মুদাসসির নিয়াজ
২০২৪ সালের শেষ লগ্নে বিষাদ ঘনাল প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের প্রয়াণে। ২৬ ডিসেম্বর না ফেরার দেশে চলে গেলেন নম্র, ভদ্র, বিনয়ী, শিক্ষিত, মার্জিত, সংযমী, রুচিশীল, সজ্জন ও মুক্তমনা এই রাজনীতিবিদ। রাজীব গান্ধীর প্রয়াণের পর ভিপি সিং, চন্দ্রশেখর, দেবেগৌড়া, আই.কে গুজরাল এবং অটল বিহারী বাজপেয়ী (১৩ দিন ও ১৩ মাসের সরকার) ইত্যাদি একের পর এক দুর্বল জোট সরকারের কারণে ভেঙে পড়া অর্থনীতির মেরুদন্ড সোজা করতে রীতিমত সার্জিক্যাল স্ট্রাইক চালিয়েছিলেন মনমোহন সিং। যাঁর হাত ধরে কোমাচ্ছন্ন অর্থনীতি ভেন্টিলেশন থেকে বেরিয়ে এসেছিল। যিনি বলতেন কম, শুনতেন বেশি। সমালোচনা গায়ে মাখতেন না। রাজনৈতিক ক্ষমতার অলিন্দ নীলয় যখন দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত, তখন স্বচ্ছতা ও সততার প্রতীক হিসেবে দিল্লির দরবারে আবির্ভূত হন মনমোহন সিং।
শুধু মেধাবী ছাত্রই নন, মনমোহন ছিলেন একজন সফল শিক্ষক, যশস্বী অর্থনীতিবিদ। জীবনে কখনও কোন ক্লাসে হননি সেকেন্ড। প্রতিটা সেকেন্ড তিনি ইতিবাচক ভাবনায় নিবেদিত ছিলেন। ডার্টি পলিটিক্স তার অস্থি মজ্জাগত ছিল না। জন্ম ১৯৩২ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর, বর্তমান পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের চকওয়াল জেলার প্রত্যন্ত গ্রাম গাহ-এ। ১৯৫২ সালে পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক এবং ১৯৫৪ সালে স্নাতকোত্তর করে পাড়ি দেন বিলেত। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫৭ সালে অর্থনীতিতে স্নাতক এবং ১৯৬২ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের নাফিল্ড কলেজ থেকে ডি’ফিল করেন। ইউনিভার্সিটি অফ আলবার্টার তরফে সাম্মানিক ডক্টর অফ ল’, ২০০৬ সালের জুনে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির তরফে পান সাম্মানিক ডক্টর অফ সিভিল ল। কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটিও তাঁকে একই সম্মান জানায়। সেন্ট জন্স ইউনিভার্সিটির তরফে তাঁর নামে পিএইচডি স্কলারশিপ চালু হয়েছিল, যার নাম ‘ড. মনমোহন সিং স্কলারশিপ’।
এরপর দেশে ফিরে যোগ দেন রাষ্ট্রসংঘের কাজে। ১৯৬৬-১৯৬৯ পর্যন্ত সেখানকার বাণিজ্যিক উন্নয়ন বিভাগে কর্মরত ছিলেন। ১৯৬৯ সালে দিল্লি স্কুল অব ইকনমিক্সের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের অধ্যাপক হিসাবে নিযুক্ত হন। ১৯৭২ সালে কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রকের প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টা হন। ১৯৭৬ সালে হন কেন্দ্রীয় অর্থসচিব। ১৯৮০ থেকে ১৯৮২ প্রর্যন্ত ছিলেন যোজনা কমিশনে। প্রণব মুখোপাধ্যায় তখন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী। ১৯৮২ থেকে ১৯৮৫ পর্যন্ত রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর ছিলেন মনমোহন সিং। ১৯৮৫ থেকে ১৯৮৭ পর্যন্ত ছিলেন যোজনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারপার্সন। ১৯৮৭ সালে অর্থনীতি বিষয়ক স্বাধীন সংস্থা সাউথ কমিশনের সেক্রেটারি জেনারেল পদে বসেন। ১৯৯১ সালের মার্চে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন বা ইউজিসি-র চেয়ারম্যান হন।
