ড. নাজিবর রহমান
বারোটি আরবি-চান্দ্র মাসের মধ্যে রমজান মুসলমানদের জন্য সবচেয়ে পবিত্র ও মহিমান্বিত মাস। নবমতম আরবি ক্যালেন্ডারের এই মাসটি শুধু মাত্র সিয়াম পালন বা রোজা রাখার বা উপবাস অথবা সারাদিন না খেয়ে, না পান করে থাকার মাস নয়, বরং আত্মশুদ্ধি, আত্মনিয়ন্ত্রণ ও আল্লাহর (সুবহানাহু ওয়া তায়ালা) নৈকট্য অর্জনের অপূর্ব সুযোগ। এই মাস আমাদের জীবনের ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে এবং এক নতুন এবং বলিষ্ঠ ধারায় গড়ে তুলতে সহায়ক হতে পারে। রমজান একদিকে যেমন তসবি তাহলিল সহ রাত্রি জাগরণ, দোয়া দরুদ ও তেলাওয়াত প্রভৃতি ধরনের ইবাদত- বন্দেগির মাধ্যমে নেকি বা পুণ্য অর্জনের পথ প্রশস্ত করে অপরদিকে তেমনি এটি একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনধারাকে পরিপূর্ণ বিকশিত করার এবং তাকে সারা বছর অটুটভাবে ধরে রাখার জন্য প্রশিক্ষণ বা ট্রেনিং এর মত ব্যবস্থাপনা করে।
প্রত্যেক বছরের ন্যায় নতুন করে পবিত্র রমজান মুবারক আমাদের মাঝে নব চেতনার জন্য ফিরে এসেছে, যা আত্মসংযম, আধ্যাত্মিকতার উন্নতি এবং সামাজিক সংহতির মাস। কোটি কোটি মুসলমানের জন্য এটি আত্মশুদ্ধি, আত্ম সংযম, ইবাদত, রাত্রি জাগরণ উপাসনা এবং কল্যাণের এক অনন্য সুযোগ।
রমজান মাসকে সর্বোত্তমভাবে কাজে লাগানোর জন্য নিচে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করলাম :
১. কুরআন তেলাওয়াত বৃদ্ধি এবং বুঝে উপলব্ধি করুন
২. দোয়া ও ক্ষমা প্রার্থনা করুন
৩. দানশীলতা ও দুঃস্থদের সাহায্য করুন। দান দানশীলতা সম্পদের বরকত আনে। হাদিসে গোপনে দান করাকে বেশি উৎসাহিত করা হয়েছে।
৪. অন্য রোজাদারদেরকে ইফতার ও সেহরি করানোর ফজিলত লাভ করুন।
৫. পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ় করুন
৬. তাকওয়া বৃদ্ধির মাধ্যমে আত্মনিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলা গড়ে তুলুন, তাকওয়া: এক পরিশুদ্ধ জীবনধারা গড়ে দেওয়ার জন্য বিশেষভাবে উপযোগী।
৭. তারাবির নামাজ আদায় করুন।
৮. সমাজসেবায় অংশ নিন।
৯. কৃতজ্ঞতা ও ধৈর্য অনুশীলন করুন।
১০. আত্মসমীক্ষা এবং অনুশোচনার মাধ্যমে জীবনের ভুলগুলো পরিত্যাগ করার জন্য প্রতিজ্ঞা করে তওবা করুন
১১. শারীরিক সুস্থতা বজায় রাখুন, অধিক ইবাদতের জন্য সুস্থতা বিশেষভাবে দরকার।
১২. সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে সংগঠিত থাকুন।
রমজানকে ফলপ্রসূ করতে পরিকল্পনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিদিনের ইবাদত, দান, কুরআন পড়া ও অন্যান্য কাজের জন্য একটি তালিকা তৈরি করুন এবং সে অনুযায়ী চলার চেষ্টা করুন।
রমজান এক অনন্য সুযোগ, যা আমাদের জীবনকে পরিবর্তন করতে পারে। এই মাসকে যথাযথভাবে কাজে লাগিয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনই আমাদের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত।
ভারতে রমাদান পালনকারী মুসলিম জনগোষ্ঠী
ভারত বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম জনগোষ্ঠীর দেশ। ভারতের মোট জনসংখ্যা প্রায় ১৪০ কোটি, যার মধ্যে প্রায় ২০ কোটি মুসলমান রয়েছে।
এই বিশাল জনগোষ্ঠী রমজান মাসে সিয়াম পালন করে বা রোজা রাখে বা উপবাস করে, তারাবিহ নামাজ আদায় করে এবং ইবাদতে নিয়োজিত থাকে।
