আমরা সকলেই কলকাতার ঐতিহাসিক নাখোদা মসজিদের নাম শুনেছি, সেখানে গিয়েছি। কিন্তু মসজিদটির নাম নাখোদা কেন? এর অর্থ কী? কীভাবে তৈরি হল? জানতে আমি আর মাওলানা আব্দুল ওদুদ ভাই চললাম মধ্য কলকাতার জাকারিয়া স্ট্রিট ও রবীন্দ্র সরণির সংযোগস্থলে অবস্থিত নাখোদা মসজিদে। অতীতেও এই মসজিদে গেছি। কিন্তু এবার ইতিহাস জানার জন্য গেলাম।
মসজিদের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য নাসের ইব্রাহিমকে ফোন করলাম। মসজিদে আছেন? আমরা আসছি।
তিনি তাঁর বাড়িতে যেতে বললেন।
আব্দুল ওদুদ ভাইয়ের সঙ্গে পরামর্শ ক্রমে সিদ্ধান্ত হল – নাসের সাহেবের বাড়ি যাওয়ার আগে মসজিদে যেতে হবে। আষাঢ়ের সন্ধ্যা রাতে এই রকম জায়গায় একটু বসে থাকতে বেশ ভালো লাগবে।
নাখোদা মসজিদের গেটের বাইরে স্ক্রিনে ভাসছে বিভিন্ন উপদেশমূলক লেখা। আছে মসজিদ তৈরির কাহিনীও। মূল গেট দিয়ে ভিতরে ঢুকলাম। সমতল ভূমি থেকে একটু উঁচুতে উঠেই দেখতে পেলাম দুটি বড় বড় গোলাকৃতির ওযু খানা। খোলা বারান্দা থেকে মসজিদের চারপাশ দেখার চেষ্টা করলাম। কী অপরূপ সৌন্দর্য! এক মায়াবী আবছা আলোয় সব যেন আলোকিত।
জানা গেছে, মসজিদটিতে ২৭টি মিনার আছে। ১৫১ ফুট উচ্চতা সম্পন্ন তিনটি গম্বুজ এবং দুইটি মিনার ছাড়াও ১০০ থেকে ১১৭ ফুট উঁচু আরো ২৫টি ছোট ছোট মিনার রয়েছে।
নামাজ পড়ে দুই ভাই একটু আড্ডা দিলাম। ততক্ষণে নাসির ভাই ফোন করলেন,’মোকতার হোসেন মন্ডল ভাই, আর কতদূর? তাড়াতাড়ি আসুন। আসতে সমস্যা হলে জানাবেন, আমি গাইড করবো।’
খুব দ্রুত আসছি ভাই।

স্মৃতি বিজড়িত ঐতিহাসিক স্থানটি ছেড়ে আরেক ইতিহাসের জায়গায় যাচ্ছি। নাসের ইব্রাহিম বললেন,’আনন্দবাজার পত্রিকার অফিসের পরেই হলুদবাড়িতে আসুন।’
বহু পুরাতন বাড়িতে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছি।
অনেক বিষয় কল্পনায় ভাসছে।
নাসির ভাই এগিয়ে এলেন।
ঘরে ঢুকে দেখি বিরাট বাড়িটি প্রায় ফাঁকা। ব্রিটিশ আমলে তৈরি। রাত হয়ে যাচ্ছে। গল্প শুরু করলাম।
আচ্ছা ভাই, নাখোদা মসজিদ নামটি কেন হল?
