবং সেখানে অটিজমের মধ্যে দিয়ে জীবন কাটানো শিশু-কিশোরদের জন্য সমাজ বা রাষ্ট্র কত উপযোগী ব্যবস্থা নেয়। ভারতবর্ষ এখনও হয়তো সেভাবে অটিজমকে হ্যান্ডেল করতে বা সমাজের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে পারেনি। কিন্তু সুখের কথা অনেক অভিভাবকই যখন তাদের সন্তানকে চিনতে পারছেন, বুঝতে পারছেন, যে তাঁদের সন্তান আর পাঁচটা শিশু-কিশোরের মতো নয়, তখন নিজের সন্তানকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে তাঁরা নিজেদের মতো করে ছাঁচ ভাঙছেন, ছাঁচ গড়ছেন এবং অন্যদেরও সচেতন করবার চেষ্টা করছেন। সুমন ভট্টাচার্য বা সঙ্গীতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেরকমই অভিভাবক। এটা অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক যে সুমন বা তাঁর স্বামী শেষ পর্যন্ত রুকুর এই প্রদর্শনীর আয়োজনে সমস্ত রকমভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। তাঁরা নিজেরাই বলেছেন, যে তাঁরা ভাবতে পারেননি, যে রুকুর আঁকা ছবি নিয়ে একটা গোটা প্রদর্শনী হয়ে যাবে। তাই এই প্রদর্শনীর নামই ‘এক ঘর রুকুর ছবি’।
ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার নিরিখে বলতে পারি, যদি আপনি মনে করেন, যে অটিজমের পাশে দাঁড়াবেন বা অটিজমে ভোগা শিশু কিশোরদের জন্য সহমর্মিতা দেখাবেন, তাহলে এই প্রদর্শনী দেখতে আসুন। দেখুন বিনায়ক রুকু কীভাবে নিজের জগতের কথা ছবিতে, তার কল্পনায় ফুটিয়ে তুলেছেন, সে আমাদের কোন গল্প বলতে চায়, তার জীবনের কোন গল্প! সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখলে বোঝা যায় আজকাল বিনায়ক রুকুর মতো কিশোর, তরুণ প্রজন্মের নাগরিকরা এমনকি ম্যারাথন দৌড়েও অংশগ্রহণ করছে। তারা চাইছে সমাজের মূলস্রোতের সঙ্গে নিজেদের মেশাতে। আমরা সমাজের যারা তথাকথিত ‘স্বাভাবিক মানুষ’, যাদের সঙ্গে ওদের আসলে তেমন কোনো পার্থক্য নেই, তারা যদি একটু বন্ধুত্বের হাত না বাড়িয়ে দিই, তাদের গুণগুলোর প্রশংসা না করি,তাহলে কীভাবেই বা বিনায়ক রুকুরা ভবিষ্যতের স্বপ্নকে ক্যানভাসে আঁকবে?