২০২৫-২৬ অর্থবর্ষের জন্য শনিবার কেন্দ্রীয় বাজেট পেশ করেছেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন। এই বাজেট সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেন, দেশের নাগরিকরা কীভাবে বিকাশের অংশ হবেন, তার দিশা রয়েছে বাজেটে। প্রধানমন্ত্রীর কথায়, চারদিক থেকে আয়ের উৎস খুলে দিয়েছে এই বাজেট। তিনি একে জনগণের বাজেট বলে উল্লেখ করেন।
বিজেপির অন্যান্য নেতারাও বাজেটের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। কিন্তু বিরোধী দলগুলো
অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামনের উপস্থাপিত কেন্দ্রীয় বাজেট ২০২৫-এর সমালোচনা করেছেন।
কংগ্রেস সাংসদ রাহুল গান্ধীর মন্তব্য, বুলেটের ক্ষতের জন্য ব্যান্ড-এইড! বিশ্বব্যাপী অনিশ্চয়তার মধ্যে, আমাদের অর্থনৈতিক সঙ্কট সমাধানের জন্য একটি দৃষ্টান্তমূলক পরিবর্তন প্রয়োজন’।
কংগ্রেসের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক জয়রাম রমেশের মন্তব্য, ‘অর্থনীতি চারটি সম্পর্কিত সঙ্কটে ভুগছে – স্থবির প্রকৃত মজুরি, গণভোগে উত্সাহের অভাব, বেসরকারী বিনিয়োগের শ্লথ হার, জটিল এবং জটিল জিএসটি ব্যবস্থা।
কংগ্রেস সাংসদ কুমারী শৈলজা জানান, কৃষকরা ন্যূনতম সহায়ক মূল্য পাননি। ওরা পরমাণু অস্ত্রের কথা বলেছে, কিন্তু হরিয়ানার গোরক্ষপুরে আমাদের পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র (গোরক্ষপুর, হরিয়ানা, অনু বিদ্যুৎ পরিযোজনা) দীর্ঘদিন ধরে রয়েছে এবং দুটোই সেখানে হচ্ছে।
আপ সাংসদ সঞ্জয় সিং ২০২৫ সালের বাজেট নিয়ে হতাশা প্রকাশ করে বলেছেন যে ছোট ব্যবসায়ীরা তাদের ১২ লক্ষ টাকার আয়ের উপর কোনও কর ছাড় পাচ্ছেন না।
ওই নেতা বলেন যে, আপের জাতীয় আহ্বায়ক অরবিন্দ কেজরিওয়াল জিএসটি এবং আয়করের হার অর্ধেক করার জন্য শিল্পপতিদের জন্য মকুব করা ১৬ লক্ষ কোটি টাকার ঋণ আদায়ের পরামর্শ দিয়েছিলেন, যা মধ্যবিত্ত ও সাধারণ মানুষকে ব্যাপক স্বস্তি দেবে, কিন্তু এই প্রস্তাব উপেক্ষা করা হয়েছে।
তৃণমুল কংগ্রেসের সর্ব ভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দোপাধ্যায় বলেন,
‘‘যখন বাংলা থেকে ১৮ জন বিজেপি সাংসদ নির্বাচিত হয়েছিলেন, তখনও বাংলা কিছুই পায়নি। এখনও বাংলার ১২ জন বিজেপি সাংসদ রয়েছেন। কিন্তু তা-ও বাংলা কিছুই পেল না! এই ১২ জন সাংসদ এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদও করবেন না। বাংলা বরাবর বঞ্চিত হয়েছে। এ বারেও তার পুনরাবৃত্তি ঘটল।’’
