শফিকুল ইসলাম
মনে পড়ে ছোটবেলার প্রথম রমযান, প্রথম ইফতার,প্রথম তারাবির কথা। আমার জন্ম নদীয়া জেলার হাঁসখালি থানার বড়চুপড়িয়া গ্রামে। বনেদি পরিবারে বড় হয়েছি। বাড়ির বড়োরা সবাই নামাজী ছিলেন।
প্রাইমারিতে পড়ছি। তখন চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ি।যত দুর মনে পড়ে তখন প্রচণ্ড গরম, ঝড় বৃষ্টি আর আমের দিন। বছরের এই সময়টা রোজা রাখা একটু কঠিন হয়। ছোট হলেও আমিও বেশ কয়েকটি রোজা রেখেছিলাম। রোজা রাখতে কষ্ট হলেও বড়দের উৎসাহের কারণে বেশ আনন্দই পেতাম।এখনও মনে পড়ে ছোটবেলায় চৈত্র মাসে রোজা রেখে ছোট আম কুড়িয়ে পেলে বাড়ি না ফেরা পর্যন্ত হাতে নিয়ে ঘুরতাম কিন্তু খেতাম না। ভুলে একটু কামড় দিয়ে খেয়ে একটু পরে যখন মনে হতো আমি রোজা রেখেছি; তখন খুব ভয় লাগত আমার রোজা বুঝি ভেঙে গেল! তখন রোজা যাতে না ভাঙে সে জন্য কত দুশ্চিন্তাই না করতাম!
সেই দিনে গ্রামে সারা দিন খেতে খামারে বিভিন্ন কাজ করেও বেশির ভাগ মানুষই রোজা রাখত। আমাদের বাড়িতে কয়েকজন কাজ করত। তাদের একজন রোজাদার ছিল। তাকে আমরা ইফতারি করাতাম, রাতে খাবার দিতাম।তখনকার সময়ে মানুষ শেষ রাতে সাহরি খাওয়ার জন্য ঘুম ভেঙে যেত এলাকার কিছু লোকের দল বেঁধে ডাকাডাকিতে। আবার বৃষ্টি হলে হয়তো ডাকাডাকির লোক আসত না বা অন্য ঘরের লোক ডাকাডাকি করলেও হয়তো শুনতে পেত না। ফলে কেউ কেউ ধারণা করেই খেয়ে নিত। তখন মসজিদে মাইক ছিলনা।ডাকাডাকির কাজে নামে একজন লোক ছিলেন খুবই উজাড় করে দেওয়ার মতো।তার নাম মনে নেই আমার।নিরক্ষর হলেও বিভিন্ন লোকের গজল গাওয়া থেকে শুনে শুনে যতটুকু মনে রাখতে পেরেছিলেন ততটুকুই গাইতেন এবং সঙ্গে কিছু কথা যোগ করে বিশেষ সুর দিয়ে ডাকতেন। সে কথা মনে পরলে তা আজও কানে বাজে।ছোটবেলায় প্রথম রোজা রাখার স্মৃতিটা অনেক মিষ্টি। তখন বাবা, চাচা -মায়ের কাছ থেকে রোজার শিক্ষাটা খুব সহজে গ্রহণ করতে পেরেছিলাম। মনে আছে, প্রথম রোজা রাখার আগে বাবা-মা আমাকে সেহরি ও ইফতারের নিয়মগুলো খুব সুন্দর করে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। মসজিদের ইমাম সাহেবেরকাছেও শিখেছিলাম।
প্রথম রোজা রাখার দিনটা ছিল খুব গরম। কিন্তু রোজা রাখার আনন্দ আর বাবা-মায়ের ভালোবাসায় সেই গরমটা আর তেমন লাগেনি। সারাদিন রোজা রাখার পর ইফতারের সময়টা ছিল খুব আনন্দের। সবাই মিলেমিশে ইফতার করার দৃশ্যটা আজও মনে গেঁথে আছে। দালান বাড়িতে সবাই লম্বা লাইন করে একসঙ্গে বসে ইফতারি করতাম। ঘড়ির দিকে লক্ষ্য ছিল আমাদের। আব্বা বলতেন, ইফতারির সময় হয়েছে, ইফতার কর।