ওই বছরই জুন মাসে পিভি নরসিমা রাও এর সরকারে অর্থমন্ত্রী হন মনমোহন। অর্থাৎ ১৯৯১ সালেই মনমোহন সিংয়ের রাজনৈতিক ইনিংস শুরু হয়। প্রথমেই দেশের অর্থমন্ত্রী, তাও আবার যখন ভেঙে গিয়েছে সোভিয়েত ইউনিয়ন। যার প্রভাব বৈশ্বিক রাজনীতির মানচিত্র বদলে দিয়েছে, নিউ ওয়ার্ল্ড তৈরি হয়েছে। তার এক দশক আগেই অবশ্য ইউরোপীয় ব্লক দুর্বল হতে শুরু করেছে। আর এসবের অনিবার্য মাশুল দিতে হচ্ছে অর্থনীতিকে। এই প্রেক্ষিতে দেশের অর্থনীতির ব্যাটন হাতে নিলেন মনমোহন সিং। জাঁদরেল অর্থনীতিবিদ মনমোহনের হাত ধরেই বদলাতে শুরু করল অর্থনীতির হাল হকীকত।
২০০৪ সালে সব সমীক্ষা ও পূর্বাভাস উলটে দিয়ে অটল বিহারী বাজপেয়ীর এনডিএ সরকারকে হারিয়ে ক্ষমতায় এল ইউপিএ সরকার। কংগ্রেস হাইকমান্ড সোনিয়া গান্ধী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বেছে নিলেন পণ্ডিত, অর্থনীতিবিদ এবং আপাদমস্তক স্বজ্জন, নিপাট ভদ্রলোক তথা স্বচ্ছ ভাবমূর্তির মনমোহন সিংকে। কিন্তু শরিক দলগুলো নাছোড়বান্দা হওয়ায় ইউপিএ সরকারের চেয়ারপার্সন হন সোনিয়া। ২০১৮ সালে সোনিয়া বলেছিলেন, ‘জানতাম মনমোহন সিং আমার থেকে অনেক ভাল প্রধানমন্ত্রী হবেন’।
মনমোহন সিং হলেন দেশের প্রথম অ-হিন্দু এবং অ-গান্ধী কংগ্রেসী নেতা, যিনি পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর পর টানা ১০ বছর প্রধানমন্ত্রী ছিলেন আয়ারাম গয়ারাম বা ঘোড়া কেনাবেচা না করেই। কিন্তু বিরোধী শিবির, বিশেষত বিজেপি মনমোহনকে ‘অ্যাক্সিডেন্টাল প্রাইম মিনিস্টার’ হিসেবে দেগে দেয়। যদিও পরপর দুই মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হয়ে মনমোহন সিং প্রমাণ করলেন অ্যাক্সিডেন্টাল নন, তিনি ইন্সিডেন্টাল প্রাইম মিনিস্টার। প্রমাণ করলেন তিনি মৌনমোহন নন, তিনি মনমোহন। তবে ২০০৪ সালে বাজপেয়ী সরকার যে হেরে যাবে এবং তারপর মনমোহন প্রধানমন্ত্রী হবেন – দুটোই অবিশ্বাস্য ছিল। পোখরান, কার্গিলের কারণে বাজপেয়ীর রাশি তখন তুঙ্গে। প্রচারের দৌলতে অটলজী তখন রীতিমতো শাইনিং। আর পরবর্তী প্রধানমন্ত্রীর দৌড়ে সবার আগে ছিলেন সোনিয়া গান্ধী এবং দ্বিতীয় স্থানে ছিলেন প্রণব মুখার্জী। তারপরেও কোন লবিবাজি গ্রুপবাজি না করে দেশের ত্রয়োদশ প্রধানমন্ত্রী হলেন মনমোহন সিং।
