টিডিএন বাংলা: সাপকে কে না ভয় পায়? বিষধর কিংবা বিষহীন, সমস্ত ধরণের সাপেই ভয় আমাদের। যে কোনও দেশের পুরাণে-ই সর্পজাতির একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে। সে গ্রীক-রোমান বা আমাদের হিন্দু পুরাণ, যা-ই হোক না কেন। বিশেষ করে হিন্দু পুরাণে তো দেবতাদের থেকে কম গুরুত্ব পায়নি সাপেরা। অন্যান্য পুরাণে-ও মানুষের পর সাপ ব্যতীত আর কোনও প্রাণী এতটা প্রাধান্য পায়নি। এর অন্যতম কারণ অবশ্যই মানুষের সর্পভীতি। সাপ সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণার সেই অনন্তকাল থেকেই আছে৷ যেমন মনসামঙ্গলে লেখা হয়েছিল কালনাগিনীর কামড়ে লক্ষিন্দর মারা গিয়েছে। সুন্দর দেখতে একটি কালনাগিনী সাপকে ঘাতক বানিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কালনাগিনী একটি নিরাপদ সাপ। আসলে সাধারণ মানুষ তখনও সাপ চিনতেন না আর এখনও চেনেন না। গবেষণায় জানা গিয়েছে, বিশ্বের অধিকাংশ সাপ-ই বিষহীন। তবু তাদের দেখে থরহরিকম্প অবস্থা হয় আমাদের। এমনকি সাপের কামড়ে বিষক্রিয়ায় যত না মানুষের মৃত্যু হয়, তার থেকে বেশি লোক মারা যায় ভয়ে। ভয়েই হৃদযন্ত্র বন্ধ হয়ে যায়।
মনসামঙ্গলে বর্ণিত কালনাগিনীর সঙ্গে কালাচ সাপের আকৃতিগত মিল খুঁজে পাওয়া যায়। এই কালাচ সাপের কামড়ের ঘটনা প্রায়শই ঘটে গ্রাম বাংলায়। আর এই সাপের কামড়ে মৃত্যুর তালিকাও দীর্ঘতর হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাতচরা প্যাঁচা এবং কালাচখেকো শাখামুটি সাপ প্রকৃতি থেকে প্রায় হারিয়ে গিয়েছে। সেই জন্য কালাচ সাপের উপদ্রব বেশি। বর্ষাকালে প্রজনন ঋতুতে একটা মেয়ে সাপের পিছনে তিনটে চারটে পুরুষ সাপ ঘুরে বেড়ায়। অসাবধানতা ও সচেতনতার অভাবে কালাচ সাপের ছোবলের হুমকির মুখে আমরা। কালাচ সাপ সাধারনত রাতের বেলাতেই দেখতে পাওয়া যায়। এই সাপ সাধারণত পরিষ্কার জায়গায় থাকতে পছন্দ করে। গোখরো, কেউটে বা চন্দ্রবোড়ার মতো সাপের কামড় বুঝতে অসুবিধা নেই। কামড়ের জায়গায় প্রচণ্ড জ্বালা যন্ত্রণা, ফুলে যাওয়ার মতো উপসর্গ চিনতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। কিন্তু সবচেয়ে বড় সমস্যা হল কালাচের কামড়। এর কামড় এতোই সুক্ষ্ম যে, বোঝাই যায় না যে সাপ কামড়েছে। নিঃসাড়ে বিষ ঢালে কালাচ। এমনও হয়েছে, গ্রামীণ হাসপাতাল থেকে রেফার হওয়া অজানা রোগে আক্রান্ত রোগী জেলা সদর হাসপাতালে এলেন। তারপর তার মাথায় স্ক্যান করে চিকিৎসকদের সন্দেহ হয়, রোগীকে সাপে কামড়েছে। কিন্তু রোগী বা রোগীর পরিবার বারবারই বলতে থাকেন, সাপে কামড়ায়নি। কিন্তু চিকিৎসকরা যখন দেখলেন যে, রোগীর চোখের পাতা পড়ে আসছে, তখন বুঝতে পারলেন, তাকে কালাচ সাপেই কামড়েছে।
কালাচের কামড়ের উপসর্গ কেমন হতে পারে?
কালাচ সাপ খুবই ভয়ঙ্কর। কালাচ সাপ অজান্তেই বিষ ঢালে। শরীরে এর কামড়ের কোনও চিহ্ন থাকে না। বিছানায় ঘাপটি মেরে থাকে। এই সাপ অধিকাংশ ক্ষেত্রে রাতেই কামড়ায়। মশারি টানিয়ে না ঘুমোলে বিছানায় উঠে এসে ছোবল দিয়ে চলে যায়। কিন্তু বোঝার উপায় থাকে না। অনেক ক্ষেত্রে সকালে উঠে গলা ব্যথা বা পেটে ব্যাথা, শরীর ঝিমঝিম করার মতো উপসর্গ দেখা দেয়। এরপর চোখের পাতা পড়ে আসতে থাকলে নিশ্চিত বোঝা যায় যে, ওই রোগীকে কালাচ সাপে কামড়েছে। কিন্তু এই চোখের পাতা পড়ে আসার লক্ষ্মণ প্রকাশ পেতে বেশ কয়েক ঘণ্টা সময় লাগতে পারে। কাজেই উপরিলিখিত লক্ষণগুলি কোনওভাবেই অবহেলা করা যাবে না।
কোন ধরনের সাপ কামড়েছে, চিকিৎসার ক্ষেত্রে তা জানা কী জরুরি?
