আধুনিক মিডিয়া ও আমাদের দায়িত্ব

আনিসুর রহমান

“সত্যিকারের খবর হলো- যা কেউ কোথাও চাপা দিতে চায়, বাকি সব বিজ্ঞাপন। ” – লর্ড নর্থক্লিপ

মূলধারার মিডিয়া তথা সংবাদপত্র, টেলিভিশন বা বেতার, একই সঙ্গে হালের অনলাইন সংবাদ মাধ্যমগুলো ব্যতিরেকে অন্য যে মাধ্যমগুলো থেকে আমরা তথ্য পাচ্ছি বা তথ্য আদান-প্রদানে ব্যবহার করছি তা-ই হলো আধুনিক মিডিয়া। বিকল্প মাধ্যম হিসেবেও এগুলো পরিচিত। আধুনিক মিডিয়ার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল এগুলো ডিজিট্যাল মিডিয়া ও ইন্টারনেট নির্ভর। ২০০৪ সালে যাত্রা শুরু করা ফেসবুক ও ২০০৬ সালে যাত্রা শুরু করা টুইটার( বর্তমানে এক্স) সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও বহুল ব্যবহৃত ডিজিট্যাল মিডিয়ার উদাহরণ। এর সঙ্গে রয়েছে ইনস্টাগ্রাম, ইউটিউব আর লাখ লাখ ব্লগ, অনলাইন পত্রিকা, বিভিন্ন ওয়েবসাইট।

আসলে মিডিয়া তো সমাজেরই আয়না। যুগের পরিবর্তন একেবারে বদলে দিয়েছে মিডিয়ার চালচিত্র। আমাদের চোখের সামনেই দেখলাম প্রিন্ট থেকে টেলিভিশন, সেখান থেকে ওয়েব মাধ্যম। প্রযুক্তির কল্যাণে অর্থাৎ ইন্টারনেট আসায়, দুনিয়াও এসে গেল হাতের মুঠোয়।

মুক্ত অর্থনীতি, পণ্য সংস্কৃতি এবং দেশ ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি মিডিয়াকে প্রবলভাবে প্রভাবিত করবে, সেটাও তো স্বাভাবিক। সেই প্রভাবের তালে তালেই সখ্যতা গড়ে উঠল অন্ধকার দুনিয়ার সঙ্গেও। মোট কথা, একদা যে আদর্শের ভিত্তিতে সংবাদমাধ্যম জন্ম নিয়েছিল মানব সমাজে, তার সংস্করণ, নতুন রূপ বা বিকল্প চাল এখন কতিপয় এমন মানুষের হাতে, যাদের সঙ্গে আর যাই হোক, প্রতিষ্ঠিত নীতি ও আদর্শের কোনো সম্পর্ক নেই।

আধুনিক মিডিয়ার ক্ষেত্রে একটি প্রশ্ন উঠে আসছে, আর তা হলো এখানে সম্পাদকীয় প্রতিষ্ঠান কি প্রিন্ট মিডিয়ার মতো শক্তিশালী ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত? আর সিটিজেন জার্নালিজম বা নাগরিক সাংবাদিকতার কারণে কি সংবাদের কনটেন্টের ওপর সাংবাদিকদের নিয়ন্ত্রণ কমছে? ক্রমশঃ বেড়ে চলেছে এই প্রশ্নের বহর! এসব প্রশ্নের উত্তর দেবেন এই মিডিয়ার মালিক ও সম্পাদকরাই।