মনমোহন সহজাতভাবেই মিতভাষী বা মৃদুভাষী ছিলেন। বাকপটু ছিলেন না, বাগাড়ম্বর করতেন না, আলটপকা মন্তব্য করতেন না, প্রচারের ঢক্কানিনাদে অবগাহন করতেন না। অগত্যা তাঁকে মৌনিবাবা তকমা দেয় বিজেপি। কখনও বলা হত, ইউপিএ সরকারের রিমোট কন্টোল আছে ১০ জনপথ রোডে কিংবা স্টিয়ারিং ধরে আছেন বিদেশীনী। কখনও বলা হত সোনিয়া রাহুলদের কাঠপুতুল। তিনি কিন্তু কখনোই রাজনৈতিক শিষ্টাচার বা সৌজন্যের বাইরে গিয়ে এসবের মুখতোড় জবাব দেননি। তাঁর বিদেশি ডিগ্রি নিয়েও বহুবার খোঁচা দেওয়া হয়েছে, কটাক্ষ করা হয়েছে গেরুয়া শিবিরের শীর্ষস্তর থেকে। তবুও তিনি নীরবে কাজ করে গিয়েছেন। ঘটিয়েছেন নিঃশব্দে বিপ্লব। ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দ্বিতীয় মেয়াদ শেষে তিনি বলেছিলেন, রাজনীতিতে ব্যক্তি আসবে যাবে, ক্ষমতায় পালাবদল ঘটবে, কিন্তু প্রতিষ্ঠান রয়ে যাবে। সুতরাং সংবিধান, গণতন্ত্র যেন কোনভাবেই কলুষিত না হয়। আজ কিন্তু তাঁর আশঙ্কাই সত্যি হয়েছে। ফ্যাসিবাদের লম্ফঝম্ফ এখন দেশজুড়ে।
নরসীমা রাও কার্যত সংখ্যালঘু সরকার চালালেও তারপর আই.কে গুজরাল এবং দেবেগৌড়া সরকার কিন্তু পিভির মতো পাঁচ বছর টেকেনি। বাজপেয়ী সরকারও প্রথমে ১৩ দিন, তারপর ১৩ মাস এবং অবশেষে পাঁচ বছর টিকেছিল। তারপর তেমন কোন উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক ব্যাকগ্রাউন্ড ছাড়াই মনমোহন সিং প্রধানমন্ত্রী হন এবং দুই মেয়াদে পরপর ১০ বছর অবলীলায় ইউপিএ সরকারের পাইলট হন। সেই সময় বিজেপি কমনওয়েলথ গেমস, টুজি স্পেকট্রাম কেলেঙ্কারি এবং কালো টাকা সংক্রান্ত অভিযোগে দেশ উত্তাল করে দিয়েছিল। কিন্তু নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতাসীন হওয়ার পর দেখা গেল সেসব জুমলা ছিল। তাই মনমোহন সরকারের কাউকেই বেশিদিন জেলে রাখা সম্ভব হয়নি। আর বর্তমানে কালো টাকা আরও বেড়েছে এবং দেশে ফেরেনি।
টানা ৩৩ বছর রাজ্যসভার সাংসদ থাকার পর ২০২৪ সালের এপ্রিলে ৯১ বছর বয়সী মনমোহন সিং সক্রিয় রাজনীতি থেকে অবসর নেন। তৃতীয় বার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে পর্যন্ত নরেন্দ্র মোদী এই পণ্ডিত, মৃদুভাষী, ধুরন্ধর অর্থনীতিবিদ তথা দেশনেতাকে তার নীরবতার জন্য ক্রমাগত আক্রমণ শানিয়ে গিয়েছেন। ২০০৮ সালে সিপিএম সমর্থন তুলে নিয়েছিল মনমোহন সিং সরকার থেকে। অথচ ২০১৭ সালের নভেম্বরে বামদুর্গ কেরলের কোচি শহরে অনুষ্ঠিত কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির সভায় দাঁড়িয়ে মনমোহন সিং বলেছিলেন, বিজেপিকে হটাতে সিপিএমকেও সঙ্গে চাই। উল্লেখ্য, ২০০৮ সালের জুলাই মাসে ৪টি বাম দল সিপিএম, সিপিআই, ফরওয়ার্ড ব্লক এবং আরএসপি একযোগে মনমোহন সিংয়ের নেতৃত্বাধীন ইউপিএ–১ সরকারের ওপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নেয়। বাইরে থেকে সমর্থন দেওয়া বামফ্রন্ট সমর্থন তুলে নিলেও লোকসভার স্পিকার পদে ইস্তফা না দিয়ে নজির সৃষ্টি করেন আদর্শবাদী সিপিএম সাংসদ ব্যারিস্টার সোমনাথ চ্যাটার্জি। পার্টি লাইনের বাইরে যাওয়ার মাশুল হিসেবে তাঁকে দল থেকে বহিষ্কার করে সিপিএম। উল্লেখ্য, ভারত-মার্কিন পরমাণু চুক্তির প্রতিবাদে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বাম