মুদাসসির নিয়াজ
জন্মের আগেই বাবা আবদুল্লাহ-কে হারান প্রিয়নবী (সা.)। মাত্র ৬ বছর বয়সে হারান মা’কে। ৮ বছর বয়সে দাদা আবদুল মুত্তালিব-এর ইন্তেকালের পর শিশু-নবীর দায়িত্ব নেন চাচা আবু তালেব। সেই থেকে ৫৫ বছর বয়স পর্যন্ত দীর্ঘকাল নবী (সা.) এর সঙ্গে ছিলেন চাচা আবু তালেব। কুরাইশরা যখন নবী (সা.) এর ওপর চরম অত্যাচার শুরু করে, তখনো এই চাচা তাঁকে ছেড়ে যাননি। নবুয়তের দশম বর্ষের রজব মাসে চাচার ইন্তেকাল হয়। এর ঠিক তিন দিন পর প্রিয়তমা স্ত্রী খাদিজা (রা.)-র ইন্তেকাল হয়।
একের পর এক স্বজন-বিয়োগের দুঃখ নবী (সা.)-এর হৃদয় চৌচির করে দেয়। কষ্টের পর কষ্টের ঢেউ নবী (সা.) এর ওপর আছড়ে পড়ে তাঁর হৃদয় ভেঙে খান খান করে দেয়। একদিকে স্বজন হারানোর বেদনা, অন্যদিকে স্বগোত্রীয়দের বিরোধিতা নবীজি (সা.) এর দাওয়াতি মিশনকে চ্যালেঞ্জের সামনে দাঁড় করায়। নানাবিধ পেরেশানি, সীমাহীন ব্যথা বেদনায় ভারাক্রান্ত নবী (সা.) এর মনঃকষ্ট দূর করার জন্য আরশের মালিক তাঁর প্রিয় হাবিবকে নিজের কাছে ডেকে নিয়ে সান্ত্বনা দেওয়ার উদ্দেশ্যেই সংঘটিত হয় মিরাজ।
আরবি ‘মিরাজ’ শব্দের অর্থ ঊর্ধ্বগমন। মিরাজ হয়েছিল হযরত মুহাম্মাদ (সা.) এর নবুয়্যত প্রাপ্তির একাদশ বর্ষে ২৬/২৭ রজব রাতে, হিজরতের এক-দেড় বছর আগে। শব-এ-মিরাজের রজনীতে মহানবী (সা.) কুদরতিভাবে ঊর্ধ্বাকাশে আরোহণ করেন এবং মহান আল্লাহর সাক্ষাৎ লাভ করেন।
মিরাজে আল্লাহ তাঁকে অনেক নিদর্শন ও মানুষের কর্মকাণ্ডের পরিণাম এবং জান্নাত-জাহান্নাম দেখিয়েছেন। আরশে আজিমের সেই মহাজাগতিক সফর থেকে ফিরে তিনি (সা.) সেসব তাঁর উম্মতের কাছে বর্ণনা করেছেন, যাতে তারা এসব অপরাধ বা গুনাহ থেকে বাঁচতে পারে। মিরাজে তিনি (সা.) কী কী দেখেছিলেন? প্রিয় নবী (সা.) মহান প্রভুর সান্নিধ্যে যাওয়ার পথে প্রত্যেক আসমানে নবী-রাসূলদের সাক্ষাৎ পেয়েছেন, তাঁদের সঙ্গে সালাম ও কুশল বিনিময় করেছেন। এরপর তিনি বায়তুল মামুর যান, যেখানে প্রত্যহ ৭০ হাজার ফেরেশতা প্রবেশ ও প্রস্থান করেন; তাঁরা দ্বিতীয়বার আর আসার সুযোগ পান না। এরপর তিনি সিদরাতুল মুনতাহার কাছে যান। তারপর বায়তুল মামুরে পৌঁছন।
দোযখে যা দেখেছিলেন:
মিরাজে তিনি (সা.) দেখেছিলেন বড় পাথর দিয়ে বে-নামাযীর মাথায় আঘাত করে মাথা ছিন্নভিন্ন করে দেওয়া হচ্ছে, পুনরায় ভাল হয়ে যাচ্ছে, আবারও আঘাত করা হচ্ছে। যারা যাকাত আদায় করেনি, তাদের সামনে ও পেছনে পাওনাদারেরা থাকবে। তারা পশুর মতো চরবে আর নোংরা আবর্জনা, পচা দুর্গন্ধযুক্ত ময়লা, পুঁজ এবং কাঁটাযুক্ত আঠালো বিষাক্ত জাক্কুম ফল ও জাহান্নামের উত্তপ্ত পাথর ভক্ষণ করবে। চোগলখোরদের পার্শ্বদেশ হতে গোশত কেটে তাদেরকেই খাওয়ানো হচ্ছে। গিবতকারীরা অগ্নিময় লোহার নখ দিয়ে নিজেদের চেহারা ও বক্ষ বিদীর্ণ করছে। সুদখোরদের ইয়া বড় পেট, তারা নড়াচড়া করতে পারছে না। তাদের সঙ্গে রয়েছে ফেরাউন সম্প্রদায়, তাদেরকে আগুনে প্রবেশ করানো হচ্ছে। জ্বিনাকার ও বদকার নারী-পুরুষ এবং ভ্রূণ ও সন্তান হত্যা করেছে, তাদের পায়ে আংটা লাগিয়ে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে; তারা কর্ণবিদারী চিৎকার করছে।