উত্তরপ্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, আসাম, কেরালা ও জম্মু-কাশ্মীরে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মুসলমান রমজান পালন করেন।
বিশ্বব্যাপী রমাদান পালনকারী মুসলিম সংখ্যা
বিশ্বের মোট জনসংখ্যা ৮০০ কোটির কাছাকাছি, যার মধ্যে মুসলমানদের সংখ্যা প্রায় ২০০ কোটি।
সবচেয়ে বেশি মুসলমান রয়েছে ইন্দোনেশিয়া (প্রায় ২৩ কোটি)।
পাকিস্তান, ভারত, বাংলাদেশ, নাইজেরিয়া, মিশর, তুরস্ক, ইরান ও সৌদি আরবে বিশাল সংখ্যক মুসলমান রমজান পালন করেন।
মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা, এশিয়া এবং ইউরোপ-আমেরিকার মুসলিম অভিবাসীরাও একইভাবে রমজান পালন করেন।
বাঙালি মুসলিম জনগোষ্ঠী ও রমজান:
বাংলা ভাষী বলতে প্রধানত ভারতের ত্রিপুরা, পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশকে বোঝায়। এই অঞ্চলে মুসলিম জনগোষ্ঠীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য।
বাংলাদেশ : বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যা প্রায় ১৭ কোটি, যার মধ্যে ৯১% মানুষ মুসলমান। অর্থাৎ, প্রায় ১৫.৫ কোটি মুসলমান রমজান পালন করেন।
পশ্চিমবঙ্গ : ভারতের পশ্চিমবঙ্গে মোট জনসংখ্যা প্রায় ১০ কোটি, যার মধ্যে প্রায় ২৭% মুসলমান, অর্থাৎ প্রায় ২.৭ কোটি মানুষ রমজান পালন করেন।
রমজান পালন ইসলাম ধর্মে ধর্মীয় কর্মগুলোর মধ্যে অন্যতম ইবাদত। ধর্মীয় স্বাধীনতা প্রতিটি ব্যক্তির মৌলিক অধিকার। ভারত, তার সংবিধানের মাধ্যমে, এই অধিকারকে সুরক্ষিত করেছে এবং আন্তর্জাতিক আইনের দৃষ্টিতেও ধর্মীয় স্বাধীনতার গুরুত্ব অপরিসীম।
ভারতীয় সংবিধানে ধর্মীয় অধিকার :
ভারত একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশ, যেখানে প্রতিটি নাগরিক তার নিজস্ব ধর্ম পালনের স্বাধীনতা ভোগ করে। ভারতীয় সংবিধানের বিভিন্ন অনুচ্ছেদে ধর্মীয় অধিকার সংরক্ষণের নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়েছে।
অনুচ্ছেদ ২৫ : প্রতিটি ব্যক্তি তার নিজস্ব ধর্ম পালনের, প্রচারের এবং প্রচারের অধিকার রাখে। তবে এটি জনশৃঙ্খলা, নৈতিকতা এবং স্বাস্থ্যের পরিপন্থী হতে পারবে না।
অনুচ্ছেদ ২৬: প্রতিটি ধর্মীয় সম্প্রদায় তাদের নিজস্ব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান স্থাপন, পরিচালনা এবং পরিচালনার অধিকার পায়।
অনুচ্ছেদ ২৭ : কোনো ব্যক্তি বা সম্প্রদায়কে জোর করে ধর্মীয় কাজে আর্থিক অনুদান দিতে বাধ্য করা যাবে না।
অনুচ্ছেদ ২৮ : সরকার পরিচালিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কোনো ধর্মীয় শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা যাবে না।
অনুচ্ছেদ ৩০ : সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন ও পরিচালনার অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে।
আন্তর্জাতিক আইনে ধর্মীয় অধিকার
বিশ্বব্যাপী ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্য বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চুক্তি ও ঘোষণা রয়েছে। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি হলো:
সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা (UDHR), ১৯৪৮: এর ১৮ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, প্রতিটি ব্যক্তির চিন্তা, বিবেক ও ধর্মের স্বাধীনতা রয়েছে।
নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক চুক্তি ( ICCPR), ১৯৬৬ এর ১৮ নম্বর অনুচ্ছেদে ধর্ম পালনের স্বাধীনতা ও ধর্মান্তরিত হওয়ার অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে।
জাতিসংঘের সংখ্যালঘুদের অধিকার সংক্রান্ত ঘোষণা, ১৯৯২: এতে সংখ্যালঘুদের নিজস্ব ধর্ম ও সংস্কৃতি চর্চার অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে।
ইউরোপীয় কনভেনশন অন হিউম্যান রাইটস (ECHR), ১৯৫০: এর ৯ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, ধর্মীয় স্বাধীনতা একটি মৌলিক অধিকার।
ভারতে ধর্মীয় অধিকার রক্ষা করার জন্য সচেতনতা:
যদিও ভারতীয় সংবিধান ধর্মীয় অধিকার সুরক্ষিত করেছে, তথাপি বাস্তবে বিভিন্ন সময়ে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ, এবং ধর্মান্তর রোধ আইনের অপব্যবহারের মতো চ্যালেঞ্জ দেখা যায়। সম্প্রদায় সম্প্রদায়ে পারস্পরিক যোগাযোগ ও মেলবন্ধনের মাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধি করে প্রত্যেক সম্প্রদায় যাতে নিজেদের ধর্মীয় কাজকর্ম নির্বিঘ্নে শান্তিপূর্ণভাবে পালন করতে পারে তা সংখ্যা গুরু ও সংখ্যালঘু তথা মুসলিম, হিন্দু, শিখ, ঈশাই, বৌদ্ধ জৈন পারসিক এবং অন্যান্য সকলের গুরুত্ব দেওয়া দরকার। অন্যদিকে যারা এসব শান্তিপূর্ণ ধর্মীয় আচরণের বিঘ্ন সৃষ্টি করার চেষ্টা করবে তাদেরকে বুঝানো বা রুখে দেওয়ার দায়িত্ব সমাজের সুস্থ মানসিকতা সম্পন্ন ব্যক্তিবর্গকে গ্রহণ করতে হবে। এই পারস্পারিক সৌহার্দের সম্পর্ক সমাজ এবং দেশকে প্রগতি ও উন্নতির পথে নিয়ে যাবে।
ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ও সংহতি বজায় রাখতে সরকার ও নাগরিক সমাজকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
বিচার বিভাগকে সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শ বজায় রেখে ধর্মীয় অধিকার সুরক্ষিত রাখার জন্য কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।
শিক্ষা ও সচেতনতার মাধ্যমে ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ও পারস্পরিক শ্রদ্ধার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে।
ভারতীয় সংবিধান ও আন্তর্জাতিক আইন উভয়ই ধর্মীয় অধিকারকে মৌলিক মানবাধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। ধর্মীয় স্বাধীনতা কেবল ব্যক্তি অধিকার নয়, বরং একটি শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক সমাজ গঠনের গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি। তাই আমাদের সকলের দায়িত্ব ধর্মীয় অধিকার সংরক্ষণ করা এবং পারস্পরিক সম্মান ও সহিষ্ণুতার মাধ্যমে এক সুখী ও সমৃদ্ধ সমাজ গড়ে তোলা। বাংলা, ভারত ও বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি মুসলমান রমজান পালন করেন, যা ইসলাম ধর্মের অন্যতম বৃহত্তম ধর্মীয় চর্চার প্রতিফলন। এই মাসে আত্মসংযম, ইবাদত এবং দানশীলতার মাধ্যমে মুসলমানরা এক অনন্য ভ্রাতৃত্ব ও মানবতার বার্তা ছড়িয়ে দেন। রমজান শুধু উপবাসের সময় নয়, এটি শান্তি, সৌহার্দ্য ও সংযমের প্রতীক।
(লেখক: কালিয়াচক কলেজের অধ্যক্ষ)