দলগুলি। যদিও তাদের ওই যুক্তি ধোপে টেকেনি। পরমাণু চুক্তির বিষয়টিকে অজুহাত বলে অভিহিত করে বিশেষজ্ঞ মহল। একইসঙ্গে সিপিএমকে চরম সুবিধাবাদী বলে সমালোচনা করা হয়। সেসব মুখ বুজে হজম করতে হয় তদানীন্তন সিপিআইএম সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাটকে। ইউপিএ সরকারের পতনের পরেও মনমোহন কিন্তু হরকিষেণ সিং সুরজিৎ এবং জ্যোতি বসুর ভূয়সী প্রশংসা করেন।
বামফ্রন্টের মতোই ২০১২ সালের সেপ্টেম্বরে মনমোহন সিংয়ের দ্বিতীয় ইউপিএ সরকার থেকে সমর্থন তুলে নেয় তৃণমূল কংগ্রেস। এক জন ক্যাবিনেট মন্ত্রী ও পাঁচ জন প্রতিমন্ত্রী মিলিয়ে তৃণমূলের ১৯ জন সাংসদ ছিল সেবার। মূলত ডিজেলের দাম বৃদ্ধি, রান্নার গ্যাসে ভর্তুকি ছাঁটাই আর খুচরো ব্যবসায় বিদেশী বিনিয়োগের অনুমতি দেওয়ার প্রতিবাদে মনমোহন সরকার থেকে সমর্থন তুলে নেয় টিএমসি। তবে উভয় ক্ষেত্রেই সরকারকে বাঁচাতে সক্ষম হয়েছিলেন উদার অর্থনীতির নয়া রূপকার প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং।
মনমোহন একমাত্র প্রধানমন্ত্রী, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর হিসেবে যার সই আছে কাগজের নোটে। ১৯৮৪ সালে ইন্দিরা হত্যার পর শিখ-বিরোধী দাঙ্গায় অভিযোগের আঙ্গুল ওঠে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে। তার জন্য প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে ক্ষমা চেয়েছিলেন মনমোহন সিং। নরেন্দ্র মোদি কিন্তু গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালে ২০০২ এর হাড়হিম করা দাঙ্গার জন্য আজ পর্যন্ত ক্ষমা চাননি।
জীবনে একবার মাত্র লোকসভা ভোটে দাঁড়িয়ে পরাজিত হন মনমোহন সিং। তারপর বরাবর আসাম থেকে রাজ্যসভায় কংগ্রেসের টিকিটে জিতেছেন। রাজনীতির অভিধানে ‘জননেতা’ হয়ে উঠতে পারেননি তিনি। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সমঝদার জনতার চোখে সত্যিকার জননেতা হতে পেরেছিলেন। চাই ১৯৯১ এর পর কংগ্রেসের সবথেকে ভাল নির্বাচনী ফল হয়েছিল ২০০৯ সালে। মনমোহন সিং এর নেতৃত্বে ইউপিএ যখন দ্বিতীয়বার জয়ী হয়।
জাতিগত ও ভাষাগত সংখ্যালঘুদের আর্থ সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে সাচার কমিটি এবং রঙ্গনাথ মিশ্র কমিশন গঠন এবং তাদের রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে একগুচ্ছ পরিকল্পনা মনমোহনেরই মস্তিষ্ক প্রসূত। সংখ্যালঘু উন্নয়নে তিনি ১৫ দফা কর্মসূচিও ঘোষণা করেছিলেন। দেশের অর্থনীতিকে আইসিইউ থেকে উদ্ধার করতে তাঁকে নোটবন্দি করতে হয়নি। ওয়ান নেশন ওয়ান ইলেকশন এর চমক বা গিমিক থেকে শত যোজন দূরে অবস্থান করে রাইট টু এডুকেশন এবং রাইট টু ইনফরমেশন অ্যাক্ট তৈরি করে দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছিলেন মনমোহন। মৃত্যু মানুষকে মহান বানায় – এই আপ্তবাক্য অন্তত তাঁর ক্ষেত্রে খাটে না। তিনি ছিলেন লিভিং লেজেন্ড।