নুরুল ইসলাম
প্রতিটি সমাজ ও সম্প্রদায়ের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে সেই সমাজের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের প্রধান ভূমিকা থাকে। রাজনৈতিক শক্তি মানব সভ্যতার প্রধান চালিকাশক্তি। এদেশের দলিত শ্রেণির ক্ষমতায়নে রাজনৈতিক দলিত আন্দোলনের নেতৃবৃন্দের ভূমিকা কেউ অস্বীকার করতে পারবেন না। বস্তুত বাবা সাহেব আম্বেদকর ও তাঁর উত্তরসূরিদের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে দলিত ক্ষমতায়ন আংশিক সম্ভব হয়েছে। তবে এপর্যন্ত বর্ণ হিন্দু সম্প্রদায়ের দৃষ্টিভঙ্গির খুব বেশি পরিবর্তন হয়নি। দলিত নেতৃবৃন্দের চাপে দলিতদের কিছু অধিকার ফিরে দিতে তারা বাধ্য হচ্ছে। যদিও তা যথেষ্ট নয়।
অন্যদিকে, এদেশের মুসলিম সম্প্রদায় এদেশের দলিত সম্প্রদায়ের চেয়ে দলিততর। তা সত্বেও, তাদের মধ্যে বাবা সাহেব আম্বেদকরের মতো সর্বজন গ্রাহ্য কোন রাজনৈতিক নেতৃত্বের উদ্ভব হচ্ছে না। এজন্য মুসলিম সম্প্রদায় নিজে কতটা দায়ী এবং এদেশের আধিপত্যকামী শক্তি কতটা দায়ী- তা গবেষণার বিষয়। স্বাধীন ভারতে মুসলিম নেতৃবৃন্দ দলিত নেতৃবৃন্দের মতো মূলস্রোতের রাজনৈতিক দলে গুরুত্ব পান না। কারণ এদেশের এক শ্রেণির মানুষ দলিতদের চেয়ে মুসলিম সম্প্রদায়কে মনে প্রাণে বেশি ঘৃণা করে। আর এখন বিজেপি পরিচালিত দেশের রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চে মুসলিম নেতৃবৃন্দের অস্তিত্ব প্রায় নিশ্চিহ্ন।
তাহলে উত্তরণের উপায় কী?
পরিস্থিতি ও প্রেক্ষিত বুঝতে হবে। আমার মনে হয়, এই মুহূর্তে মুসলিম সম্প্রদায়ের অরাজনৈতিক বিদ্বজ্জনদের এই গুরু দায়িত্ব নিতে হবে। কোন সন্দেহ নেই; খুব কঠিন কাজ। যদি সম্ভব হয়, তবে তাদের হাত ধরে এই পরিবর্তন হবে দীর্ঘ মেয়াদী। এই পরিবর্তন হবে টেকসই। দীর্ঘস্থায়ী।
এই মুহূর্তে কী করতে হবে? বিশাল কর্মকাণ্ড! যে কাজ শুধুমাত্র রাষ্ট্র করতে পারে। এত বড় কর্মকাণ্ড বেসরকারি ও সাংগঠনিকভাবে করা কঠিন, তবে অসম্ভব নয়। আমাদের অবশ্যই একাজ করতে হবে। এখন স্বাভাবিক ও শান্তিপূর্ণ সময় নয়। উপদ্রুত পরিস্থিতি। আপৎকাল। একথা মাথায় রেখে কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। এজন্য নিম্নোল্লেখিত কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে।
১. সুসংহত সমাজ নির্মাণ:
সুসংহত সমাজ নির্মাণের বিকল্প নেই। সাধারণত মুসলিম সম্প্রদায় সুনির্দিষ্ট একটি মসজিদ কেন্দ্রিক সমাজ ব্যবস্থার অধীনে থাকে। কোথাও সেটা সুসংহত আবার কোথাও অসংগঠিত। আমার পরামর্শ, এখন এই মসজিদ কেন্দ্রিক সমাজ ব্যবস্থাকে সংগঠিত ও সুসংহত করতে হবে। হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবদ্দশায় ও তৎপরবর্তী কালে মসজিদ যে ভূমিকা পালন করেছিল সেই ভূমিকা এখনো খুব প্রাসঙ্গিক এবং আদর্শ হতে পারে। তবে নন-প্রাক্টিসিং মুসলিমরা এবিষয়ে হয়তো সহমত হবেন না। কিন্তু বিকল্প থাকলে তারা সেটা উপস্থাপন করলে, ইতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকে ভেবে দেখতে হবে। এখানে বিস্তারিত বলার অবকাশ নেই।
২. ঐক্য ও সংহতি প্রতিষ্ঠা:
বলিষ্ঠ ঐক্য ও সংহতির বিকল্প নেই। আপৎকালে ঐক্য ও সংহতি খুব বেশি জরুরি। ঘর গোছানো খুব জরুরি। কোন উদ্যোগ ও প্রয়াস সফল হবে না যদি নিজেদের মধ্যে ঐক্য ও সংহতি না থাকে। ঐক্য ও সংহতি প্রতিষ্ঠা পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজ। নিজ নিজ সমাজে ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তি, পরিবারের সঙ্গে পরিবারের এবং বিভিন্ন গ্রাম ও গোষ্ঠীর মধ্যে সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্য প্রতিষ্ঠা খুব কঠিন কাজ। কিন্তু এখানে সফল না হলে সব চেষ্টা ব্যর্থ হবে। সকলকে বুঝতে হবে, এটা আপৎকাল। ক্রান্তিকাল। স্বাভাবিক সময় নয়। টিকে থাকা ও অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে ঐক্য ও সংহতি প্রতিষ্ঠা করতে হবে। বিপদের মোকাবেলা করতে হবে সংগঠিতভাবে। বস্তুত সমাজে দুর্বৃত্তরা সংখ্যালঘু। তারা সংখ্যাই কম। কিন্তু তারা নিজেদের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিসেবে প্রকাশ করে।
৩. এই মুহূর্তে মুসলিম বিরোধিতা সর্বাত্মক :
মুসলিম সম্প্রদায় স্বাধীন ভারতে ‘ডে ওয়ান’ থেকে বিদ্বেষ ও বৈষম্যের শিকার। সত্য বলতে কী, উপনিবেশোত্তর ভারতে কখনো তারা ইনসাফ পায়নি। এজন্য স্বাধীনতা পূর্বের হিন্দু-মুসলিম দীর্ঘ স্বার্থসংঘাত অনেকাংশে দায়ী। এই বিদ্বেষ ও বৈষম্য এখন এদেশে এক ভয়ানক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। দেশের সকল ধর্মের সহিষ্ণু ও শান্তিকামী মানুষদের মহাসংঘ গড়ে তুলতে হবে।
এই মুহূর্তে আমাদেরকে মুসলিম বিরোধী ঘৃণা ও বৈষম্যের ক্ষেত্র চিহ্নিত করতে হবে। সেই সঙ্গে সম্ভাব্য সমাধান ও সুরাহা বের করতে হবে। একাজ খুব সহজ হবে না। কিন্তু করতেই হবে। মনে রাখতে হবে, সকল সম্প্রদায়ের মধ্যে অনেক ভালো মানুষ আছেন। তাদেরকে সঙ্গে নিয়ে আপেক্ষিক স্থিতিশীল ও সমৃদ্ধ সমাজ ও রাষ্ট্র নির্মাণ করতে হবে।
৪. সম্মানজনক জীবন ও জীবিকার চাবিকাঠি আধুনিক জ্ঞান ও বিজ্ঞান চর্চা:
মুসলিম সম্প্রদায়ের সার্বিক উন্নয়ন ও আত্মগরিমা প্রতিষ্ঠা করতে হলে আধুনিক ও দ্বীনি শিক্ষার মেলবন্ধন খুব জরুরি। আধুনিক জ্ঞানবিজ্ঞান ও প্রযুক্তি চর্চা ছাড়া বৈষয়িক উন্নয়ন সম্ভব নয়। মুসলিমদের সক্ষমতা নেই যে তারা নিজেদের সকল ছেলেমেয়েদের আধুনিক শিক্ষার ব্যবস্থা করতে পারবে। এজন্য সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে আধুনিক জ্ঞান ও বিজ্ঞান চর্চা করতে হবে। আবার মুসলিম সম্প্রদায়ের ধর্ম শিক্ষার দায়িত্ব সরকার কেন নেবে। এ দায়িত্ব মুসলিমদের নিজেদের নিতে হবে। এজন্য তাদের নিজস্ব প্রতিষ্ঠান থাকবে। সংবিধান তার অনুমতি দিয়েছে। আমাদের দায়িত্ব, নিজ সম্প্রদায়ের সকল সন্তানের লেখাপড়া নিশ্চিত করতে হবে। মনে রাখতে হবে, সুশিক্ষিত সম্প্রদায়কে সবাই সমীহ করতে বাধ্য। ইহুদি সম্প্রদায় তার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত।
৫. নিরাপত্তাহীনতা:
এদেশে দলিতদের পাশাপাশি মুসলিম সম্প্রদায় দেশের সর্বত্র নিরাপত্তাহীনতার শিকার। বৈষম্যের শিকার। দলিতদের অনেকে এই পরিস্থিতিকে ভাগ্যের পরিহাস বলে মেনে নিয়েছে। কিন্তু মুসলিম সম্প্রদায় এটাকে অস্বাভাবিক ও অন্যায় মনে করে। এই বাস্তবতা মাথায় রেখে ভারতীয় মুসলিম সম্প্রদায় নিজেদের উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নের চেষ্টা করে চলেছে। এজন্য প্রয়োজন, রাষ্ট্র কোথায় কোথায় বৈষম্য করছে তার পরিসংখ্যান তাদেরকে সংরক্ষণ করতে হবে। এজন্য তাদের জন্য একটি সুনির্দিষ্ট গবেষণা সংস্থা থাকবে। সেখানে সংশ্লিষ্ট সব তথ্য সংরক্ষিত থাকবে। তথ্য দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে সংঘটিত অবিচার ও অন্যায় তুলে ধরতে হবে।
বস্তুত গদি মিডিয়া তাদের চিহ্নিত শত্রু। এজন্য বিকল্প মিডিয়া দিয়ে মুসলিমদের নিজেদের অবস্থান তুলে ধরতে হবে। যদি তাদের জীবন ও জীবিকার উপর আঘাত আসে তা প্রতিহত করার জন্য সুনির্দিষ্ট কৌশল থাকবে। যেমন, মুসলিম নেতৃত্বকে হয়রান করলে, মুসলিমদের বিরুদ্ধে অন্যায় আক্রমণ যথা মব লিঞ্চিং ও দাঙ্গা করলে একসঙ্গে দেশব্যাপী নিজেদের গৃহে কালো পতাকা উত্তোলন করে প্রতিবাদ করতে হবে। পরিস্থিতি বুঝে অনশন করতে হবে। বিক্ষোভ মিছিল হতে পারে। সন্ত্রাসীদের চিহ্নিত করতে হবে। তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে। তাদের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক লিখে যেতে হবে। এভাবে সক্রিয় থাকতে হবে। মুখ বুজে সহ্য করলে কোন সমস্যার সমাধান হবে না। যো ডর গিয়া ওহ মর গিয়া।
৬. ইসলামোফোবিয়া মোকাবেলা করতে হবে:
মুসলিম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে একটি চক্র দীর্ঘদিন ধরে সক্রিয়। এখন এদেশে ‘উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা’ তাদের দোসর। অনুগত শিষ্য। যে কাজ তাদের গুরুরা ইউরোপ ও আমেরিকায় করে তাদের অন্ধভক্তরা এদেশে তার পুনরাবৃত্তি করে।
বস্তুত এখন দেশে ও বিদেশে মুসলিম বিরোধী ধারাবাহিক ও পরিকল্পিত সাংস্কৃতিক আক্রমণ ও আগ্রাসন চলছে। দেশের মূলস্রোতের গণমাধ্যম ও সামাজিক গণমাধ্যম, মূলস্রোতের সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে ও বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এক শ্রেণির মুসলিম দুশমন মুসলিম বিরোধী মনস্তত্ত্ব সৃষ্টি করে চলেছে। সুকৌশলে একটি হিড়িক ও জিগির তৈরি করে চলেছে। শুধু তাই নয়, সৃজনশীল শিল্প ও সাহিত্যের মাধ্যমে মুসলিম বিরোধী প্রপাগান্ডা চালিয়ে যাচ্ছে নিরবিচ্ছিন্নভাবে। এজন্য তারা কোটি কোটি টাকা খরচ করে চলচ্চিত্র নির্মাণ করছে। হাজার হাজার ভাড়াটিয়া লেখক ও কলামিস্ট পোষছে।
বস্তুত এই মুসলিম বিরোধী প্লাবন রোখা খুব সহজ কাজ নয়। এজন্য প্রয়োজন প্রতিটি মুসলিম ব্যক্তিগতভাবে এবং সাংগঠনিকভাবে নিজেদের সক্ষমতা অনুসারে কন্টেন্ট তৈরি করবে। গণমাধ্যম সৃষ্টি করবে। সামাজিক গণমাধ্যমে সক্রিয় থাকতে হবে। সৃজনশীল শিল্প ও সংস্কৃতি সৃষ্টি করে এই আগ্রাসনের মোকাবেলা করতে হবে। যুক্তি ও পরিসংখ্যান হবে আমাদের সর্বোত্তম হাতিয়ার। এক্ষেত্রে কুরআনের মূলনীতি অনুসরণ করতে হবে, “মানুষকে আল্লাহর পথে আহবান কর
ক. প্রজ্ঞার মাধ্যমে,
খ. উত্তম উপদেশ দিয়ে এবং
গ. তাদের সঙ্গে বিতর্ক কর উত্তম যুক্তি উপস্থাপন করে।(সূরা নাহল-১২৫)
ইসলাম ঐতিহাসিক ধর্ম। যুক্তিনিষ্ঠ ধর্ম। ইসলাম রূপকথা ও কিংবদন্তি নির্ভর নয়। রূপকথা ও কিংবদন্তি দিয়ে ইতিহাস ও যুক্তি মোকাবেলা করা সম্ভব নয়।
( মতামত লেখকের নিজস্ব)