নিজাম পারভেজ
“মা আমাকে ভোর রাতে ডাকবে, আমি রোজা রাখব”- ঠিক এভাবেই মায়ের কাছে আবদার করতাম রোজা রাখার জন্য।তখন রমাদান আসত শীতের সময়, অনেক শীত, সেই শীতে জবুথবু হয়ে লেপের ভেতর থেকে বেরোনোই ছিল চাপের। সেজন্যই কখনও উঠতাম, কখনও উঠতাম না, মা বলত যে আমি ডেকেছি, তুমিই তো ওঠোনি।
রমাদানের প্রথম সেহরি, প্রথম ইফতারের কথা সঠিক মনে নেই, তবে মনে আছে কোন এক শীতের ভোরে উঠে মায়ের হাতের রান্না করা ভাত, ঘি, আলু ভর্তা, সাথে আরও কোন তরকারী সহযোগে গরম ভাত দিয়ে সেহরি, সকালে উঠে স্কুল, স্কুল থেকে ফিরে কখন মসজিদের মাইকে “ইফতারের আর মাত্র ৩০ মিনিট বাকি আছে, এর পর ১৫ মিনিট, এর পর ১০ মিনিট, ৫ মিনিট এবং আর ২ মিনিট বাকি আছে” বলার পর ‘ইফতারের সময় হয়ে গেছে, আপনারা ইফতার করুন’ পর্যন্ত সামনে আপেল, কলা, ছোলার ডাল ভেজা, মুড়ি, ঝালবড়া, শসা, খেজুর নিয়ে বসে অধীর আগ্রহে সেই অপেক্ষা সেই স্মৃতি কোটি টাকার চেয়েও মূল্যবান।
ইফতার সেরে মসজিদে আজান শুরু হলেই, রুটি আলু ভাজির সাথে জড়িয়ে হাতে ধরে খেতে খেতে মসজিদের দিকে রওয়ানা হতাম, নামাজ পড়ে এসে আবার খেয়ে সন্ধ্যা ৭ টার দিকে ইশার আজান হলে অজু করে মসজিদে পৌঁছে যেতাম চাচাতো ভাই ও প্রতিবেশীদের ডেকে নিয়ে। এরপর মসজিদে গিয়ে দু’তলার ছাদে উঠে চার রাকাত সুন্নত পড়ে একে অপরের সাথে মারামারিতে মগ্ন হতাম নামাজ শুরু না হওয়া পর্যন্ত। তারপর কুরআনের শেষের ১০ টা সুরা দিয়ে তারাবি পড়া শেষ হলে, বিতর নামাজের জন্য আমরা সব একযোগে ইমাম সাহেবের সাথে বিতর বলে ঘোষণা দিতাম। বিতর নামাজ, এরপর বসে দু’রাকআত নফল নামাজ ও দুআ শেষে মসজিদ থেকে বেরিয়ে আমাদের গ্রামের ছোট বাজারে রমাদান উপলক্ষ্যে পিন্টু ও বারিকের ঝালবড়ার যে দোকানদুটো বসত সেগুলোর কোন একটাই লাইন লাগাতাম। সেখানে পকেটের অবস্থা বুঝে পেটের ব্যবস্থা করতাম, কখনও কোন চাচা আমাদের খাওয়াত, সেসব সাবাড় করে বাড়ি ফিরে আবার ভাত খেয়ে পরবর্তী সেহরী নিয়ত করে অত্যন্ত খুশি মনে লেপের তলায় ঢুকতাম।
স্মৃতির দরজায় টোকা দিলেই যেন একঝাঁক সোনালি দিন হুড়মুড় করে চলে আসে। টিডিএন বাংলার জন্য এই স্মৃতি লিখতে গিয়ে মনে পড়ে গেল, একসময় জীবন ছিল সত্যিই অন্যরকম, এক অনাবিল আনন্দের মিছিল।
