কোনও মানুষের সঙ্গে পরিচয়ের (নাম, ধর্ম, পেশা) পরপরই একটি প্রশ্ন অবধারিতভাবে উঠে আসে, আপনার বাড়ি কোথায়? ‘বাড়ি’ এখানে ‘বাসা’ নয়। বাড়ি মানে ‘হোম’। আপন ‘অরিজিনাল’ সুখি গৃহকোণ। দিনশেষে পাখি বাসায় ফেরে। এক বাসা ভেঙে গেলে আরেক বাসা গড়ে। কিন্তু মানুষ তো পাখি নয়। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় তার ‘বাসা’ থাকতে পারে। কিন্তু বাড়ি একটি নিশ্চয়ই আছে। এই ভাবনা থেকেই বিবিসি-র এক সাংবাদিক ১৯৯৮ সালে অমর্ত্য সেনকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘ঠিক কোন জায়গাটাকে আপনার বাড়ি মনে করেন? আপনি আমেরিকার কেমব্রিজের হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি থেকে ইংল্যান্ডের কেমব্রিজের ট্রিনিটি কলেজের মাস্টার হিসেবে যোগ দিয়েছেন। বেশ কয়েক দশক ইংল্যান্ডে থেকেছেন, অথচ আপনি এখনও ভারতীয় নাগরিকত্বই বজায় রেখেছেন। তা হলে, আপনার বাড়িটা ঠিক কোথায়?’ নিঃসন্দেহে একটি কঠিন প্রশ্ন৷ অমর্ত্য সেনের মতো একজন বিশ্বপ্রেমিক অর্থনীতিবিদের কাছে অবশ্যই এর দার্শনিক উত্তর রয়েছে। এই বিশ্বে যখন পরিচিতিকে কেন্দ্র করে হিংসার ঘটনা ঘটছে, তখন এর উত্তর আরও জটিল হয়ে পড়ে তাঁর মতো নোবেলজয়ীর কাছে। সেসবের উত্তর খোঁজাখুঁজি করার মধ্যেও অবশ্য রয়েছে অনির্বচনীয় আনন্দ। যাকে আমরা ‘চিন্তার আনন্দ’ বলতে পারি। অপরিচয়ের সঙ্গে পরিচয়ের ‘ভাবনাসুখ’ বলাও যায়। একটি মানুষ যখন জীবনের বহু বসন্ত ও হেমন্ত পার করে এসেছেন এই ভাবনার অনুশীলনে, তখন এমন প্রশ্নের উত্তর খোঁজাও জরুরি হয়ে পড়ে বৈকি। অমর্ত্য সেন তাঁর আত্মজীবনী ‘জগৎ কুটির’-এ (হোম ইন দ্য ওয়ার্ল্ড, ২০২১) সেই উত্তরের তালাশ করেছেন। বাড়ি, পরিচয় এবং চিন্তার গঠন ও পুনর্গঠন নিয়ে আবর্তিত হয়েছে এই জীবনীগ্রন্থ। কীভাবে একজন মানুষ পারিপার্শ্বিক জীবন ও সমাজের সঙ্গে বন্ধন গড়তে গড়তে বিশ্বনাগরিক হয়ে ওঠেন, কীভাবে সমকালীনরা তাঁর চিন্তাভাবনার গঠন ও গড়নে প্রভাব ফেলে, আর কীভাবে তিনি তা নিজের মধ্যে বিনির্মাণ করেন, সেই গভীর দর্শনের বই হয়ে উঠেছে এই আত্মজীবনীটি।
“আমেরিকার কেমব্রিজে হার্ভার্ড স্কোয়ারের কাছে পুরনো বাড়িটাও আমি নিজের বাড়িই মনে করি, আবার ভারতেও আমি খুবই নিজের বাড়িতে থাকার মতোই থাকি—বিশেষত শান্তিনিকেতনে আমাদের বাড়িটাতে” – অমর্ত্য সেন
জনৈক সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে ড. সেন যেটা বলতে চেয়েছিলেন, তা হল— ট্রিনিটি কলেজের সঙ্গে তার বহুদিনের সখ্যের কথা। প্রথমে স্নাতক ছাত্র হিসেবে (১৯৫৩), তারপর গবেষক, শিক্ষক হিসেবে। তার সঙ্গে যোগ করেছেন, ‘কিন্তু, পাশাপাশি, আমেরিকার কেমব্রিজে হার্ভার্ড স্কোয়ারের কাছে পুরনো বাড়িটাও আমি নিজের বাড়িই মনে করি, আবার ভারতেও আমি খুবই নিজের বাড়িতে থাকার মতোই থাকি—বিশেষত শান্তিনিকেতনে আমাদের বাড়িটাতে, যেখানে আমি জন্মেছি, বড় হয়েছি, আর নিয়মিত গিয়ে কিছুদিন করে থাকি।’ তাঁর মতো ভুবনবিখ্যাত একজন অধ্যাপকের কাছে এমন উত্তর ছাড়া আর অন্য কিছু আশা করা অন্যায়। এসব কিছু নিয়েই তিনি একজন পূর্ণ মানুষ। কোনও পরিচিতিকেই তিনি খাটো করতে চান না। পুরনো ঢাকায় তাঁদের বাড়িটার নাম ছিল ‘জগৎ কুটীর’। জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে সংশয় থেকে তাঁর ঠাকুরদা এই নাম রেখেছিলেন, নাকি ঠাকুমা জগৎলক্ষ্মীর স্মৃতিতে রেখেছিলেন, তা নিয়ে আলোচনা চলতে পারে। তবে এই বইয়ে বিশ্বজনীনতার কথাই বারবার তুলে ধরেছেন প্রফেসর সেন।
১৯৩৩ সালের ৩ নভেম্বর অমর্ত্য সেনের জন্ম শান্তিনিকেতনে। সেখানে তাঁর দাদামশায় ভারতীয় দর্শনের প্রসিদ্ধ পণ্ডিত ক্ষিতিমোহন সেন অধ্যাপনা করতেন। তাঁর মা অমিতা সেন। বাবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিস্ট্রির অধ্যাপক আশুতোষ সেন। এই পরিবার রবীন্দ্রনাথের খুব কাছের ছিল। এখানেই তাঁর জন্ম এবং এই নতুন ধরনের নামটি দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং। জন্মের তিন বছর পর মান্দালয় কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করতে যান বাবা আশুতোষ। ১৯৩৬-১৯৩৯ পর্যন্ত শিশু অমর্ত্য বার্মায় কাটিয়েছিল। সেই সময় থেকেই বৈচিত্র্যময় সহাবস্থানের শুরু। শুরু এর প্রতি ভালোলাগাও। ছোটবেলার স্মৃতি হোক কিংবা আন সাং সু কি-র সঙ্গে পরিচয়ের সুবাদে হোক, মায়ানমার নিয়ে তাঁর অপরিসীম আগ্রহের কথাও জানিয়েছেন বইতে। সু কি তাঁর বন্ধু ছিলেন। কিন্তু একটি বিষয়ে তিনি হতাশা গোপন করেননি। যে বৈচিত্র্য ও পরিচিতিতে তিনি বিশ্বাস করেন, সেখানেই আঘাত করেছেন সু কি। অমর্ত্য লিখছেন, রোহিঙ্গাদের উপর সেনাবাহিনী এবং অসহিষ্ণু বৌদ্ধ বর্মীবাহিনী ভয়ানক অত্যাচার চালালেও, রোহিঙ্গাদের সাহায্য করার ব্যাপারে সু কি কিছুই করেননি। তাঁর মতে, ‘সেনাবাহিনী কতকগুলো বানানো গল্প প্রচার করে চলেছিল, যেমন, রোহিঙ্গারা বাংলাদেশ থেকে এসে বর্মায় দখল নিয়ে বসে আছে। তারা এই সত্যটাকে চেপে গেল যে, ব্রিটিশরা ছেড়ে যাওয়ার সময় দক্ষিণ এশিয়ার এমন বাঁটোয়ারা করে দিয়ে যায় যাতে প্রাচীন আরাকানের অংশ রাখাইন এলাকাটি বর্মাকে দেওয়া হয়—এটি তার অঙ্গ ছিল না, আর এই রাখাইনে রোহিঙ্গারা দীর্ঘকাল ধরে বসবাস করে এসেছেন।’ সেনাবাহিনী যখন উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে এই সব মিথ্যা প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে এবং তাদের বিরুদ্ধে হিংসার ইন্ধন জুগিয়ে যাচ্ছে তখন সু কি এই মিথ্যার বিরোধিতা করার বদলে নীরব থেকেছেন। এই বিষয়টিতে ড. সেন আশ্চর্য হয়েছেন। একজন মানবদরদি মানুষ কীভাবে একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে এমন অপপ্রচার ও নৃশংস অত্যাচারে চুপ থাকতে পারে!
