ভারতের তিনি একমাত্র প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, যিনি সংখ্যালঘু। শিখ। অথচ তিনি সংখ্যাগুরুর আস্থা অর্জন করে দশ বছর দেশ চালিয়েছেন। এবং তিনি যখন প্রধানমন্ত্রী, তখন গোটা বিশ্ব জুড়ে অর্থনীতিতে ধ্বস নামলেও, খাস মার্কিন মুলুকে পুঁজির বাজারে থরহরি কম্প লেগে গেলেও, মনমোহন সিং সেই আঁচ আমাদের গায়ে লাগতে দেননি। মনে রাখতে হবে, সেই সময় আন্তর্জাতিক বাজারে ব্যারেল প্রতি অপরিশোধিত তেলের দাম ১২০ ডলার ছুঁই ছুঁই হলেও ‘মনমোহনীয় অর্থনীতি’র দৌলতে ভারতের বাজারে পেট্রোল, ডিজেল কিংবা রান্নার গ্যাসের দাম নিয়ন্ত্রণের মধ্যেই ছিল। নিজে অর্থনীতিতে পণ্ডিত ছিলেন, তাই জানতেন তিনি কী করছেন। সেই কারণেই সব সমালোচনার জবাবে আত্মবিশ্বাসী কণ্ঠে তিনি বলেছিলেন, “ইতিহাস হয়তো আমার উপর সদয় হবে”। এবং এই ২০২৪-এর ডিসেম্বর মাস দেখিয়ে দিল, যে ইতিহাস সত্যিই তাঁর অবদানকে মাথায় রেখেছে!
ভারতের ইতিহাসে সংখ্যাগুরু এবং সংখ্যালঘুর বিবাদ নতুন নয়। কিন্তু খুব কম ক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছে যে, সংখ্যাগুরু তার দাবি ছেড়ে দিয়েছে সংখ্যালঘুর ‘সমর্থন’-এ। নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু বৃহত্তর রাজনীতি এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কথা মাথায় রেখে কলকাতার মেয়র পদে বসিয়েছিলেন একজন মুসলিমকে। সেটা স্বাধীনতার আগের কথা। স্বাধীন ভারতবর্ষের ইতিহাসে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতা শহরকে প্রথম একজন সংখ্যালঘু মেয়র দিয়েছেন, ফিরহাদ হাকিম। আর সোনিয়া গান্ধী, যাকে অহরহ ‘বিদেশিনী’ বলে কটাক্ষ সহ্য করতে হয়, তিনি প্রধানমন্ত্রীর কুর্সি ছেড়ে দিয়েছিলেন এমন একজনের জন্য, যিনি হিন্দু নন, শিখ। অর্থাৎ ভারতবর্ষের জনসংখ্যার নিরিখে যিনি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করেন।
সুখের কথা, মনমোহন সিংয়ের জমানায় সোশ্যাল মিডিয়া আজকের মতো ভয়াবহ চেহারা নেয়নি, ‘ট্রোল বাহিনী’ তখনও ‘নবাগত’। আর কঙ্গনা রানাওয়াত তখনও টুইটারে কিংবা সোশ্যাল মিডিয়ায় ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়তে শুরু করেননি। তাই বর্ষীয়ান অর্থনীতিবিদ মনমোহন সিংয়ের গায়ে কেউ ‘খালিস্তানি’ তকমা লাগিয়ে দিতে পারেনি। মনমোহন সিংকে প্রধানমন্ত্রী করে সোনিয়া গান্ধী যদি ১৯৮৪-র শিখ বিরোধী দাঙ্গার ক্ষতে প্রলেপ লাগিয়ে থাকেন, তাহলে মিতবাক, স্বভাব-বিনয়ী মনমোহন সিং দশ বছর ধরে ভারতবর্ষকে চালিয়েছেন গান্ধী পরিবারের আদর্শকে অনুসরণ করেই। ভুল বললাম, আসলে গান্ধীর আদর্শকে অনুসরণ করে। গ্রামীণ মানুষদের রোজগারের জন্য তাঁর ভাবনা কিংবা কঠিন পরিস্থিতিতে অর্থনীতির হাল ধরে রাখার জন্য আসমুদ্রহিমাচল চিরকাল এই ধর্মভীরু শিখ ভদ্রলোককে সশ্রদ্ধ চিত্তে স্মরণ করবে।
সাধারণত মনমোহন সিং সম্পর্কে আলোচনা করতে গেলে আমরা নরসিংহ রাওয়ের জমানায় অর্থমন্ত্রী হিসেবে তিনি যেসব যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, যেভাবে ভারতবর্ষকে উদার অর্থনীতির রাস্তায় হাঁটতে শিখিয়েছিলেন, সেইগুলির কথা বেশি বলি। ভুলে যাই আমেরিকায় যখন ‘মর্টগেজ ক্রাইসিস’-এর পর লেম্যান ব্রাদার ধ্বসে যাচ্ছে, তখন কীভাবে তিনি প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে বসে স্টিয়ারিং ধরে রেখেছিলেন। এবং এই কারণেই রাজনীতির সামান্য ছাত্র হিসেবে আমি চিরকাল সোনিয়া গান্ধীকে কুর্নিশ করব ২০০৪ সালে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মনমোহন সিংকে বেছে নেওয়ার জন্য। বাঙালি হিসেবে আমি সবসময় মনে করি, ১০ নং, জনপথবাসিনী দেশের শীর্ষপদে বসার জন্য প্রণব মুখোপাধ্যায়কে না বেছে একজন যশস্বী শিখ অর্থনীতিবিদকে শীর্ষপদে বসিয়েছিলেন, যা একদম সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল। কারণ, যেভাবে প্রণব-অনুগামীরা চিরকাল বিষয়টাকে দেখানোর চেষ্টা করেন, আসলে মনমোহন সিংকে বাছার পিছনে ‘আনুগত্য’ প্রধান কারণ ছিল না। প্রশ্নটা ছিল যোগ্যতার এবং রাজনৈতিক বোধের। রাষ্ট্রপতি হওয়ার পরও প্রণব মুখোপাধ্যায় নাগপুরে আরএসএসের সদর দফতরে বক্তৃতা দিতে চলে গিয়েছেন আর মনমোহন সিং অসুস্থ, অশক্ত শরীরেও হুইল চেয়ারে বসে রাজ্যসভায় মোদি সরকারের বিরুদ্ধে ভোট দিতে এসেছেন। আরএসএস দফতরে প্রণব মুখোপাধ্যায়, রাজ্যসভায় হুইল চেয়ারে মনমোহন— দুটো আলাদা ফ্রেমই প্রমাণ করে ২০০৪ সালে সোনিয়া গান্ধী কত সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন!