তবে এ কথা তো মানতেই হবে, প্রচলিত মিডিয়ার চেয়ে আধুনিক মিডিয়ায় মানুষের অংশীদারিত্ব অনেক বেশি, সে অর্থে তা অনেক বেশি গণতান্ত্রিক। বর্তমানে পত্রিকাগুলোর অনলাইন পাঠক প্রচলিত সার্কুলেশন পাঠকের চেয়ে অনেক গুণ বেশি। পশ্চিমা বিশ্বে ইন্টারনেটের ব্যাপক বিস্তারে বেশ কিছু জনপ্রিয় ও ঐতিহ্যবাহী পত্রিকার প্রিন্ট সংস্করণ বন্ধ হয়ে গেছে। তথ্য আজ শুধু কিছু নির্দিষ্ট সংখ্যক মানুষের সম্পদ নয়। অনলাইনের জনপ্রিয়তায় এমন একটি সময় আসবে যখন মাস মিডিয়া আর ক্লাস মিডিয়া থাকবে না, হয়ে উঠবে সত্যিকারের গণমাধ্যম।

এখন আর আজকের খবরের জন্য পরদিন সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয় না,কয়েক মিনিট বা কয়েক ঘন্টার মধ্যে পাঠক বা দর্শকের কাছে পৌছে যায় । মানুষ এখন তাৎক্ষণিকভাবে খবর চায়। টেলিভিশন আর রেডিও আসার পর পত্রিকা ধাক্কাটা সামলে ছিল সম্পাদকীয় আর বিশ্লেষণী দক্ষতার জোরে। কিন্তু নিউ মিডিয়া দ্রততার সঙ্গে তথ্যই দিচ্ছে না, সমাজের নানা স্তর থেকে নিয়ে আসছে বহুমুখী বিশ্লেষণ।

তবে এটাও সত্য যে অনেক ক্ষেত্রেই এসব মাধ্যম ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারছে না। তাদের উপস্থাপনার ঢং অনেক বিষয়কেই নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করছে। শুধু তাই নয়, গণমাধ্যম কাদের গুরুত্ব দিচ্ছে, সেটাও গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি গণমাধ্যম ও সাহিত্যের বিনিয়োগ কোথা থেকে হচ্ছে, সেটিও গুরুত্বপূর্ণ।

অনলাইনে আমরা প্রতিদিন অনেক তথ্যের সম্মুখীন হচ্ছি। কে ঘরের মধ্যে কী খেল, কে কোন সিনেমা দেখল। একই সঙ্গে অনেক ছবিও গলাধকরণ করছি। আধুনিক মিডিয়ায় এখন হাজারো কণ্ঠের প্রতিধ্বনি শুনতে পাওয়া যায়। এই যে অনুশীলনবিহীন কণ্ঠহীনের কণ্ঠ তাকে কে কেমন ভাবে দেখছে? দর্শক শ্রোতার চোখে কোন কালিমা লেপ্টে যাওয়ার ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে কিনা, এখানে কোনো প্রকার তথ্য আবর্জনার স্তূপে সমাজ ভারাক্রান্ত হচ্ছে কিনা, তা দেখার দায়িত্বও সমাজের। প্রচলিত মিডিয়া ব্যবস্থায় একটা বিশেষ শ্রেণির ঝোঁক থাকলেও আধুনিক মিডিয়াতে ঝুঁকে পড়েছে সব শ্রেণি-সবপেশার মানুষ। আধুনিক মিডিয়ার প্রতি এই আকর্ষণ বিষয়ে বিভিন্ন মিডিয়া ব্যক্তিত্ব তাদের মতামত ও অভিব্যক্তি প্রকাশ করছে।
মূলধারার মিডিয়া একটা শক্তিশালী সম্পাদকীয় নীতিমালা নিয়ে চলে বলে দ্রুত করলেও ভুলের সম্ভাবনা কম থাকে কিন্তু আধুনিক মিডিয়ার ক্ষেত্রে এই প্রবণতা বেশী । প্রশিক্ষণহীন সাংবাদিকদের কাজ এবং ভাষাগত জ্ঞান পারিপার্শ্বিক সমাজ ব্যাবস্থাকে নিয়ে ধ্যান ধারণা ও চিত্র তাদের কাছে পরিষ্কার না থাকায় তারা অনেক ক্ষেত্রে সঠিক তথ্যটি তুলে ধরতে অপারগ হয়।
তাই প্রবেশের মুহূর্তে প্রশিক্ষণ জরুরি। মিডিয়ার সক্ষমতা বাড়াতে প্রশিক্ষণের বিকল্প নেই। এটি কেবল রিপোর্টারদের জন্য নয় , নিউজরুমের প্রত্যেকের জন্য প্রযোজ্য। কেননা প্রযুক্তি প্রতিনিয়তই আপগ্রেড হচ্ছে। প্রশিক্ষণ না দিলে বিষয়টি বুমেরাং হয়ে উঠতে পারে। সাংবাদিকতা নতুন নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। নতুন প্রযুক্তি আত্মস্থ করানোর দায়িত্ব মিডিয়া হাউসগুলো যেমন নেবে তেমনি এই ধারণাগুলোর জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের সিলেবাসে এগুলো অন্তর্ভুক্ত করবে। কেননা প্রাচীনপন্থীরা নতুন যে কোনো কিছু গ্রহণে ‘কালচারালি শকড’ হয়। ফলে নতুনদের মধ্য দিয়ে এটি বেশি গ্রহণযোগ্য করে তুলতে হবে।’ নিউ মিডিয়া আর যাই হোক তাকে প্রাতিষ্ঠানিকতা দিতে তার যথাযথ নিয়মাচার, রীতিনীতি, পদ্ধতি ও মানের আলোকে তার গ্রহণযোগ্যতার ও বৈধতার দিকটার প্রতি আমাদের যত্নবান হওয়া আজ সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে।

