জানে আলম
রমজান এলেই স্মৃতির জানালা খুলে যায়। এক অদ্ভুত অনুভূতির ঢেউ বয়ে যায় হৃদয়ের গহীনে। শৈশবের সেই সোনালি রমজানগুলো মনে পড়ে, যখন সারা গ্রাম মিলে এক বৃহৎ পরিবার হয়ে উঠত। তখন ছিল না ডিজিটাল দুনিয়ার কোলাহল, ছিল না সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যস্ততা, তবুও সম্পর্কের বাঁধন ছিল দৃঢ়, হৃদয়ের টান ছিল অকৃত্রিম।
সেহরির সময় ঘুমভাঙা চোখে উঠতে মন চাইত না, কিন্তু রনু মামার ঢোলের শব্দ কানে আসতেই ঘুমের ঘোর কেটে যেত। “ওঠো রে, সেহরি খাও!”—এই ডাক যেন ছিল এক সুরেলা আমন্ত্রণ। উঠোনের চারপাশে আলো জ্বলত, হাঁস-মুরগির কিচিরমিচিরে প্রাণ ফিরে পেত ঘরবাড়ি। মা তখন রান্নাঘরে ব্যস্ত, আগুনের শিখায় ফুটতে থাকা তরকারির ঘ্রাণ বাতাসে মিশে যেত। বাবার ডাক, “তাড়াতাড়ি কর, সময় কম!”—এটাই ছিল সেহরির চিরচেনা দৃশ্য।
রমজানের সবচেয়ে মধুর সময় ছিল ইফতার। গরম গরম বেগুনি-পেয়াজু, খেজুর, মুড়ি, আর ঠান্ডা শরবত—এসব কেবল খাবার ছিল না, ছিল পারিবারিক বন্ধনের প্রতীক। ইফতারের আগে আমরা সবাই মিলে অপেক্ষায় থাকতাম, “আর পাঁচ মিনিট, আর দুই মিনিট”—এরকম হিসাব কষতে কষতেই মাগরিবের আজান শোনা যেত। মুহূর্তেই বাড়ির উঠোনে ঈদের মতো আনন্দ ছড়িয়ে পড়ত।
ছোটবেলায় sporadic (অস্থায়ী) রোজা রাখার অভ্যাস ছিল। “হাফ রোজা” বা “কোয়াটার রোজা” রেখেও আমরা নিজেকে পরিপূর্ণ রোজাদার ভাবতাম! তবে আমার প্রথম সম্পূর্ণ রোজার অভিজ্ঞতা এসেছিল ১৯৯২ সালের মার্চ মাসে, যখন আমি সপ্তম শ্রেণিতে পড়ি। সেই রোজা আনন্দের ছিল, কিন্তু একই সঙ্গে গভীর বেদনারও।
সেই বছর আমি প্রথম টানা একমাস রোজা রেখেছিলাম। এক বিকেলে স্কুল থেকে ফিরে দেখি, বাড়ির পরিবেশ ভারী। সবার চোখে অশ্রু—দাদা আর নেই! দীর্ঘ অসুস্থতার পর তিনি চলে গেছেন, আর সেই দিনই ছিল আমার জীবনের ষষ্ঠ পূর্ণ রোজার দিন। বুকের মধ্যে শূন্যতা অনুভব করছিলাম, কান্না আসছিল, কিন্তু রোজা ভাঙিনি। আত্মীয়-স্বজন প্রতিবেশীরা শরবত নিয়ে এসেছিল রোজা ভেঙে দেওয়ার কথা বলেছিল । মা বললেন, “তোর দাদা খুব খুশি খুশি হয়েছিল তো রোজা রাখার জন্য সে ছোট থেকেই রোজা এ বছর রোজা রাখতে পারেনি খুব আফসোস করলো সে আর কোনদিনই রোজা রাখতে পারবে না । সেদিন বুঝেছিলাম, রোজা কেবল উপবাস নয়, এটি আত্মনিয়ন্ত্রণের এক কঠিন শিক্ষা। সেদিন থেকেই যতঘাত প্রতিঘাত পরীক্ষা সবকিছু ভার কাম করে কোন রোজা বাদ যায়নি ৩৩ বছর ধারাবাহিক রোজা রেখে এসেছি শুধু করোনা কালে করনায় আক্রান্ত হয়েছিলাম বলে ২০২০ সালে রোজা রাখতে পারেনি।
তারাবির নামাজ ছিল অন্যরকম এক অভিজ্ঞতা। প্রথমবার মসজিদে গিয়ে মনে হয়েছিল, নামাজ শেষ হবে না! ছোটরা সুযোগ পেলেই ফিসফিস করে কথা বলত, ইমামের দীর্ঘ কেরাতের মাঝে কখনো হাঁপিয়ে উঠতাম, কিন্তু নামাজ শেষে মনে হতো, যেন এক প্রশান্তির জগতে প্রবেশ করেছি।
গ্রামের সেই রমজান আজ আর নেই। তখন এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়িতে ইফতার পাঠানোর রীতি ছিল, এখন ইফতারের ছবি তোলা হয় বেশি। মসজিদে নামাজ শেষে বড়রা গল্প করতেন, এখন সবাই তাড়াহুড়ো করে বাসায় ফেরে। প্রযুক্তির স্পর্শে অনেক কিছু বদলে গেছে, কিন্তু শৈশবের সেই সোনালি রমজানের স্মৃতিগুলো হৃদয়ের পাতায় অমলিন রয়ে গেছে।
রমজান শুধু উপবাসের মাস নয়, এটি আত্মশুদ্ধির সময়। শৈশবের সরল রোজা, সেহরির ডাক, ইফতারের উচ্ছ্বাস—এসব আজও আমার হৃদয়ে অমর হয়ে আছে। সময় বদলালেও রমজানের মায়া, ভালোবাসা আর শান্তি ঠিক আগের মতোই রয়ে গেছে…