ডঃ নাজিবর রহমান
আমার জীবনের প্রথম রোজা যেন এক সোনালি স্মৃতি, যার উজ্জ্বল আভা আজও হৃদয়ে দীপ্তি ছড়ায়। ছোটবেলার রমজান ছিল এক অনন্য সময়, যখন আমাদের চারপাশ ভরে উঠত উৎসবের আমেজে। সকাল-সন্ধ্যা সবখানে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল রোজা। ইস্কুলে বা পাড়ায় কেউ এলেই প্রশ্ন করত, “তুই কি রোজা রেখেছিস?” অতশত বুঝতাম না, শুধু জানতাম সারাদিন না খেয়ে থাকা মানেই রোজা। আর সবচেয়ে মজার অংশ ছিল ইফতার—যা আমার কাছে ছিল এক বড় আনন্দের বিষয়।
পরিবারের সবাই রোজা রাখত, তাই ছোট্ট মনে বাসা বাঁধল এক তীব্র কৌতূহল—আমিও কি পারব? একসময় সাহস সঞ্চয় করলাম। বয়স তখন মাত্র প্রথম শ্রেণি। নতুন ক্লাসে উঠেছি, নিজেকে বড় মনে হচ্ছিল। ভাবলাম, পড়াশোনায় ভালো করতে পারলে রোজাও রাখতে পারব। বড়রা প্রথমে খুব একটা গুরুত্ব দিল না, তবে আমি নাছোড়বান্দা। অবশেষে সবাই মেনে নিল।
সেই ভোররাতে দাদি লাঠি ঠুকঠুক করে এসে ডাক দিলেন, “উঠ রে, সেহেরির সময় হয়েছে।” চোখে তখন ঘুমের আবেশ, কিন্তু মনের উত্তেজনায় ঘুম দূর হয়ে গেল। মুখ ধুয়ে বাবার পাশে বসলাম। মা গরম ভাত, ডাল আর ভাজি দিলেন, সঙ্গে ছিল এক পিস বোয়াল মাছ। কী আনন্দ সেই খাবারে! খেয়ে নিয়ত করলাম—আজ আমি রোজা রাখব। এরপর বাবার সঙ্গে মসজিদে গিয়ে ফজরের নামাজ পড়লাম, তারপর আবার ঘুম।
সকাল গড়াতেই বুঝতে পারলাম, রোজা রাখা মোটেই সহজ নয়। ক্ষুধা, পিপাসা কষ্ট দিচ্ছিল, কিন্তু বড় বৌদি আর মেজ বৌদির উৎসাহে ধীরে ধীরে শক্তি ফিরে পেলাম। তারা বলল, “আজকের দিন ছোট, ঠান্ডা আবহাওয়া, কোনো কষ্ট হবে না।” আমার সমবয়সীরা দুপুরের মধ্যেই রোজা ছেড়ে দিল। দাদি তাদের বললেন, “তোমরা ছোট, তোদের রোজা হয়ে গেছে।” কিন্তু আমার লক্ষ্য ছিল বড়দের মতো রোজা রাখা। পাল্লা ছিল দাদার সাথে—সে ছাড়েনি, আমিও ছাড়ব না!
বিকেলে আমাদের “জয় বাংলা” যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলা শুরু হলো। নিম ফল ছোড়া, লুকোচুরি, দৌড়াদৌড়ি—সব মিলিয়ে এক অন্য রকম উত্তেজনা! রোজার কষ্ট যেন মুহূর্তেই ভুলে গেলাম। যুদ্ধের মাঝেই সূর্যাস্তের সময় ঘনিয়ে এলো, নজরুল ভাই হুইসেল বাজিয়ে খেলা শেষ করলেন। দৌড়ে বাড়ি ফিরে অজু করলাম, তারপর ইফতারের অপেক্ষা।
যখন শুনলাম, “সময় হয়েছে ইফতার করার,” মনে হলো যেন আকাশ থেকে প্রশান্তির বৃষ্টি ঝরল। প্রথম ঢোক শরবতের স্বাদ ভুলব না কখনো—সারা দিনের ক্লান্তি নিমেষে দূর হয়ে গেল! খেজুর, ছোলা, আদা-কুচি, গুড়, আর মজার সব খাবার নিয়ে বসেছিলাম বাবার পাশে। ইফতার শেষে দাদি আমার মাথায় হাত রেখে বললেন, “তুই রোজা করে নিতে পেরেছিস, তুই আমার জন্য দোয়া করবি।” তার কথা শুনে মনটা আনন্দে ভরে গেল।
তারাবির নামাজে দাঁড়ালাম পেছনের কাতারে। কয়েক রাকাতের পর চোখে ঘুম চলে এল, মনে হচ্ছিল পড়ে যাব। বড় ভাইজানকে বললাম, “ঘুম আসা নামাজ কেন পড়াও?” তিনি হাসলেন, “আস্তে আস্তে অভ্যাস হয়ে যাবে।”
সেই প্রথম রোজার অভিজ্ঞতা শুধু একটি দিনের স্মৃতি নয়, বরং তা আমার জীবনে এক মূল্যবান শিক্ষা হয়ে আছে। ধৈর্য, সংযম, আত্মশুদ্ধির প্রথম পাঠ সেই দিনেই পেয়েছিলাম। আজও রমজান এলে মনে পড়ে সেই ছোট্ট আমি, যে প্রথম রোজার আনন্দে ধৈর্যের কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিল। সেটাই ছিল আমার আত্মিক জাগরণের সূচনা, যে শিক্ষা আজও পথ দেখায় জীবন চলার পথে।
(লেখক কালিয়াচক কলেজের প্রিন্সিপাল)