পুঁজিবাদ আজকের পৃথিবীর অর্থনৈতিক কাঠামোকে নিয়ন্ত্রণ করছে। এটি সম্পদের অসামঞ্জস্য, বৈষম্য, এবং শোষণের একটি সামাজিক কাঠামো তৈরি করেছে। অপরদিকে, ইসলাম শুধু একটি ধর্ম নয়, এটি একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। ইসলামে অর্থনৈতিক নীতিমালার গুরুত্ব অপরিসীম, যা কোরআন ও হাদিসের মাধ্যমে সুস্পষ্টভাবে নির্ধারিত। ইসলামের অর্থনীতি ন্যায়, সাম্য, এবং মানবিকতার উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার চাবিকাঠি সুদ এবং মুনাফা যেখানে কেন্দ্রীয়, ইসলাম সেই ভিত্তি বাতিল করেছে এবং বিকল্প একটি ব্যবস্থা প্রস্তাব করেছে।
ইসলামে অর্থনীতির মূলনীতি
এই আলোচনায় প্রশ্ন উঠে, “ইসলামের অর্থনীতি আছে কি নেই?” ইসলামের অর্থনীতি তিনটি মূল স্তম্ভের উপর দাঁড়িয়ে রয়েছে:
১.উৎপাদন: সম্পদ সৃষ্টির মাধ্যমে সমাজের প্রয়োজন মেটানো।
২.বণ্টন: সম্পদের ন্যায্য বণ্টন।
৩.ব্যবহার: সম্পদের মানবিক ও কল্যাণমুখী ব্যবহার।
কোরআন বলছে:”আল্লাহ তা’আলা সম্পদকে তোমাদের মাঝে কিছু সংখ্যক মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে চান না।”
(সূরা আল-হাশর: ৭)
ইসলাম ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকারকে স্বীকৃতি দেয়, তবে সেই সম্পত্তি সমাজের কল্যাণে ব্যবহার করার নির্দেশনা দেয়। এভাবে, এটি ব্যক্তিগত মালিকানা ও সামাজিক ন্যায়বিচারের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে।
যাকাত: ইসলামের সামাজিক ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার হাতিয়ার
“যাকাত পূর্ণভাবে আদায় হলে মানব সমাজের লাভ কী?” যাকাত ইসলামের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এটি এক প্রকার বাধ্যতামূলক কর, যা ধনী ব্যক্তিদের সম্পদের একটি নির্দিষ্ট অংশ গরীব ও অভাবগ্রস্তদের জন্য নির্ধারিত। কোরআনে বলা হয়েছে: “তাদের সম্পদ থেকে দান গ্রহণ কর, যাতে তুমি তাদের পবিত্র করতে এবং পরিশুদ্ধ করতে পার।” (সূরা আত-তাওবা: ১০৩) যাকাতের মাধ্যমে:
১. দরিদ্রদের মৌলিক প্রয়োজন পূরণ হয়।
২. সম্পদের অসমতা হ্রাস পায়।
৩.সামাজিক সম্পর্ক মজবুত হয়। হাদিসে উল্লেখ আছে: “যে সমাজে কেউ অভুক্ত থাকবে, সেখানে ধনী ব্যক্তি তার সম্পদ নিয়ে নিরাপদ থাকতে পারবে না।” (তিরমিজি)
সুদ ও ঘুষ: ইসলামে হারাম কেন?
সুদ পুঁজিবাদের কেন্দ্রীয় উপাদান। কিন্তু ইসলামে সুদকে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। “যারা সুদ খায়, তারা সেই ব্যক্তির মতো, যাকে শয়তান স্পর্শ করে পাগল করে দিয়েছে।”
সুরা আল বাকারা: ২৭৫
এই সুদের ফলে সমাজে যা ঘটে:
১.সম্পদ ধনীদের হাতে কেন্দ্রীভূত হয়।
২. সমাজে অর্থনৈতিক বৈষম্য বাড়ে।
৩.নৈতিক অবক্ষয় ঘটে।
ইসলাম সুদের বিকল্প হিসেবে মুনাফাভিত্তিক অর্থনীতি প্রবর্তন করেছে, যেখানে ব্যবসায়ের মাধ্যমে লাভ অর্জিত হয়।
ফিতরা ও সদকা: মানবিক সাহায্যের উৎস
“ফিতরা ও সদকার ভূমিকা কী?”