সময়ের বিবর্তনে ‘গতানুগতিক’ গণমাধ্যমের ওপর মানুষের নির্ভরতা কমছে। সে জায়গা নিয়ে নিচ্ছে ‘আধুনিক মিডিয়া’ ও অনলাইনভিত্তিক সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলো। এজেন্ডা নির্ধারণের জন্য মানুষ এখন আর গণমাধ্যমের ওপর তেমন নির্ভরশীল নয়। ফেসবুক, টুইটারের মতো সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে তারা নিজেরাই এজেন্ডা ঠিক করে নিতে পারছে। নিজেদের মত প্রকাশ করতে পারছে।’ যুক্তরাষ্ট্রে ২০০৮ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের দুই রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী ফেসবুকের মাধ্যমে নিজস্ব অনুসারী তৈরি করেছিলেন। এ ক্ষেত্রে নিজেদের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যগুলো প্রচারে তারা যতটা না গণমাধ্যমের সহায়তা নিয়েছেন, তার চেয়ে বেশি সহায়তা নিয়েছেন নিজস্ব ফেসবুক পেজের।

হলুদ সাংবাদিকতার রয়েছে একটি হাস্যকর ইতিহাস। তৎকালীন দুই ভূবনবিখ্যাত সাংবাদিকের নাম জড়িয়ে আছে এ ইতিহাসের সাথে। জোসেফ পুলিৎজার ও উইলিয়াম র্যা নডল্ফ হার্স্টের এক অশুভ প্রতিযোগিতার ফসল হলুদ সাংবাদিকতা।

১৮৮৩ সালে নিউইয়র্ক ওয়ার্ল্ড নামে একটি সংবাদপত্র কিনেন পুলিৎজার। পত্রিকাটির আগের মালিক ছিলেন জে গোল্ড।

অন্যদিকে উইলিয়াম হার্স্ট ১৮৮২ সালে ‘দ্য জার্নাল’ নামে একটা পত্রিকা কিনে নেন জোসেফ পুলিৎজারের ভাই অ্যালবার্ট পুলিৎজারের কাছ থেকে। কিন্তু পরিবারের সদস্যের পত্রিকা হার্স্টের হাতে চলে যাওয়ার বিষয়টিকে মানতে পারেননি পুলিৎজার।

