সেখ খালিদ রহমান
সময় বদলেছে, মানুষ বদলেছে, আমাদের ছোট্ট গ্রাম আধা শহরে পরিণত হয়েছে। আধুনিকতার ছোঁয়ায় গাছপালা কেটে জায়গা করে নিয়েছে উঁচু ভবন, কেরোসিনের স্টোভের জায়গায় এসেছে গ্যাসের চুলা, আর হ্যারিকেনের আবছা আলো হারিয়ে গেছে বৈদ্যুতিক বাতির ঝলমলে উজ্জ্বলতায়। তবু এক বিন্দু স্মৃতি এখনো দোলা দিয়ে যায় হৃদয়ের গহীনে—সেই ছোটবেলার প্রথম রোজার দিনগুলো।
গ্রীষ্মের দাবদাহে যখন গোটা পৃথিবী যেন আগুন হয়ে উঠত, তখনই এসেছিল সেই মাহে রমজান। সেহরির আগে গভীর রাতে মাদ্রাসার মাইকে ভেসে আসত সুমধুর কেরাত আর গজল।
পাড়ার চাচাজি তখন নিয়ম করে সবাইকে ডাকতেন—“আর মাত্র পাঁচ মিনিট বাকি, আপনারা আর ঘুমিয়ে থাকবেন না! সেহরি খেয়ে নিন!” আজও কানে বাজে সেই চিরচেনা ডাক, যদিও সেই চাচাজি অনেক আগেই আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়েছেন।
আমার প্রথম রোজা রাখার ইচ্ছেটা ছিল প্রবল। কিন্তু আম্মাজান আর দাদাজি কিছুতেই রাজি হচ্ছিলেন না। গরমে ছেলেটা কষ্ট পাবে—এটাই ছিল তাঁদের দুশ্চিন্তা। তবুও আমি জেদ ধরে ছিলাম। শেষমেশ একরকম শর্ত দিয়েই ঠিক করলাম, সেহরির সময় না তুললে আমি না খেয়েই রোজা রাখব! আর ঠিক তাই-ই হলো। পরদিন গভীর রাতে আম্মাজি আদর করে ডেকে তুললেন, যেন আমি এক মহাযুদ্ধে নামছি! সেহরির প্লেটে ছিল দুধ-ভাত আর দাদিমার হাতে বানানো মিষ্টি রসকরা—যা এতটাই সুস্বাদু ছিল যে দোকানের কোনো মিষ্টিই তার ধারে-কাছে আসতে পারত না।
কিন্তু দিনের গরমটা ছিল অসহনীয়! দুপুর গড়াতেই শরীর যেন বিদ্রোহ ঘোষণা করল। প্রচণ্ড তৃষ্ণায় গলা শুকিয়ে কাঠ, মাথার ভেতর রোদ্দুর যেন ঢুকে পড়েছে। তবু হাল ছাড়লাম না। কখনো ঘরের কোণে, কখনো পুকুরপাড়ের ছায়ায়, কখনো বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করে সময় কাটালাম। কৌশল ছিল একটাই—গামছা ভিজিয়ে শরীরে জড়িয়ে নেওয়া, যেন তার শীতলতা আমাকে কিছুটা হলেও প্রশান্তি দেয়।
তারপর এলো সেই প্রতীক্ষিত মুহূর্ত। সন্ধ্যার আজানের ধ্বনি যেন আকাশ-বাতাসে এক নতুন প্রাণ জাগিয়ে তুলল। প্রথম ইফতারের প্রথম এক ঢোক পানি গলায় নামাতেই মনে হলো—এটাই কি স্বর্গীয় অনুভূতি? সারাদিনের কষ্ট নিমেষেই ভুলে গেলাম। বাড়ির সবাই আমাকে ঘিরে থাকলেন, আর দাদাজি হেসে হাতে ধরিয়ে দিলেন কয়েক টাকা হাদিয়া। আট আনা,এক টাকা করে হাদিয়া দিলো চাচা চাচিরা। সব মিলিয়ে পাঁচ টাকা! মনে হচ্ছিল, আমি যেন রাজা হয়ে গেছি!
রাতের তারাবির নামাজ ছিল এক স্বপ্নের মতো। তখন মসজিদটা ছিল অনেক দূরে, তাই পুকুরপাড়ের ঈদগাহে হ্যাজাক বাতি জ্বালিয়ে তারাবির ব্যবস্থা করা হতো। কচিকাঁচা বাচ্চারা পেছনে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়তাম, একটু পর ক্লান্ত হয়ে গেলেও হাফেজ সাহেবের সুরেলা তেলাওয়াতে মুগ্ধ হয়ে যেতাম। পুকুরের ওপারে দাঁড়িয়ে থাকত গ্রামের মেয়েরা, বউঝিরা—তাঁরা অপার মুগ্ধতায় তাকিয়ে থাকতেন এই অনিন্দ্যসুন্দর দৃশ্যের দিকে।
আজ সময় বদলে গেছে। এখন বড়সড় তিনতলা মসজিদ হয়েছে, মাইকের ব্যবস্থা হয়েছে, তারাবির জন্য পুরো দোতলা ভরে যায়। কিন্তু ছোটবেলার সেই ঈদগাহের তারাবি, সেই ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক, সেই খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে আল্লাহর দরবারে কান্না ঝরানোর অনুভূতি—সেটা আর কোথাও নেই।
শৈশব একবারই আসে, তারপর হারিয়ে যায় জীবনের ব্যস্ততায়। আমরা বড় হতে হতে কখন যে কৃত্রিমতার মোড়কে ঢেকে যাই, টেরও পাই না। তবু মাঝেমধ্যে সেই সোনালি মুহূর্তগুলো মনে পড়ে, একরাশ নস্টালজিয়া ছুঁয়ে যায় হৃদয়ের গহীন কোণ। মহান আল্লাহ আমাদের এই ছোট্ট প্রচেষ্টাগুলো কবুল করুন, আমাদের হৃদয়ে সেই শৈশবের পবিত্রতাকে ধরে রাখার তৌফিক দিন।
আমীন।