্বক্ষমতা, যুক্তি, সামাজিক চয়ন, জনকল্যাণ অর্থনীতি নিয়ে যাঁর কাজ, তিনি এমন ব্যবহার সহ্য করবেন কীভাবে? তিনি বেড়ে উঠেছেন শান্তিনিকেতনের পাঁচিলছাড়া স্কুলে। খোলা আবহাওয়া ও মুক্ত আলোচনার আদানপ্রদান হয় এমন পরিবেশে। এ ব্যাপারে দাদু ক্ষিতিমোহন সেনের কাছ থেকে প্রভূত শিক্ষা অর্জন করেছেন অমর্ত্য। তাঁর উপর দাদুর প্রভাব এই বইয়ের একটি অধ্যায়ে আলোচনা করেছেন। ক্ষিতিমোহনের ‘হিন্দুইজম’ বইটিকে সময়ের নিরিখে বিশেষভাবে গুরুত্বের সঙ্গে দেখেছেন অমর্ত্য। হিন্দু দর্শন ইসলামি, বিশেষত সুফিদের ভাবনায় প্রভাবিত হয়েছে। ক্ষিতিমোহন সেটা বুঝেছিলেন। মুঘলরা যে সহনশীলতার পরিচয় দিয়েছিল তাও উঠে এসেছে তাঁর ভাবনায়। রোমের কাম্পো দেফিয়োরিতে ব্রুনোকে যখন ধর্মদ্রোহের অপরাধে পুড়িয়ে হত্যা করা হচ্ছে, আকবর তখন আগ্রায় ধর্মীয় সহিষ্ণুতার গুরুত্ব বিষয়ে বক্তৃতা দিচ্ছেন।
উপমহাদেশের বিষাদময় ট্র্যাজেডি দেশভাগ প্রসঙ্গও উঠে এসেছে এই বইয়ে। দ্বিজাতি তত্ত্বের চর্চাকারী হিসেবে তিনি সাভারকরের নাম এনেছেন। ‘হিন্দুত্ব’ শব্দটি প্রচারের পিছনে তারই অবদান রয়েছে বলে মনে করেন ড. সেন। ক্ষিতিমোহন বলতেন, একসঙ্গে শান্তিপূর্ণ ভাবে বাস করার থেকেও অনেক বেশি কিছু আছে এই ভারতে, যাকে আমরা একযোগে নির্মাণ করেছি। কিন্তু দেশভাগ সেই বহু শতাধীর যুক্তসাধনাকে তছনছ করে দেয়। আসে স্বাধীনতা। স্বাধীনতার পর কলকাতা শহরে বসে সাম্রাজ্যবাদী অত্যাচার ও তার সৃষ্ট অসাম্য নিয় ভাবতে থাকেন অমর্ত্য। কলেজ স্ট্রিট, কফি হাউস আর প্রেসিডেন্সিতে পড়াশোনা, তর্কবিতর্ক হয়ে ওঠে তাঁর জীবনের অংশ। এখান থেকেই বিশ্বের তাবড় তাবড় অর্থনীতিবিদদের লেখা তিনি পড়তে শুরু করেন। কেমব্রিজে গিয়ে তারই পূর্ণত্ব প্রাপ্তি ঘটেছিল।