শুরু হয় হার্স্টের সাথে পুলিৎজারের স্নায়ুযুদ্ধ। পুলিৎজার নিউইয়র্ক ওয়ার্ল্ড কিনেই ঝুঁকে পড়লেন চাঞ্চল্যকর খবর, চটকদারি খবর ইত্যাদি প্রকাশে। একজন কার্টুনিস্টকে চাকরি দিলেন তার কাগজে। তার নাম রিচার্ড ফেন্টো আউটকল্ট।

ওই কার্টুনিস্ট ‘ইয়েলো কিড’ বা ‘হলুদ বালক’ নামে প্রতিদিন নিউইয়র্ক ওয়ার্ল্ডের প্রথম পাতায় একটি কার্টুন আঁকতেন এবং তার মাধ্যমে সামাজিক অসংগতি থেকে শুরু করে এমন অনেক কিছু বলিয়ে নিতেন, যা ছিলো অনেকটাই পক্ষপাতদুষ্ট।

জার্নাল এবং নিউইয়র্ক ওয়ার্ল্ডের বিরোধ সে সময়কার সংবাদপত্র পাঠকদের কাছে ক্রমেই আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছিলো।

এক সময় হার্স্ট পুলিৎজারের নিউইয়র্ক ওয়ার্ল্ডের কার্টুনিস্ট রিচার্ড ফেন্টো আউটকল্টকে অধিক বেতনের প্রলোভনে নিয়ে এলেন তার ‘জার্নাল’ পত্রিকায়।

হার্স্ট তাতেই ক্ষান্ত থাকেননি, মোটা বেতনের লোভ দেখিয়ে নিউইয়র্ক ওয়ার্ল্ডের ভালো সব সাংবাদিককেও টেনে নেন নিজের পত্রিকায়। বেচারা পুলিৎজার রেগে আগুন। তিনি অগত্যা জর্জ চি লুকস নামে আরেক কাটুনিস্টকে নিয়োগ দেন।

এদিকে জার্নাল, ওদিকে নিউইয়র্ক ওয়ার্ল্ড – দুটো পত্রিকাতেই ছাপা হতে লাগলো ইয়োলো কিডস বা হলুদ বালক কার্টুন। শুরু হয়ে গেলো পত্রিকার কাটতি নিয়ে দুটো পত্রিকার মধ্যে দ্বন্দ্ব।

দুটো পত্রিকাই তাদের হিট বাড়ানোর জন্য ভিত্তিহীন, সত্য, অর্ধসত্য ব্যক্তিগত কেলেংকারিমূলক খবর ছাপা শুরু করলো। এতে দুটো পত্রিকাই তাদের মান হারালো। তৈরী হলো একটি নষ্ট মানসিকতার পাঠকশ্রেণি, যারা সব সময় সুড়সুড়িমূলক, চটকদার, ভিত্তিহীন, চাঞ্চল্য সৃষ্টিকারী, অর্ধসত্য সংবাদ প্রত্যাশা করতো এবং তা পড়ে তৃপ্তি পেতো।

এভাবে জোসেফ পুলিৎজার ও উইলিয়াম হার্স্ট দু’জনেই হলুদ সাংবাদিকতার দায়ে অভিযুক্ত এবং ইতিহাসে চিহ্নিত হয়ে রইলেন।

