বক্তা

মুহাম্মদ জিকরাউল হক, টিডিএন বাংলা:

দীর্ঘদিন ভাড়াবাড়িতে থাকার পর একটা নিজের বাড়ি করার তাগিদ অনুভব করলেন শামসুল আলম। পনের বছর হয়ে গেল এই জেলায় এসেছেন চাকরি সূত্রে। আজ ট্রান্সফার হবে, কাল ট্রান্সফার হবে, এই করে এতদিন পার করে দিলেন কিন্তু ট্রান্সফার আর হল না। চাকরির এখনো আঠারো বছর বাকি। অত বছর তো আর ভাড়ায় থাকা যায় না! অগত্যা সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেললেন বাড়ি করার। তার জন্য চাই একটা মনের মতো জায়গা। হন্যে হয়ে জায়গার খোঁজ করতে লাগলেন।

শহরের যে এলাকায় তিনি আছেন তারই আশপাশে বাড়ি করে থাকতে পারলে ভালো লাগবে। সবার সাথে এতদিনের পরিচয় তাঁর। অন্য এলাকায় গেলে আবার নতুন করে পরিচিত হতে সময় লাগবে। তিনি কয়েকজনকে বললেন মনের ইচ্ছের কথা। যাদের বিক্রি করার মতো জায়গা আছে তাদের সাথে দেখা করলেন। কেউ জানালেন, বিক্রি করবেন না। কেউ বা জানালেন, বিক্রি করবেন তবে এখন নয়, পরে। যে জায়গার খোঁজ পাচ্ছেন সেটা হয় ছোটো, নচেৎ অনেক বড়ো। বড়ো জায়গা কেনার সামর্থ তাঁর নেই। স্কয়ার হলে চার শতক জায়গাই যথেষ্ট। জায়গা কিনতে সব টাকা চলে গেলে বাড়ি করবেন কী দিয়ে!

মাঝে মধ্যেই খবর পান আর ছুটে যান জায়গা দেখতে। পছন্দ হয় না। কোনোটার রাস্তা সরু, কোনোটা লম্বায় বেশি। কোনোটা অনেক ভেতরে তো কোনোটার পরিবেশ ভালো না। অন্য পাড়াতে গিয়েও দেখতে লাগলেন জায়গা। এভাবে দুবছর অতিবাহিত হয়ে গেল অথচ মনের মতো একটা জায়গার ব্যবস্থা তিনি করতে পারলেন না। এদিকে ভাড়া বৃদ্ধি পেয়েছে বহুগুণ। অস্থিরচিত্ত হয়ে ঘুরে বেড়ান। আল্লাহর কাছে দুয়া করেন দুই হাত তুলে।

একদিন পাশের পাড়ায় মসজিদে নামাজ শেষে দুআ করতে গিয়ে দেরি হয় তাঁর। ওদিকে শুরু হয়েছে বক্তব্য। একজন বক্তা বক্তব্য রাখছেন। মুসল্লীরা বসে শুনছেন সেই কথা। বক্তাকে চিনতে পারলেন তিনি। ডাক্তার আজহারুল ইসলাম। হোমিওপ্যাথি ডাক্তার। এই শহরের নামকরা ডাক্তার। একটি বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজের অধ্যাপকও। খুব ভালো বলেন। এর আগেও তিনি তাঁর বক্তব্য শুনেছেন। শুনে প্রীত হয়েছেন। তিনিও বসলেন মুসল্লীদের সাথে। বক্তব্য চলছিল হিজরত ও নসরত নিয়ে। নবীজী নিজ মাতৃভূমি মক্কায় অবিশ্বাসীদের দ্বারা অত্যাচারিত হয়ে সাহাবীদেরকে সঙ্গে নিয়ে মদিনায় হিজরত করে চলে এসেছেন। মদিনার সাহাবীগণ তাঁদের যারপর নাই সাহায্য করেছেন। কীরকম সাহায্য করেছিলেন তারই বর্ননা দিচ্ছেন তিনি। উপস্থিত সবাই মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় শুনছেন।

বক্তা বলে চলেছেন,”মদিনার আনসার সাহাবীগণ নিজ নিজ বাড়িতে একেকজন সাহাবীকে থাকতে দিলেন। নিজেদের ব্যাবসার অংশীদারিত্ব দিলেন। চাষের জমি ভাগ করে দিলেন। এমনকি যাঁদের দুজন স্ত্রী ছিল একটিকে তালাক দিয়ে বললেন, ‘ইদ্দত শেষ হলে বিয়ে করুন।’ কী ত্যাগ ছিল তাঁদের! তবেই না ইসলাম সেখানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল আর ছড়িয়ে পড়েছিল সারা বিশ্বময়।

বাড়ি ফেরার পথে তাঁর মনে হল একটা জট, যেটা দীর্ঘদিন তাঁকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছিল, কেটে যেতে চলেছে। ডাক্তার আজহারুল ইসলাম, যাঁর বক্তব্য তিনি এতক্ষণ শুনছিলেন, তাঁরই একটা জায়গা পড়ে আছে তাঁর ভাড়া বাড়ির ঠিক পেছনে। সেখান থেকে যদি কিছুটা যথার্থ দাম নিয়ে তাঁকে দিয়ে দেন, একটা বাড়ি করা যেতেই পারে। সাহাবিদের এতবড় ত্যাগের কথা তিনি বলছিলেন, এইটুকু ত্যাগ তো তিনি করতেই পারেন। তাঁর দুই ছেলেই প্রতিষ্ঠিত। একজন ডাক্তার, অন্যজন প্রফেসর। দুই শহরে দুজন থাকেন। তাঁর বাড়িটিও অনেক বড়ো। বাড়ি লাগা রয়েছে আরও একটা জায়গা।

পরদিন সকালে ডাক্তার বাবুর সাথে দেখা করার উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে বের হলেন শামসুল আলম। পথিমধ্যে দেখা হয়ে গেল দুজনের। তিনি তাঁর মনের কথাটা পাড়লেন ডাক্তার বাবুর সামনে অত্যন্ত বিনয়ের সাথে। ডাক্তার বাবু শুনলেন আর তৎক্ষণাৎ উত্তর দিয়ে বললেন, যেন কথাটা তাঁর ঠোঁটে এসেই ছিল, “ঐ জায়গা তো বিক্রি করব না আমি।”

যার জায়গা তিনি যদি বিক্রি না করেন তবে আর কারই বা কী করার থাকতে পারে!

Exit mobile version