ফিতরা ঈদুল ফিতরের আগে গরিবদের জন্য একটি বিশেষ দান। এটি ন্যূনতম খাদ্য বা অর্থের মাধ্যমে সমাজের দরিদ্রদের সহায়তা করে। অন্যদিকে
সদকা হচ্ছে স্বেচ্ছাপ্রণোদিত দান। হাদিসে এসেছে:
“সদকা অভাব দূর করে এবং বিপদ থেকে রক্ষা করে।” (মুসলিম)
ইসলামিক ব্যাংকিং: পুঁজিবাদের বিকল্প
“ইসলামিক ব্যাংকিং সিস্টেম কি পুঁজিবাদের শত্রু?”
ইসলামিক ব্যাংকিং সুদবিহীন একটি পদ্ধতি। এখানে বিনিয়োগ মুনাফা ও ক্ষতির ভিত্তিতে হয়। এর ফলে অর্থনীতিতে:
১. ন্যায্য বণ্টন নিশ্চিত হয়।
২. অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকে।
৩. সমাজে সুদের কারণে সৃষ্ট শোষণ বন্ধ হয়।
আধুনিক সমাজে ইসলামিক অর্থনীতির প্রয়োগ
ইসলামে এমন করের ব্যবস্থা রয়েছে, যা সম্পদ পুনর্বণ্টনে সহায়ক। উদাহরণস্বরূপ:
১. খরাজ: কৃষিজমির উপর কর।
হাদিসে এসেছে: “যে ব্যক্তি তার সম্পদ থেকে আল্লাহর পথে খরচ করে, তার জন্য সাতশতগুণ পুরস্কার নির্ধারিত।” (বুখারি ও মুসলিম)
পুঁজিবাদের সাথে ইসলামের বিরোধ
পুঁজিবাদ ব্যক্তিগত লাভের উপর ভিত্তি করে, যেখানে সমাজের কল্যাণ ততটা প্রাধান্য পায় না। ইসলাম এই ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করে সাম্য, ন্যায় এবং মানবিকতার ভিত্তিতে একটি স্থিতিশীল অর্থনৈতিক কাঠামো তৈরি করে। তাই চমস্কির মতো চিন্তাবিদরাও বলেছেন: “ইসলাম পারে পৃথিবীর অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমস্যার সমাধান দিতে, যদি মুসলিমরা প্রকৃত ইসলামের অনুসরণ করে।”
তাই পরিশেষে বলা যায় ইসলামের অর্থনীতি একটি ন্যায়সংগত ব্যবস্থা, যা সম্পদকে সুষ্ঠুভাবে বণ্টন এবং ব্যবহারের উপর জোর দেয়। এটি এমন একটি পদ্ধতি, যা মানবজাতিকে পুঁজিবাদের শোষণ থেকে মুক্তি দিতে পারে। বর্তমান সমাজে ইসলামের এই অর্থনৈতিক নীতিমালা প্রয়োগ করা হলে দারিদ্র্য, বৈষম্য এবং শোষণের অবসান ঘটবে। “নিশ্চয়ই আল্লাহ ন্যায়, সদাচরণ এবং আত্মীয়দের অধিকার প্রদানের নির্দেশ দেন।” (সূরা আন-নাহল: ৯০)
ইসলামের মূলনীতি যদি যথাযথভাবে অনুসরণ করা হয়, তবে পৃথিবী এক নতুন আলো দেখতে পাবে।