শনিবার সিপিআইএমের পলিট ব্যুরো বলেছে, ধনীদের ওপর কর বাড়ানোর সুযোগ ছিল। সরকারি বিনিয়োগ বাড়িয়ে কর্মহীনতা কমানো যেত। ন্যূনতম মজুরিরও ব্যবস্থা করা যেত। কিন্তু ঠিক তার উলটো করা হয়েছে। বেসরকারি বিনিয়োগে উৎসাহ দিতে গিয়ে ধনীদের হাতে বাড়তি সম্পদ পুঞ্জীভূত করার ব্যবস্থা হয়েছে।
বিমা ক্ষেত্রে একশো শতাংশ বিদেশি বিনিয়োগের প্রস্তাব রয়েছে বাজেট। পলিট ব্যুরো বলেছে, বিমায় এই প্রস্তাবের পাশাপাশি বিদ্যুৎ ক্ষেত্রে বেসরকারিকরণের লক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। ফলে এই বাজেট ধনীদের তৈরি ধনীদের জন্য।
পলিট ব্যুরো মনে করিয়েছে যে খাদ্য ভরতুকি, কৃষি, শিক্ষা, গ্রামোন্নয়নের মতো ক্ষেত্রগুলিতে খরচ বরাদ্দের তুলনায় কম। প্রকৃত মূল্যে বরাদ্দ স্থির হয়ে রয়েছে। মূল্যবৃদ্ধি এবং জিডিপি’র অংশ হিসেবে আনলে দেখা যাবে সরকারি খরচ এক জায়গায় দাঁড়িয়ে রয়েছে।
পলিট ব্যুরো বলেছে, খাদ্যের ভরতুকিতে গতবার ২.০৫ লক্ষ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছিল। কিন্তু সংশোধিত অনুমান দেখাচ্ছে ৭ হাজার ৮৩০ কোটি টাকা কম খরচ হবে। আর এই বাজেটে বরাদ্দ হয়েছে ২.০৩ লক্ষ কোটি টাকা, যা গতবারের বরাদ্দের চেয়ে কম। শিক্ষার ক্ষেত্রেও ১১ হাজার ৫৮৪ কোটি টাকা কম খরচ হচ্ছে বরাদ্দের তুলনায়। আর এবারের বাজেটে গতবারের সংশোধিত বাজেটের তুলনায় মাত্র ১৪ হাজার ৫৯৬ কোটি টাকা বেড়েছে বরাদ্দ। টাকার অঙ্কেই বৃদ্ধি মাত্র ২.৩ শতাংশ। মূল্যবৃদ্ধি হিসেবে ধরলে কোনও বৃদ্ধিই হয়নি। পলিট ব্যুরো দেখিয়েছে যে স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রেও একই হাল।
পলিট ব্যুরো বলেছে, মনরেগায় সরকারের বরাদ্দ দ্বিচারিতাকে স্পষ্ট করেছে। গ্রামের গরিবের এই অধিকার তার জীবনরেখা। কাজের চাহিদা বাড়া সত্ত্বেও বরাদ্দ ৮৬ হাজার কোটি টাকায় আটকে রাখা হলো। গ্রামের গরিবের ওপর নিষ্ঠুর আঘাতই কেবল নয়, একশো দিন কাজের অধিকারের ওপর বেপরোয়া আক্রমণ। অগ্রাহ্য করা হলে কৃষকের ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য পাওয়ার অধিকারকে। কৃষি সঙ্কট এবং কৃষক আত্মহত্যার সঙ্গে যুক্ত এই বিষয়টিই।
পলিট ব্যুরো বলেছে, তপশিলি জাতির উন্নয়নে ২৭ হাজার কোটি টাকা কম খরচ হয়েছে। আদিবাসী উন্নয়নে ছাঁটাই হয়েছে ১৭ হাজার কোটি টাকা। জনসংখ্যায় এই অংশগুলির হারের তুলনায় গুরুতর মাত্রায় কম খরচের হার। ২০২৪-২৫ অর্থবর্ষে তপশিলি জাতির জন্য মোট খরচের মাত্র ৩.৪ শতাংশ এবং আদিবাসীদের জন্য ২.৬ শতাংশ খরচ করা হয়েছে।
হিন্দিতে একটি পোস্টে মায়াবতী বলেন, দেশে মুদ্রাস্ফীতি, দারিদ্র্য এবং বেকারত্বের প্রচণ্ড প্রভাবের পাশাপাশি রাস্তাঘাট, জল এবং শিক্ষার মতো মৌলিক সুযোগ-সুবিধার অভাবের কারণে, প্রায় ১৪০ কোটি জনসংখ্যার ভারতে মানুষের জীবন বেশ সমস্যাযুক্ত, যা কেন্দ্রীয় বাজেটের মাধ্যমে সমাধান করা দরকার।
সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, “আজ অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন মোদি ৩.০ সরকারের প্রথম পূর্ণাঙ্গ বাজেট পেশ করেছেন। এই বাজেটের প্রেক্ষাপট ছিল বেশ জটিল—খাদ্যের মূল্য বৃদ্ধি, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির স্থবিরতা, চাকরি হারানোর সংখ্যা বেড়ে চলা, রূপির দাম পড়তে থাকা, ভোগ্যপণ্যের চাহিদা হ্রাস, কৃষকদের আন্দোলন এবং বিশ্বজুড়ে অনিশ্চিত পরিস্থিতি। বিশেষ করে নতুন ট্রাম্প প্রশাসন আমেরিকায় সুরক্ষাশীল অর্থনৈতিক নীতি গ্রহণের ঘোষণা দিয়েছে, যা উন্নয়নশীল দেশগুলির রপ্তানিকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। আশা করা হয়েছিল যে সরকার এমন একটি বাজেট পেশ করবে, যা অর্থনৈতিক বৈষম্য কমাতে ধনীদের উপর কর বাড়িয়ে অভাবি মানুষদের জন্য স্বস্তি বয়ে আনবে। কিন্তু সরকার তার ধনীর প্রতি পক্ষপাতমূলক নীতিতে কোনো পরিবর্তন আনতে ব্যর্থ হয়েছে।”
দলটি আরো বলেছে,”বাস্তবের বাজেট এই প্রেক্ষিতকে অবজ্ঞা করেছে। শুধুমাত্র মধ্যবিত্ত শ্রেণী কিছু প্রত্যক্ষ করে ছাড় পেয়েছে। কিন্তু শ্রমিক, কৃষক এবং শ্রমজীবী মানুষের একটি বড় অংশ কোনো স্বস্তি পায়নি। তাদের লড়াইয়ের মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। তাদের জন্য কোন বড় ঘোষণা নেই। নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের উপর জিএসটি কমানো হয়নি, তেমনই কোনো কল্যাণমূলক ব্যবস্থাও ঘোষণা করা হয়নি। কর্পোরেট, ধনী এবং বিত্তশালীদের উপর কর বাড়ানোর রাজনৈতিক ইচ্ছার অভাবে সরকার কল্যাণমূলক, সামাজিক, কৃষি এবং গ্রামীণ খাতে ব্যয় কমিয়ে বাজেটের ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা করেছে।”
বামপন্থী দলটি বিবৃতিতে আরো জানিয়েছে,”সরকার বীমা খাতে ১০০% বিদেশি প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ (এফডিআই) অনুমোদন করেছে, অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী ফসল বীমা যোজনার বরাদ্দ এই বছর ১৫,৬৮৪ কোটি টাকা থেকে কমিয়ে ১,২৪২ কোটি টাকা করা হয়েছে। এটি কৃষক এবং সাধারণ মানুষকে বড় কর্পোরেটগুলির দয়ার উপর ছেড়ে দেওয়ার সাম্প্রতিক উদ্বেগজনক প্রবণতা। “
তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র বলেছেন, ‘‘বিমা ক্ষেত্রে ১০০ শতাংশ প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু ১৮ শতাংশ জিএসটি নেওয়া বন্ধ হচ্ছে না। এই দু’টি বিষয় কি সম্পর্কযুক্ত নয়? এর ফলে কি আন্তর্জাতিক লবি লাভবান হবে না? তাদের সুবিধা করে দিতেই কি এই পদক্ষেপ?’’