এক সম্প্রদায়ের সামনে রয়েছে উপাদেয় তাজা ভুনা গোশত এবং নোংরা পচা মাংস। তারা তাজা সুস্বাদু গোশত ফেলে রেখে নোংরা পচা মাংস ভক্ষণ করছে। ফিরিশতাকুলের সর্দার জিব্রীল (আ.) রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে জানালেন, এরা হল ওইসব পুরুষ, যারা নিজের বৈধ স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও পরনারীর কাছে গমন করেছে এবং ওইসব নারী, যারা বৈধ স্বামী রেখে পরপুরুষগামী হয়েছে। একজন বিশাল লাকড়ির বোঝা একত্র করেছে, যা সে ওঠাতে পারছে না; কিন্তু আরও লাকড়ি তাতে যোগ করছে। জিব্রীল (আ.) রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে জানালেন, এ হল সেই ব্যক্তি, যে মানুষের আমানত আদায় করেনি, খেয়ানত করেছে; বরং আরও অধিক গ্রহণ করেছে।
গালিগালাজ ও ফিতনা সৃষ্টিকারী লোকদের জিহ্বা ও ঠোঁট অগ্নিময় লোহার কাঁচি দিয়ে কাটা হচ্ছে। পুনরায় তা আগের মতো হয়ে যাচ্ছে এবং আবারও তা কাটা হচ্ছে; আর তা এভাবেই চলছে। ছোট্ট একটি পাথর থেকে বিশাল এক ষাঁড় বেরিয়ে এল; পুনরায় ওই ষাঁড় সেই পাথরের ভেতরে প্রবেশের চেষ্টা করছিল; কিন্তু তা সম্ভব হচ্ছিল না। জিব্রীল (আ.) জানালেন, এটা হল সেইসব অহংকারী, যারা বড় বড় দাম্ভিকতাপূর্ণ কথা বলে লজ্জিত হয়, পরে আর তা ফিরিয়ে নিতে পারে না। ইয়াতিমের সম্পদ আত্মসাৎকারীদের ওষ্ঠ-অধর যেন উটের ঠোঁটের মতো। তাদের মুখে আগুনের জ্বলন্ত কয়লা প্রবেশ করানো হচ্ছে এবং তা তাদের পায়ুপথ বা মলদ্বার দিয়ে বের হয়ে আসছে। মদখোর ও নেশাখোরেরা শরীর থেকে নির্গত বিষাক্ত নোংরা পুঁজ পান করছে।
আল্লাহ্ যেসব নসীহত করেছিলেন:
মিরাজের ঐতিহাসিক রাতে মহান প্রভু আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আখেরী নবী (সা.)-কে অনেক কল্যাণকর উপদেশ দিয়েছেন। সেগুলো হল শিরক না করা, মা-বাবার অবাধ্য না হওয়া, অপচয় না করে দান করা, কৃপণতা না করা, সন্তানদের হত্যা না করা, ব্যভিচার না করা, মানুষ হত্যা না করা, ইয়াতিমের সম্পদ ভক্ষণ না করা, ওয়াদা বা অঙ্গীকার-প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করা, ওজন বা মাপে কম না দেওয়া, জ্ঞানহীন কাজ না করা, পৃথিবীতে গর্বভরে চলাফেরা না করা ইত্যাদি।
মিরাজ-কে ‘ইসরা’ নামেও অভিহিত করা হয়েছে। ‘ইসরা’ অর্থ নৈশকালীন ভ্রমণ বা অভিযান। স্থান হিসেবে যার নাম মিরাজ, আর কাল হিসেবে ইসরা। পবিত্র মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসা পর্যন্ত ‘ইসরা’ এবং আল আকসা থেকে ঊর্ধ্বলোক আরোহনকে ইসলামের ইতিহাসে ‘মিরাজ’ বলা হয়। মিরাজে আল্লাহ তার প্রিয় হাবীবকে কত কাছে নিয়েছিলেন কুরআনের বর্ণনা থেকে তা বোঝা যায়: “ফলে তাদের মধ্যে দুই ধনুক পরিমাণ অথবা তার থেকেও অল্প দূরত্ব রহিল” (সূরা নাযম: ৯)। বলাবাহুল্য, এই স্তরে পৌঁছানোর পরেও মানবাত্মা মানবাত্মাই থেকে যায়, সে আল্লাহ্ বা ঈশ্বর বা ভগবান হয়ে যায় না।