দার্শনিক, বিজ্ঞানী আল বিরুনি (৯৭৩-১০৪৮ খ্রি.) বলেছিলেন, একে অপরকে জানলে জ্ঞান ও শান্তি দুইই আসে। সেনের চর্চাও তেমন। তিনি বিশ্বের সভ্যতাগুলোকে খণ্ডিতভাবে ভাবতে চান না। এতে তো পরস্পরের প্রতি বৈরিতা বাড়ে, যাকে ‘সভ্যতার সংঘাত’ বলে থাকেন অনেকে। তিনি একটি বিকল্প পদ্ধতিতে বিশ্বকে দেখেন। তা হল বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যগুলিকে স্বতন্ত্র সভ্যতার প্রকাশ হিসেবে না দেখে তাকে দেখে একটিমাত্র সভ্যতার ভিন্ন ভিন্ন প্রকাশ হিসেবে দেখা। একে আমরা বলতে পারি বিশ্বসভ্যতা—‘শিকড়ে শিকড়ে, শাখায় শাখায় লগ্ন হয়ে থেকে তা বিশ্বজুড়ে শতফুল ফোটায়।’ তাই ঢাকা, মান্দালয়, বাংলার নদী, পাঁচিলছাড়া স্কুল, কলেজ স্ট্রিট, কেমব্রিজ, মরিস ডব, মাহবুব-উল-হক, পিয়েরো স্রাফার মতো অর্থনীতিবিদদের সাহচর্য— সবকিছুই তাঁকে এক ধরনের ‘প্রসারিত ভাবনার চিহ্ন’ এবং বেঁধে বেঁধে থাকার গল্প বলে। তাঁর জীবনযাপন অর্থনীতি, দর্শন, পরিচিতি বিষয়ে গভীর এক জীবনদর্শন গড়ে তোলে। জ্ঞানচর্চার আনন্দকে সর্বজনীন করে তোলে। দেশকালের সীমা অতিক্রম করে সহাবস্থানের অনুশীলন এবং বিশ্বজগতের মাঝে আপন কুটির বা বাড়ি খুঁজে নেওয়াকেই গুরুত্ব দিতে চান তিনি। তাই পুরো বইয়ে নিজের নোবেলপ্রাপ্তি বা অর্জনের কথা বলেননি। বলেছেন ভাবনার কথা, যাপনের কথা, অভিজ্ঞতা থেকে সমৃদ্ধ হওয়ার কথা। কলেজ স্ট্রিট থেকে কেমব্রিজ—এই দূরত্বের মাঝেও কীভাবে একটি অদৃশ্য সুতো তাঁকে বেঁধে রেখেছে, সেই কথা বলেছেন। একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে এই অস্থির সময়ে অমর্ত্য সেন তাই প্রকৃত অর্থেই হয়ে উঠেছেন একজন নির্ভরযোগ্য বুদ্ধিজীবী। ইতিহাসবিদ উইলিয়াম ডালরিম্পল যথার্থই বলেছেন, ‘আমাদের সময়ে বিশিষ্ট চিন্তার শক্তিতে সমৃদ্ধ যাঁরা, অমর্ত্য সেন তাঁদের মধ্যে পড়েন; তাঁর লেখার সুগভীর বক্তব্যের পাশাপাশি মাঝে মাঝে দেখা মেলে সুতীব্র তির্যক দৃষ্টির।’ কলেজ স্ট্রিট থেকে কেমব্রিজ, দীর্ঘ জীবনে সেটাই প্রমাণ করেছেন অমর্ত্য সেন।