শৈশব থেকেই উৎসব মুখর আমাদের বাড়ি। ১৯০৫ সালে আমাদের শহরের অনতিদূরে জঙ্গিপুর পৌর সভার অন্তর্ভুক্ত গফুরপুর বরজের নিকটেই গড়ে উঠে মক্তব যা পরবর্তী কালে জুনিয়র ও সময়ের সঙ্গে সঙ্গেই প্রতিষ্ঠা পায় হাই মাদ্রাসা- এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। যাঁর প্রথম পরিচালন সমিতির অন্যতম সদস্য ছিলেন আমার প্রয়াত ঠাকুরদার পিতৃদেব প্রয়াত শচী নন্দন দে। শিক্ষার প্রসারে তিনি তাঁর জীবিত কাল পর্যন্ত প্রতি মাসে সেই সময় দশ টাকা চাঁদা দিতেন। জঙ্গিপুর সাহেব বাজারের সাহেব কুঠির দেওয়ান বাবু শচী নন্দন দে উদার মানসিকতার সমাজ সেবক ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পরে তাঁর দ্বিতীয় পুত্র বাবু মৃণাল কান্তি দে পরিচালন কমিটির সদস্য হন। আমার পিতৃদেব শিক্ষক হিসেবে ওই মাদ্রাসায় দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করেছিলেন।
ভুমিকায় এই প্রতিবেদন লেখার অন্যতম কারণ দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে ভীষণ সদ্ভাব ছিলো। উদারমনা ছিলেন আমাদের পূর্বপুরুষ।
আমাদের প্রতিবেশী ডাক্তার আনিসুর রহমান আমরা যাঁকে কাকা বলতাম, যিনি অভিভাবকের ভূমিকায় থাকার সুবাদে ঈদ ,আমাদের পরিবারে উৎসবের মাত্রা পেয়েছিল।
ঈদুল ফিতর, ইদুজ্জোহা, মহরম আমাদের কাছে পবিত্রতার প্রতীক। এই মাস ইবাদতের মাস। ভোর রাতের সেহরির পর সারাদিন নির্জলা উপবাস। শৈশবে মসজিদে মাইকের প্রচলন ছিলো না। খালি গলায় শুনতে পেতাম আজানের সুমধুর ধ্বনি। যা আমাদের মনে ভক্তির সঞ্চার হতো। বাড়ির কাছে মসজিদ। ঠাকুর দাকে দেখেছি ভক্তিভরে আল্লাহ্তালার উদ্দেশ্যে প্রনতি জানাতে।
আমাদের পরিবারের সঙ্গে মেহের আলীর পরিবারের সখ্যতা ছিলো মধুর। আমার ঠাকুমা মেহের কাকাকে স্নেহ করতেন। পরবে নুতন জামা কাপড় ফল মূল মিষ্টি দিয়ে আপ্যায়ন করতেন। বাড়ির জন্য ছাঁদা বেঁধে দিতেন। মেহের কাকা রাজমিস্ত্রি ছিলেন সারাজীবন । তাঁর ছেলে মেয়েরা আমাদের বাড়িতে এলে আমার মা পর্যন্ত খাতির করে চা জলখাবার দিতেন। সব পরবে আমাদের বাড়িতে তাঁদের অবাধ যাতায়াত ছিলো। ঠাকুর দা বকাঝকাও করতেন। ষাট বছর ধরে আমাদের বাড়িতে যে মিলনের মধুর প্রীতি দেখেছি, তার ইতিহাস আমার বিভিন্ন লেখায় প্রকাশ পেয়েছে। ঈদুল ফিতর, মহরম, কুরবানীর সময়, নজরুল জ্যাঠা, আনিসুর কাকা আমাদের পবিত্র মাংস উপহার দিতেন। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অদ্ভুত মেলবন্ধন আমাদের পরিবারে। কোনোদিন,কোনোভাবেই হিন্দু মুসলিম ভেদাভেদ আমরা দেখিনি। আমাদের কাছে মহান কোরআন মাজিদ গ্রন্থটি আনিসুর কাকা আমার বাবা কে উপহার হিসেবে দিয়েছেন। রামায়ন, মহাভারত, গীতা, বাইবেলের সঙ্গে রাখা আছে পারিবারিক গ্রন্থাগারে।
আমার কাছে রোজা, ঈদ, মহরম পবিত্রতার প্রতীক।
সর্বশেষে এক অজানা ইতিহাসের রোমাঞ্চকর ঘটনার কথা বলে শেষ করবো। প্রায় ৫৫ বছর আগে আমার ঠাকুর দা মন্ত্র তন্ত্র ব্যবহার করে হাত,পা, মচকে যাওয়া, অর্থাৎ জল পড়া খাওয়ানোর রেওয়াজ ছিল। বাচ্ছাদের জল
পড়া খাওয়াতে দেখেছি।
আমি একটু বড় হলে আমার ঠাকুর দা ওই বিশেষ প্রক্রিয়া আমাকে কিছুদিন প্রশিক্ষণ দেন। যে মন্ত্র তন্ত্র উচ্চারণ করেন সেগুলি সম্ভবত আরবি বা উর্দু ভাষায়।
বহুদিন আমি সকাল ও সন্ধ্যায় তেল ও জল পড়া দিতাম শিশুদের এবং যারা চোট পেতেন, ফুটবল খেলতে গিয়ে অথবা নৌকা চালাতে গিয়ে যাদের হাত পা মচকে যেতো। সব বয়সের রোগীদের দুই দিনের মধ্যে সারিয়ে দিতাম- বিনামূল্যে। জঙ্গিপুর সাহেব বাজারে নদীর ধারে আমাদের বাড়ি। নৌকা চালানোর পেশার মাঝি মাল্লারা আসতেন।
এই পবিত্র কাজ থেকে অনেকের রোগ নিরাময় হয়েছে। আমি ও খুশী হতাম।
পরবর্তীকালে পড়াশোনার জন্য বাইরে চলে যাওয়ায় তেল জল পড়া বা ওই চিকিৎসা বন্ধ করতে হয়।
বিজ্ঞন নিয়ে পড়া শুনা করে ব্যাংকে চাকরী করলেও আমি আজও মন্ত্রের ব্যাপারে অবিশ্বাস করি না। আমাকে কেউ কেউ উপহাস, বিদ্রুপ করলেও আমি আমার মত নিয়ে চলি।
আজো আমি দুই সম্প্রদায়ের মানুষের মঙ্গল কামনা করি। ঈশ্বর, আল্লা সকলকে ভালো রাখুন।
এই সময়ে সমাজে রাজনীতির নামে যা চলছে আমি মেনে নিতে পারি না। সকলকে শুভেচ্ছা জানাই। সবাই সংহতি বজায় রেখে শান্তিপূর্ণ ভাবে থাকুন।