রমজান মাসে উপবাস: ইসলামিক দৃষ্টিভঙ্গি ও আধুনিক বিজ্ঞানের বিশ্লেষণ

পবিত্র রমজান মাস মুসলমানদের জন্য এক বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ সময়। এই মাসে ইসলামের পাঁচটি মূল স্তম্ভের একটি হলো সিয়াম (রোজা) পালন। ইসলামী বিধান অনুযায়ী, প্রাপ্তবয়স্ক সুস্থ মুসলিম নর-নারীদের জন্য সুবহে সাদিক (ভোর) থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত খাদ্য-পানীয় ও যৌনসংগম থেকে বিরত থাকা বাধ্যতামূলক। একদিকে এটি আল্লাহর নির্দেশ মানার এক মহান ইবাদত, অন্যদিকে আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান প্রমাণ করেছে যে, নিয়মিত রোজা রাখা শরীরের জন্যও উপকারী। ইসলামিক দৃষ্টিভঙ্গি ও আধুনিক বিজ্ঞানের আলোকে এর শারীরিক উপকারিতা নিয়ে আলোচনা করব।

ইসলামে রোজার গুরুত্ব ও বিধান

রোজা সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন:
“হে মুমিনগণ! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর, যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো।”—(সূরা আল-বাকারা: ১৮৩)
এই আয়াতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, রোজা পালনের মাধ্যমে আত্মসংযম ও তাকওয়া (আল্লাহভীতি) অর্জন করা সম্ভব।

রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন: “যে ব্যক্তি ঈমান ও সওয়াবের আশায় রমজানের রোজা পালন করে, তার অতীতের সকল গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয়।”—(বুখারি ও মুসলিম)
এ থেকে বোঝা যায়, রোজা শুধু শারীরিক নয়, বরং আত্মিক ও আধ্যাত্মিক পরিশুদ্ধির মাধ্যমও।

রোজার স্বাস্থ্যগত উপকারিতা:

আধুনিক বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে বিজ্ঞানীরা রোজার নানা উপকারী দিক সম্পর্কে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। তারা দেখেছেন যে, নিয়মিত উপবাস রাখা শরীরের বিপাক ক্রিয়া (metabolism), রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা (immune system) ও দীর্ঘায়ুর জন্য উপকারী।

আমাদের শরীর প্রতিনিয়ত খাবার হজম করতে ব্যস্ত থাকে। তবে রোজার সময় খাদ্য গ্রহণ সীমিত হওয়ায় পরিপাকতন্ত্র বিশ্রাম নেয়। এটি পাকস্থলীর অম্ল (acid) নিঃসরণ স্বাভাবিক রাখে এবং গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা কমায়।

রোজার সময় শরীর অটোফেজি (Autophagy) নামে একটি প্রক্রিয়া সক্রিয় করে। এতে পুরনো, নষ্ট ও ক্ষতিগ্রস্ত কোষগুলি শরীর থেকে বেরিয়ে যায় এবং নতুন সুস্থ কোষ তৈরি হয়। জাপানের বিজ্ঞানী ইউশিনোরি ওসুমি ২০১৬ সালে এই বিষয়ে গবেষণা করে নোবেল পুরস্কার পান।

নিয়মিত উপবাস শরীরের ইনসুলিন সংবেদনশীলতা (insulin sensitivity) বাড়ায়, ফলে ডায়াবেটিস ও স্থূলতা (obesity) নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।

গবেষণায় দেখা গেছে, উপবাস খারাপ কোলেস্টেরল (LDL) কমায় ও ভালো কোলেস্টেরল (HDL) বাড়ায়। এটি উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়।

রোজা রাখার ফলে ডোপামিন ও সেরোটোনিন নামক হরমোনের নিঃসরণ স্বাভাবিক হয়, যা মনোসংযোগ, স্মৃতিশক্তি ও মানসিক প্রশান্তি বৃদ্ধি করে।

গবেষণায় দেখা গেছে, যারা নিয়মিত উপবাস রাখেন, তাদের বয়স বৃদ্ধির প্রক্রিয়া ধীরগতির হয় এবং তারা দীর্ঘায়ু লাভ করেন।

ইসলামের দৃষ্টিতে রোজার আধ্যাত্মিক ও সামাজিক উপকারিতা

রোজা মানুষকে আত্মসংযম শিখিয়ে আল্লাহর কাছে আরো বেশি আত্মনিবেদিত করে। এটি আত্মার পরিশুদ্ধি ও আত্মশক্তি বৃদ্ধির অন্যতম উপায়।

রোজার মাধ্যমে মুসলিমরা ক্ষুধার্ত ও দরিদ্র মানুষের কষ্ট অনুধাবন করতে পারে এবং দানের প্রতি আগ্রহী হয়।

রমজান মাসে মুসলিমরা একসঙ্গে ইফতার ও সেহরি করে, যা সমাজে সম্প্রীতি ও ঐক্য বৃদ্ধিতে সহায়ক।

পরিশেষে বলা যায়, রমজান মাসের রোজা ইসলাম ধর্মের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিধান, যা আত্মশুদ্ধি ও সংযমের শিক্ষা দেয়। একইসাথে আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানও স্বীকার করেছে যে, রোজা শরীরের জন্য অত্যন্ত উপকারী। এটি শুধু আত্মিক উন্নয়নই নয়, বরং শারীরিক সুস্থতারও মাধ্যম।

সুতরাং, যারা সুস্থ ও সক্ষম, তাদের উচিত রোজার এই বিধান যথাযথভাবে পালন করা। এতে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের পাশাপাশি দেহ ও মনও সুস্থ থাকবে।

আল্লাহ আমাদের সবাইকে রমজানের রোজা যথাযথভাবে পালনের তওফিক দান করুন। আমিন।

Exit mobile version