অর্থনীতিবিদ হিসেবে বিশ্বমানের, দক্ষতার দিক থেকে পৃথিবীর যে-কোনও চিন্তাবিদের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারা মনমোহন সিং রাজনীতিতে ‘অজাতশত্রু’ ছিলেন। বৃহস্পতিবার তাঁর মৃত্যুর পর দেখলাম সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে লোকসভায় তাঁর সঙ্গে তৎকালীন বিরোধী নেত্রী, বিজেপির সুষমা স্বরাজের কটাক্ষ এবং পালটা জবাবের ভিডিও। কী আশ্চর্যের বিষয় মনমোহন সিং এবং সুষমা স্বরাজ দুজনেই যথেচ্ছ উর্দু শায়েরি ‘কোট’ করেছেন এবং যার অধিকাংশই মুসলিম কবিদের লেখা! আবারও ভাবছিলাম, আজকের পৃথিবীতে ‘ট্রোল বাহিনী’র উপস্থিতিতে সংসদে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর বিপরীতে গেরুয়া শিবিরের নেত্রী মুসলিম কবিদের উর্দু শায়েরি ‘কোট’ করছেন, এইরকম হলে সোশ্যাল মিডিয়ায় কত ধরনের বিষাক্ত তির ছুটে আসত! বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর, সুষমা স্বরাজের মৃত্যুর পর মনমোহন সিং সংসদে দাঁড়িয়েই তাঁর এবং তৎকালীন বিরোধী নেত্রীর কটাক্ষ এবং পালটা জবাবের গল্পকে মনে করিয়ে দিয়ে প্রাক্তন বিদেশ মন্ত্রীর প্রয়াণে শোকপ্রকাশ করেছিলেন।
এই বিষয়ে কোনও সন্দেহ থাকা উচিত নয়, চন্দ্রশেখরের প্রধানমন্ত্রীত্বের কালে যখন ভারতবর্ষকে সোনা বন্ধক রাখতে হয়েছিল, তারপরে মনমোহন সিং এক নতুন ভারতীয় অর্থনীতির জন্ম দেন। যা হয়তো গত তিন দশকে আমাদের বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ অর্থনীতি হতে সাহায্য করেছে। ‘মনমোহনীয় অর্থনীতি’র গুণাগুণ বুঝতে শুধুমাত্র টানা কত বছর তিনি জিডিপিকে সাতের উপরে রেখেছিলেন, সেইটুকু বললে হবে না। আমাদের বুঝতে হবে, গত তিন দশকে ভারতবর্ষে মধ্যবিত্তের যে বিকাশ ঘটেছে, দারিদ্র সীমার নিচে থাকা লোকেরা যে ‘স্বপ্ন’ দেখতে শুরু করেছে, তার কারিগর ছিলেন তিনি। একটা নিয়মতন্ত্রে আটকে থাকা রাষ্ট্রকে কীভাবে পক্ষীরাজের ঘোড়ায় সওয়ার করানো যায়, মনমোহন তাঁর মেধা দিয়ে সেটা দেখিয়েছিলেন। বাড়ি-গাড়ি কেনার জন্য মধ্যবিত্ত ঋণ পেতে শুরু করল, ‘স্বাস্থ্যবীমা’ বলে শব্দটির সঙ্গে আমরা পরিচিত হলাম, পশ্চিমী গণতন্ত্রগুলির মতো ‘নাগরিক জীবন’ বা ‘নাগরিক পরিষেবা’ হুড়মুড়িয়ে ভারতবর্ষে ঢুকে পড়ল। মনমোহন সিং তাই গত শতকের এক ‘জাদুকর’-এর নাম, যা আম ভারতীয়র জীবনকে বদলে দিয়েছিল। মনমোহন জমানায় কংগ্রেস সরকারের অন্যতম স্তম্ভ পি. চিদম্বরম দেখলাম স্মরণ করতে গিয়ে মনে করিয়েছেন, ‘মনমোহনীয় অর্থনীতি’ কীভাবে ভারতীয় শেয়ার বাজারকে দাঁড় করিয়েছিল। চিদম্বরমের স্মৃতিচারণ পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিল, মনমোহন সিং শেয়ার বাজারকে দাঁড় না করালে আজকের ভারতবর্ষে গৌতম আদানি ফুলে ফেঁপে উঠতে পারতেন কি? ‘ভক্তকুল’ যদি সেটা বোঝেন! নরেন্দ্র মোদি হয়তো সেটা জানেন। জানেন এবং বোঝেন বলেই তাঁর সরকারের তরফে মনমোহন সিংকে শ্রদ্ধা জানাতে কোনও ‘কসুর’ করা হয়নি।