সেই বরকতময় রাতে রাসূল (সা.) নিদ্রারত ছিলেন। জিব্রীল (আ.) তাঁর কাছে আসেন এবং ‘বোরাক’ মারফত মিরাজে রওনা হন। সেই সফরে প্রত্যেক আসমানে নবী-রাসূলগণ তাঁকে (সা.) সালাম ও সাদর সম্ভাষণ জানান। রাসূল (সা.) যখন এক আসমান থেকে অন্য আসমানে উঠছিলেন জিব্রীল (আ.) তাঁর জন্য প্রত্যেক আসমানের দরজা খুলে দিচ্ছিলেন। এভাবে ঊর্ধ্ব আরোহণ করতে করতে রাসূল এমন এক স্থানে পৌঁছলেন, যেখান থেকে দপ্তরে কলম চলার আওয়াজ আসছিল। ওই স্থানে স্বলাত বা নামায ফরয হয়। সেখান থেকে রাসূল (সা.) সিদরাতুল মুনতাহায় পৌঁছলেন। জান্নাত, জাহান্নাম চর্মচক্ষে দেখলেন। তাঁর সম্মানে জান্নাতে ফুলের বাগিচাগুলো মধুর সুগন্ধ ছড়িয়ে দেয় এবং জাহান্নামের আগুন নিভে যায়। মিরাজ সফরে জিব্রীল, মিকাইল-সহ ৫০ হাজার ফেরেশতা রাসূল (সা.) এর খিদমতে নিবেদিত ছিলেন।
মিরাজ হল এক ব্যতিক্রমী আসমানী সফর, যা সাধারণ মানুষের সীমিত দুনিয়াবী জ্ঞান দিয়ে উপলব্ধি বা অনুধাবন করা দুরূহ। ওই সফরে চক্ষু দ্বারা দেখার জন্য যেসব শর্ত পূরণ আবশ্যক, সেসব শর্তের যাবতীয় বাধা রাসূল (সা.) এর চক্ষু থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। শ্রবণের সাধারণ নিয়মাবলী অপসারিত হয়েছিল এবং স্থান ও সময়ের সব দূরত্ব সংকুচিত করা হয়েছিল। এরপর বেহেশত থেকে ‘বোরাক’ নামের কুদরতি বাহন পাঠানো হয়। যার গতি ছিল দৃষ্টির শেষ সীমা পর্যন্ত। অর্থাৎ দৃষ্টির শেষ সীমানায় পা ফেলে বোরাক। এটা একটা সাদা রঙের প্রাণী, যা গাধার থেকে বড়, খচ্চরের থেকে ছোট। এতে আরোহন করে তিনি (সা.) চলতে লাগলেন।
বায়তুল মামুরের পাশে আছে সিদরাতুল মুনতাহা বা সর্বশেষ স্টেশন। এর পাশেই আছে জান্নাত। এখান থেকে মহানবী (সা.)-কে আরও উপরে আল্লাহর দরবার পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হয়, তখন জিব্রীল (আ.) বলেন, এবার আপনি একাই যাবেন, আমার পক্ষে আর উপরে যাওয়া সম্ভব নয়, বা অনুমতি নেই। মহানবী (সা.)-কে জান্নাতের সব বিভাগ ঘুরিয়ে দেখানো হয়। একটা ঘর দেখিয়ে জিব্রীল (আ.) বললেন, এই ঘরটা হবে আপনার। নবী (সা.) বললেন, আমাকে এতে একবার প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হোক। সঙ্গী ফেরেশতা বললেন, এখনও আপনার সময় হয়নি, দুনিয়ায় আপনার হায়াত বাকি আছে। এখানে নবী (সা.)-কে কলমে লেখার খসখস আওয়াজও শোনানো হয়। দুনিয়ার শুরু থেকে অনন্তকাল পর্যন্ত যা কিছু ঘটেছে এবং ঘটবে, সেসব কিছুই লওহে মাহফুজে লিখে রাখা হয়, হচ্ছে, হবে। এভাবে মহানবী (সা.)-কে অনেক কিছু দেখানো হয়, জানানো হয়। আল্লাহর সঙ্গে কথা হয়। আবার ওই রাতেই তিনি দুনিয়ায় ফিরে এসে ফযরের নামায আদায় করেন।
উপসংহার:
মিরাজের ঘটনা নবী করিম (সা.)-এর সীরাতের অবিচ্ছেদ্য গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। তাই মিরাজে রাসূল (সা.) নামায-সহ যেসব বিধান সরাসরি আল্লাহর কাছ থেকে এনেছিলেন, সেসব পাবন্দির সঙ্গে পালনে ব্রতী হওয়া উচিত। নিজেদেরকে কেবল আখেরী নবীর উম্মত হিসেবে গর্ব বা দাবি করলেই হবে না, সঙ্গে সঙ্গে রাসূল (সা.)-এর এই মহাজাগতিক সফরে প্রাপ্ত নেয়ামতগুলো আঁকড়ে ধরতে হবে। সর্বোপরি সবরকম গুনাহ থেকে বিরত থাকতে সদা সচেষ্ট হতে হবে – এগুলোই মিরাজের শিক্ষা। আল্লাহ যেন এ ব্যাপারে সহীহ আকিদা পোষণ এবং মিরাজ থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজেদেরকে সংশোধন করে পূর্ণাঙ্গ মুসলমান হওয়ার তাওফীক দান করেন, আমীন।