তখনকার সংবাদপত্রের কার্টুন হলুদ বালকের হাত ধরে আজকের এই হলুদ সাংবাদিকতা।

মিডিয়া সহ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানকেই আর এক মার্কসীয় চিন্তক লুইস আলথুসার বলেছেন ‘ইডিওলজিক্যাল স্টেট অ্যাপারেটাস’। অর্থাৎ মিডিয়ার মাধ্যমে শাসকশ্রেণি মানুষের চিন্তা ও চেতনাকে নিয়ন্ত্রণ করে তাদের আদর্শ ও সাংস্কৃতিক আধিপত্যের স্বার্থে। হারমান ও চমস্কি দেখিয়েছেন কিভাবে সংবাদ মাধ্যম শাসক শ্রেণীর হয়ে মানুষের সম্মতি উৎপাদন করে। শাসকশ্রেণীর স্বার্থে মানুষকে সচেতন করে। যদিও এঙ্গেলস থেকে শুরু করে ফ্রাঙ্কফ্রুট স্কুলের মার্কসীয় চিন্তাকরা এটাকে ফলস কনশাসনেস ( মিথ্যা চেতনা) বলেছেন। অর্থাৎ শাসক শ্রেণীর হয়ে মিডিয়া যে প্রচার করে সেই প্রচারে মানুষ ভুল পথে পরিচালিত হয়, তাতে তাদের কোন স্বার্থসিদ্ধি না হলেও লাভবান হয় শাসক শ্রেণী। ভারতের ক্ষেত্রে এটা ভীষণভাবে প্রযোজ্য। তাহলে যেটা বোঝা যাচ্ছে ‘প্রোপাগান্ডা’, ‘ম্যানুফ্যাকচারিং কনসেন্ট’ এবং ‘হেজিমনি’ – তিনটি শব্দ পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে ওতোপত ভাবে জড়িত। প্রোপাগান্ডার মাধ্যমে ম্যানুফ্যাকচারিং কনসেন্ট হয়। অর্থাৎ মানুষের সম্মতি উৎপাদনে শাসকশ্রেণি প্রোপাগান্ডাকে অস্ত্র হিসাবে কাজে লাগায়। আর মানুষের সম্মতি উৎপাদন হলেই শাসকের হেজিমনি ( আধিপত্য) তৈরি হয়।

রাষ্ট্র ও কর্পোরেট এলিটরা কিভাবে সংবাদমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং সংবাদমাধ্যমগুলোকে দিয়ে তাদের পক্ষে প্রোপাগান্ডা চালায় এটা বোঝাতে গিয়ে হারমান এবং চমস্কি ‘ম্যানুফ্যাকচারিং কনসেন্ট: দ্য পলিটিকাল ইকনমি অফ দা মাস মিডিয়া’ বইতে পাঁচটা ফিল্টারের কথা বলেছেন। এই পাঁচটা ফিল্টার এর মধ্য দিয়ে সমস্ত সংবাদ মাধ্যমগুলিকে যেতে হয় বলে তারা এই বইতে উল্লেখ করেছেন। মূলত আমেরিকান প্রেক্ষিতেই এই পাঁচটা ফিল্টার কে বর্ণনা করলেও এখানে ভারতীয় প্রেক্ষিতেই আলোচনাটা হবে।

প্রথম ফিল্টারটি হল গণমাধ্যমের মালিকানা (Ownership)। ‘কোবরা পোস্ট অপারেশন-১৩৬’-এর তথ্য অনুযায়ী যত বড় মিডিয়া হাউজ তারা ততই হিন্দুত্ব এজেন্ডাকে সমর্থন করে তাদের ব্যবসায়িক স্বার্থে।

হারমান ও চমস্কির দ্বিতীয় ফিল্টারটি হল বিজ্ঞাপন (Advertising)। গণমাধ্যম চালাতে যে বিশাল খরচ হয় তার খুব ক্ষুদ্র অংশই গ্রাহকদের কাছ থেকে আসে।

তৃতীয় ফিল্টারটি হল সংবাদের উৎস (Sourcing)। সংবাদ সংগ্রহের জন্যেও সাংবাদিকদের সরকারি সংস্থা ও কর্পোরেট সংস্থার উপর নির্ভর করতে হয়।

চতুর্থ ফিল্টারটি হল ‘Flak’। হারমান ও চমস্কি ‘Flak’ কে বর্ণনা করেছেন নেগেটিভ রেসপন্স (নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া) হিসাবে। সংবাদ মাধ্যম যদি সরকার বা কর্পোরেট বিরোধী কোনও খবর পরিবেশন করে তাহলে ওই সংবাদমাধ্যমের বিরুদ্ধে নেগেটিভ প্রতিক্রিয়া জানাবে সরকার কিংবা কর্পোরেট সংস্থাগুলি। এবং সেই প্রতিক্রিয়া হতে পারে যেমন শাস্তিমূলক, তেমনই সংবাদ মাধ্যমগুলিকে এক ঘরে করে দেয়ারও প্রচেষ্টা চলতে পারে। এক্ষেত্রে ভারতবর্ষে অনেক উদাহরণ আছে।