একেবারেই নয়। কী সাপ কামড়েছে, তা জানা না থাকলেও চিকিৎসা করা যায়। সাপে কামড়ের পর যে লক্ষণগুলি দেখা দেয়, তার ভিত্তিতেই চিকিৎসা হয়।
সাপে কামড়ালে কী করতে হবে?
রোগীকে হাঁটাচলা বা নড়াচড়া করতে দেওয়া যাবে না। কারণ, হাঁটাচলা করলে রক্ত সঞ্চালন বাড়লে বিষ দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে। রোগীকে সাহস যোগাতে হবে, শান্ত রাখতে হবে।
রোগীকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। মোটরসাইকেল, গাড়ি বা অ্যাম্বুলেন্স-হাতের কাছে যে যানই থাকুক সেই যানে করে রোগীকে দ্রুত সরকারি হাসপাতালে নিয়ে আসতে হবে।
মোটরসাইকেলে গেলে রোগী যেন গাড়ি না চালায়। তাকে মাঝখানে বসিয়ে নিয়ে আসতে হবে। কারণ, রোগীর মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।
সাপে কামড়ালে কী করা যাবে না?
রোগীর হাতে-পায়ে বাঁধন দেওয়ার কোনও দরকার নেই। এতে বিষের ছড়িয়ে পড়া তো আটকানো যায়ই না, বরং তা ক্ষতি করে।
ক্ষতস্থান চিরে বা চুষে বিষ বের করা যায় না।
কোনওভাবেই ওঝার কাছে নিয়ে গিয়ে সময় নষ্ট করা যাবে না। সাপের কাম়ড়ের চিকিৎসার ক্ষেত্রে ‘রুল অফ হান্ড্রেড মিনিটস’ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ, ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যে রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে এসে অ্যান্টি ভেনম দেওয়া গেলে নিশ্চিতভাবেই মৃত্যু এড়ানো সম্ভব হবে।
সাপের কামড় এড়াতে কী ধরনের সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে?
বাড়িতে লঙ্কা পোড়া বা কার্বলিক অ্যাসিড রাখলে সাপ আসবে না বলে অনেকেই প্রচার করছেন। এগুলো কোনও কাজে আসবে না। এটি সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতি। বাস্তবে এর কোনও ভিত্তি নেই। বরং কার্বলিক অ্যাসিড সাপের শরীর স্পর্শ করলে সাপ আরও খেপে যায়। মশারি টাঙানোটাই একমাত্র সঠিক পদ্ধতি। লঙ্কা পোড়াসহ এগুলো সব ফেক। এভাবে কখনও সাপ তাড়ানো যায় না। ফেসবুকে মানুষ এসব না জেনে পোস্ট দিচ্ছেন এবং এগুলো প্রচুর শেয়ার করছেন। এজন্য মানুষ ভুল জিনিসগুলো জানছেন। এগুলো ফলো করতে গেলে মানুষ মারা যাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে।
সাপ থেকে সতর্ক থাকার প্রধান উপায় মশারি টাঙিয়ে ঘুমানো। মশারি শুধু টাঙালে হবে না, মশারি গুঁজে ঘুমাতে হবে। অনেকে আছেন মশারি না গুঁজে ঘুমান, সেটি করলে হবে না। শোওয়ার আগে ভালো করে বিছানা দেখে নিতে হবে।
কোনওভাবেই অন্ধকারে চলাফেরা নয়।
বাড়িতে ইঁদুরের উপদ্রব ঠেকাতে হবে। অনেক সময় ঘরের মধ্যে চাল, ধানের মতো জিনিস রাখা হয়। সেগুলি খেতে আসে ইঁদুর। আর ইঁদুরের পিছু ধাওয়া করে ঢুকে পড়ে সাপ। তাই ঘরে এ সব জিনিস ডাঁই না করে রাখাই ভালো।
বাড়ির সামনে আবর্জনা জমা করা যাবে না। অনেক সময় বাড়ির বাইরে ইট-কাঠ-খড়ের মতো জিনিস জড়ো করে রাখা হয়। এ সব ক্ষেত্রে সরাসরি জমা করা জিনিসে হাত না দেওয়াই ভালো। কোনও কিছু দিয়ে নেড়েচেড়ে নিয়ে তারপর হাত দেওয়াই সমীচিন।
পুকুর বা জলাশয়ের আশপাশ পরিষ্কার রাখা দরকার এবং ওই জায়গাগুলিতে গেলে অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে।
অন্ধকারে অবশ্যই টর্চ ব্যবহার করতে হবে।
সাবধানতা ও সচেতনতাই হল কালাচ সাপ থেকে বাঁচার একমাত্র উপায়।
ঋণস্বীকার – শিক্ষক ও সর্প বিশেষজ্ঞ তরুণ পোদ্দার