ছোটবেলার সেই রোজাটা ছিল শুধু একটি উপোস নয়, বরং ছিল ধর্মীয় অনুভূতির প্রথম স্বাদ, যা আজও মনে গেঁথে আছে। রমজান মাসের পবিত্রতা ছোট-বড় সবার মধ্যেই প্রভাব বিস্তার করে। বড়রা যে কাজ করে, ছোটদের মধ্যেও সেটার প্রভাব পড়ে। মূলত মানুষের স্বভাব ও অভ্যাস গড়ে ওঠে ছোটবেলায়। বড় হয়ে মানুষ সে কাজটিই করে, যা সে ছোটবেলায় দেখে ও অভ্যাস করে। তাই রমজান মাসের রোজা রাখতে ছোটদের উৎসাহ দেওয়া, তাদের নিয়ে জামাতের সঙ্গে তারাবি নামাজ পড়া, একসঙ্গে সেহরি ও ইফতার করা অনেক ফলদায়ক কাজ। ঘরের ছোট সদস্যরা রোজা রাখলে সবার সামনে বাহবা দেওয়া, প্রশংসা করা, সম্ভব হলে তাদের জন্য পুরস্কারের ব্যবস্থা করা, তাদের পছন্দমতো ইফতারের অফার করা জরুরি। এতে ছোটরা আরও উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত হবে। এভাবে ধীরে ধীরে নামাজ, রোজা ইত্যাদি ইবাদতে তারা অভ্যস্ত হয়ে উঠবে।
যেসব শিশুকে ছোটবেলায় রোজা রাখতে অভ্যস্ত করে গড়ে তোলা হয় না, পরিবারে রোজা রাখার শিক্ষা দেওয়া হয় না, তারা বড় হলে রোজা রাখতে পারে না বা রাখলেও প্রচণ্ড কষ্ট হয়। পক্ষান্তরে যেসব সন্তানকে ছোটবেলাতেই রোজা রাখার শিক্ষা দেওয়া হয়, মা-বাবা সঙ্গে নিয়ে তারাবি নামাজ পড়েন, একসঙ্গে সেহরি খান, ইফতার করেন, সন্তানদের দিয়ে পাশের আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশীর বাসায় ইফতার পাঠান, সেসব শিশুর বড় হয়ে রোজা রাখতে একটুও কষ্ট হয় না। বরং তারা রোজা না রাখলে মনের ভেতর এক ধরনের অস্বস্তি ও অশান্তি অনুভব করে। আর হ্যাঁ শিশুদের রোজার সওয়াব তাদের মা-বাবারা প্রাপ্ত হন।
দুঃখজনক হলেও সত্য, কোন কোন মা-বাবা শিশুদের তো দূরের কথা, রোজা ফরজ হয়েছে এমন সন্তানদেরও রোজা রাখতে নিরুৎসাহিত করেন বা রাখতে দেন না। এই ভয়ে, রোজা রাখলে গরমে তাদের কষ্ট হবে। শরীর শুকিয়ে যাবে। পড়াশোনা করতে পারবে না। পরীক্ষার রেজাল্ট খারাপ হবে ইত্যাদি। আশ্চর্য, তারা সন্তানদের ইহকালীন পরীক্ষাকে ভয় করেন অথচ আখেরাতের মহাপরীক্ষাকে ভয় করেন না। দুনিয়ার সামান্য কষ্টকে ভয় করেন অথচ জাহান্নামের যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি ভয় করেন না। সন্তানদের দুনিয়াবি জীবনের ক্যারিয়ারের কথা চিন্তা করেন। অথচ আখেরাতের জীবনের শেষ পরিণামের কথা ভাবেন না। তা ছাড়া ডাক্তারি শাস্ত্র এবং বিজ্ঞানও বলে, বছরের নির্দিষ্ট একটি সময়ে উপোস থাকলে মানে রোজা রাখলে মানুষের কোনো ক্ষতি হয় না। বরং শারীরিক অনেক উপকারিতা লাভ হয়।
রাসুল (সা.), সাহাবায়ে কেরাম এবং পরবর্তী মনীষীরাও ছোটদের রোজা রাখতে উদ্বুদ্ধ করতেন, উৎসাহ জোগাতেন। শুধু তাই নয়, অভিভাবকদেরও বলতেন যেন তাদের শিশুদের রোজা রাখতে উৎসাহ দেন।
স্মৃতি সতত সুখের। প্রথম রোজা, প্রথম ইফতারি, প্রথম সাহরির স্মৃতি তাই ভুলতে পারিনি। প্রথম রোজাতে যাদের সঙ্গে বসে ইফতারি করেছিলাম, তাদের অনেকেই আর পৃথিবীতে নেই। তাদের জন্য আমি দোয়া করি, আপনারাও করবেন সেই প্রত্যাশা নিয়ে শেষ করলাম।