ভারতের প্রথম সারির সংবাদ মাধ্যমগুলিতে শুধুই যে সরকার এবং কর্পোরেটের আধিপত্য কাজ করে তাই নয়, নিউজরুমগুলিতে উচ্চবর্ণের কর্তৃত্ব দেখা যায়। এ প্রসঙ্গে রমন ম্যাগসেসাই অ্যাওয়ার্ড জয়ী সাংবাদিক পি সাইনাথ একদা বলেছিলেন, ‘‘ভারতে দলিত রাষ্ট্রপতি, দলিত বিচারপতি, দলিত ডেপুটি প্রাইম মিনিস্টার হয়েছে। কিন্তু প্রথম সারির বৈদ্যুতিন সংবাদমাধ্যমগুলির নিউজরুমগুলিতে দলিত, আদিবাসী প্রতিনিধি খুঁজে পাওয়া বেশ কঠিন।’’

প্রায় বছরখানেক আগে খড়গপুর আইআইটিতে ফাইজান নামে এক ছাত্রেরও মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। এইগুলো নিয়ে মিডিয়ার কোন উচ্চবাচ্য নেই। ‘লোকনীতি’ ও ‘সেন্টার ফর দ্য স্টাডি অফ ডেভেলাপিং সোসাইটি’ যুগ্মভাবে একটি সমীক্ষা করেছিল। যার নাম, ‘ভারতীয় প্রচার মাধ্যম: প্রবণতা ও ধরণ’। সেখানে যে ছবি উঠে এসেছে তা একটি গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের জন্য শুভ নয়। এই জন্যই বিশ্ব ‘প্রেস ফ্রিডম ইন্ডেক্স’-এ ভারতের স্থান ১৬১।

করণীয়

১. সঠিক ও সত্যপরায়ন: মিডিয়া নিজেকে সত্যের পক্ষে রেখে উভয়পক্ষের সংবাদ ও তথ্য প্রদান করতে উদ্যোগী হবে।
২. ভালোবাসার আদালতে থাকা: মিডিয়া মানুষের মধ্যে ভালোবাসার আদালত স্থাপন করবে।
৩. সামাজিক পরিবর্তনে ভূমিকা পালন করা: মিডিয়াকে মানুষের মধ্যে সচেতনতা ও জ্ঞান জাগ্রত করে সামাজিক পরিবর্তনে ভূমিকা পালন করতে হয়।
৪. তথ্য এবং জ্ঞান সরবরাহ করা: মিডিয়া মানুষের মধ্যে তথ্য ও জ্ঞানের দায়িত্ব নিয়ে সত্ত্বরভাবে অবগত করে দেয়। কারিগরি, সামাজিক ও মানবিক উন্নয়নের জন্য মানুষের প্রয়োজনীয় তথ্য প্রদান করবে।
৫. সমাজ পরামর্শ দেওয়া: মিডিয়া সামাজিক পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ পাঠ শেখায়। পরামর্শ দেয়া হয় নেতৃত্ব, তরুণদের।

কৃতজ্ঞতা স্বীকার:

১. নিউ মিডিয়া: সামাজিক প্রভাব ও তাৎপর্য- ড. ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ প্রকাশিত প্রতিদিনের সংবাদ অনলাইনে

২. ভারতীয় মিডিয়ার মাফিয়া গিরি ও ফ্যাসিস্ট প্রোপাগান্ডা- নজরুল আহমেদ জমাদার প্রকাশিত প্রতিপক্ষ অনলাইন

৩. অনলাইন উইকিপিডিয়া

(আনিসুর রহমান ‘অয়ন বাংলা নিউজ’ অনলাইনের সম্পাদক)

Exit mobile version