রোজার সেই পবিত্র দিনগুলো! ভোরের আলো ফোটার আগেই ঘুমভাঙা চোখে সেহরির আয়োজন, তারপর রোজার নিয়ত করে দিনের পথে পা বাড়ানো। সকালে টিউশনি, তারপর স্কুল—মাথার ওপর গনগনে রোদ, বুকের ভেতর তপ্ত তৃষ্ণা, তবু যেন এক অদ্ভুত প্রশান্তি ঘিরে থাকত মনকে।
স্কুল শেষে সোজা ঈদগাহের মাঠে ছুটে যেতাম হাতে ক্রিকেট ব্যাট, মনে অফুরন্ত উৎসাহ নিয়ে। ক্লান্ত শরীরে বাড়ি ফিরে একটুখানি শুয়ে থাকা, কিন্তু খিদের জ্বালায় চোখ বন্ধ করা যেন অসম্ভব! সন্ধ্যার আযান যেন মুক্তির বার্তা বয়ে আনত। ইফতারের পর শরীরে নতুন প্রাণের সঞ্চার হতো, মনও হয়ে উঠত প্রশান্ত।
তারপর তারাবী—নিঃশব্দে মসজিদের শীতল মেঝেতে সেজদায় লুটিয়ে পড়া, আর মনে প্রশান্তির ঢেউ। নামাজ শেষে ক্লান্ত শরীর নিয়ে বাড়ি ফেরা, বিছানায় শরীর এলিয়ে দেওয়া মাত্রই যেন চোখের পাতা ভারী হয়ে আসত। শান্তির এক অদ্ভুত ঘুম এসে জড়িয়ে ধরত আমাকে।
এখন ভাবলে মনে হয়, সে সব তো কোনো এক দূর অতীতের রূপকথার গল্প! সময়ের স্রোতে ভেসে গেছে সেসব দিন, কিন্তু হৃদয়ের গহীনে তাদের মিষ্টি রেশ রয়ে গেছে চিরকাল।
কিন্তু আসলেই কি তাই, এই তো সেদিনের ঘটনা। রমাদান মাসে এসআইও ইফতারের ব্যবস্থা করত, ফ্লাইং কুইজ প্রতিযোগিতা হত, ইফতার পার্টিতে গিয়ে কুইজে জেতা পুরস্কার নিয়ে বাড়ি ফিরতাম, অনেক কিছু শিখে আসতাম, অনেক সুন্দর ছিল সেইসব দিন।
অথচ আজ আমরা আধুনিকতার ছোঁয়ায় সেসব থেকে অনেক দূরে চলে গেছি, ব্যস্তময় জীবনে আমরা আমাদের সংস্কৃতির যে অমূল্য অভিজ্ঞতা সেগুলোকে অনুভব করা বন্ধ করে দিয়েছি। এই লেখা যখন লিখছি তখন সেহরির সময়, সেহরি খেয়ে নামাজ পড়ে যে ঘুমোবো, এরপর উঠব ৫ থেকে ৬ ঘন্টা পরে, অফিসে গিয়ে কাজ শুরু করতে না করতেই জোহর, তারপর আসর পড়তে না পড়তেই ইফতারের সময়, এরপর আবার এশার সময়, তারাবীহ।
সারাদিন রোজা রেখে যখন খিদের জ্বালায় ছটফট করতাম, তখনও যেন এক অদ্ভুত আনন্দ ছিল। ইফতারের অপেক্ষা, জলের জন্য বুকের ভেতর কেমন এক শূন্যতা—তবু মনে প্রশান্তি।আর এখন? রোজা রাখলেও খিদে তেমন পায় না, পিপাসাও তাড়না দেয় না, আর ছোটবেলার সেই নিখাদ সুখও যেন কোথায় হারিয়ে গেছে!
রমাদানের সেই শুদ্ধ আনন্দ আবার ফিরে আসুক, রোজাদারের খুশি সেরা খুশি, সেই খুশি ফের ফিরে আসুক আর আমাদের জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে আলোকিত করুক!