নাসের ইব্রাহিম টিডিএন বাংলাকে বললেন, ওটা একটি গুজরাটি নাম। গুজরাটের কচ্ছের কুচ্চি এলাকা থেকে মুসলিমরা ব্যবসার কাজে সারা পৃথিবীতে গেছেন। অনেকে জাহাজ চালাতেন। তারা এক সময় আর গুজরাত ফেরেননি। এমনকি কেউ কেউ বিভিন্ন দেশের রাজনীতিতে, স্বাধীনতা আন্দোলনে বড় ভূমিকা রেখেছেন। কেউ কেউ ওইসব দেশের রাষ্ট্রপরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছেন। অনেকে ওইসব দেশে বিয়ে শাদী করে থেকে গেছেন।
আবার বহু মুসলিম গুজরাটের ওই এলাকা থেকে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যেও ব্যবসা করতে গেছেন; জাহাজ চালিয়েছেন। তেমনি কিছু কুচ্চি মুসলমান কলকাতার বন্দর এলাকাতেও জাহাজ চালাতেন।
তাদের অনেকে নামাজ পড়ার জন্য মসজিদ তৈরির বিষয়ে ভাবতে থাকেন।
নাসের ইব্রাহিম টিডিএন বাংলাকে আরো বলেন, মসজিদ তৈরির কাজ প্রথম শুরু করেন হাজী জাকারিয়া সাহেব। তিনিই ‘নাখোদা’ নামটি দিয়েছেন। তবে মসজিদের কাজটি শেষ করেন কুচ্চি মেমন জামাত সম্প্রদায়ের সদস্য আবদুর রহিম ওসমান। তিনি নিজেও ছিলেন একজন জাহাজ চালক।
নাখোদা মানে জাহাজের ক্যাপ্টেন বা নাবিক। অর্থাৎ জাহাজের নাবিকদের মসজিদ।
নাসের ইব্রাহিম টিডিএন বাংলাকে জানালেন, জাহাজের নাবিকদের উদ্যোগে মসজিদ তৈরি হলেও স্থানীয় মানুষ সহযোগিতা করেছিলেন। ১৯২৬ সালের ১১ সেপ্টেম্বর এই মসজিদটির কাজ শেষ হয়। তবে তার আগে ৭০ থেকে ৮০ বছর ধরে মসজিদের কাজ চলে। দূর দূর থেকে বহু কষ্টে গ্রানাইড সহ বিভিন্ন জিনিস আনা হয়েছে। সেই সময় এটি তৈরি করতে মোট খরচ হয়েছিল ১৫ লক্ষ টাকা।
বর্তমানে মসজিদ কমিটিতে কয়জন আছেন?
নাসের ইব্রাহিম জানালেন, সাতজন ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য আছি।
তারা কি সবাই গুজরাট থেকে এসেছেন?
তার জবাব,’ হ্যাঁ, আমাদের সবার পূর্বপুরুষ গুজরাতের কুচ্চি থেকে এসেছেন। বলতে গেলে, সেই সময়ের জাহাজ চালকদের মধ্যে যারা মসজিদ কমিটিতে ছিলেন তাদের পরিবার থেকেই আজো ঐতিহ্যগতভাবে ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য হয়ে আসছেন।
এখনো কি আপনাদের আত্মীয় স্বজন গুজরাতে আছে?
নাসের ইব্রাহিম বললেন,’অবশ্যই। শুধু গুজরাট নয়, ভারতের বহু রাজ্যে আছে, এমনকি অন্য দেশেও। যেমন, আমার নানা (মায়ের বাবা) স্যার মোহম্মদ আব্দুর রাজ্জাক ছিলেন মরিশাস- এর ডেপুটি প্রাইম মিনিস্টার এবং তিনি ছিলেন ওই দেশের রাজধানী পোর্ট লুইস এর প্রথম নন ইউরোপিয়ান মেয়র। আজো মরিশাস এর দুশো টাকার নোটে আমার নানার ছবি আছে।

ঐতিহাসিক নাখোদা মসজিদের প্রবেশপথটি ফতেপুর সিকরির বুলন্দ দরজার মতো। ঐতিহ্যবাহী এই মসজিদের ভিতরে সূক্ষ্ম অলঙ্কার এবং শৈল্পিক কল্পনার একটি চমৎকার মিশ্রণ রয়েছে যা তৎকালীন সময়ের শিল্পীদের বিশেষ জ্ঞানের পরিচয় বহন করে।
নাসের ইব্রাহিম টিডিএন বাংলাকে আরো জানান, ‘নাখোদা মসজিদের ছবি যদি ড্রোনের মাধ্যমে উপর থেকে তোলা হয় তাহলে দেখতে অনেকটা জাহাজের মতো লাগবে।’
এবার ঘরে ফিরতে হবে। অনেক রাত হল। শেষ বেলায় প্রশ্ন করলাম,বাঙালি মুসলিম সমাজ এতো পিছিয়ে কেন? এতো হিংসা, মারামারি করে কেন? গুজরাতে অল্প সংখ্যক মুসলমান হয়েও ব্যবসায়, চাকরিতে কীভাবে অতীতকাল থেকে এগিয়ে গেল?
নাসের ইব্রাহিম টিডিএন বাংলাকে সাফ জানিয়ে দিলেন,’শিক্ষা অর্জন করলেই সব হয়ে যাবে, আর কিচ্ছু করতে হবে না। কেরলে একশো শতাংশ শিক্ষিত মুসলিম। সেখানে আজ অনেক কিছু হয়েছে। তাই এখন দিনরাত একটাই কাজ করতে হবে, আর সেটা হল – যেকোন মূল্যে ছেলেমেয়েদের উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করা। সুশিক্ষিত হলেই সচেতন হবে, আর সচেতন হলেই সব হবে।’