“দেশভাগ” শব্দটি ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে এক রক্তাক্ত অধ্যায়ের প্রতীক। ১৯৪৭ সালের এই ঐতিহাসিক ঘটনাকে সাধারণত ভারত-পাকিস্তান বিভক্তি হিসেবে দেখা হয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে, দেশভাগের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল দুটি বৃহৎ প্রদেশ—বাংলা ও পাঞ্জাবের বিভক্তি। ইতিহাসবিদ জয়া চট্টোপাধ্যায়ের মতে,”১৯৪৭-এর বিভাজন ছিল দুই প্রদেশের বিভাজন—বাংলা ও পাঞ্জাব। বাকি ভারত শুধু দর্শক ছিল।”
বাংলা-পাঞ্জাব বিভক্তির কারণ: রাজনীতি ও ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার।
- ১. জনতাত্ত্বিক বাস্তবতা ও ব্রিটিশ নীতি:
বাংলা ও পাঞ্জাব উভয়ই ছিল ধর্মীয়ভাবে মিশ্রিত সমাজ। বাংলায় মুসলমানদের সংখ্যা ছিল ৫৫% এবং পাঞ্জাবে ৫৩%। এই সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে ব্রিটিশরা দেশভাগের যৌক্তিকতা দাঁড় করিয়েছিল। কিন্তু ইতিহাসবিদ সুমিত সরকারের মতে, “ব্রিটিশরা ‘ভাগ করো ও শাসন করো’ নীতির মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক বিভাজনের বীজ বপন করেছিল, যা ১৯৪৭-এ পরিণতি লাভ করে।”
- ২. গণভোটের অনুপস্থিতি:
দেশভাগের ক্ষেত্রে বাংলা ও পাঞ্জাবে গণভোট না হওয়াকে ইতিহাসবিদ সুগত বসু “ঐতিহাসিক অবিচার” বলে অভিহিত করেছেন। ১৯৪৭ সালের জুন মাসে বাংলার বিধানসভায় মুসলিম সদস্যদের সমর্থনে অবিভক্ত বাংলার প্রস্তাব গৃহীত হলেও, কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভার বিরোধিতায় তা নস্যাৎ হয়ে যায়। সাহিদ আমিন এই প্রসঙ্গে বলেন, “এই সিদ্ধান্ত ছিল উচ্চবর্ণীয় হিন্দু অভিজাতদের ভূখণ্ড রক্ষার রাজনীতি।”
বিশিষ্ট জনের ভূমিকা: রবীন্দ্রনাথ, আম্বেদকর ও শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী।
- ১. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর: অখণ্ডতার স্বপ্ন;
১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথের প্রতিবাদ ইতিহাসের এক স্মরণীয় অধ্যায়। তাঁর কবিতা “বাংলার মাটি, বাংলার জল” অখণ্ড বাংলার আবেগকে ধারণ করে। ১৯৪৭-এর বিভাজন সম্পর্কে তিনি সরাসরি মন্তব্য না করলেও, ১৯৩৩ সালে লেখা এক চিঠিতে তিনি সতর্ক করে বলেছিলেন, “ধর্মের নামে বিভাজন মানবতার জন্য অভিশাপ।”
- ২. ড. বি. আর. আম্বেদকর: দলিতদের আশঙ্কা
আম্বেদকর তাঁর Pakistan or The Partition of India গ্রন্থে লিখেছিলেন, “হিন্দু সমাজ যদি মুসলিমদের সাথে সমতা চাইত, তাহলে দেশভাগ অনিবার্য হত না।” তিনি বিশেষ করে দলিতদের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেন। “দেশভাগে দলিতরা উভয় পক্ষের খেসারত দেবে।” এই পরিপ্রেক্ষিতে ইতিহাসবিদ নির্মলেন্দু চৌধুরীর বলেন, “আম্বেদকরের ভবিষ্যদ্বাণী সত্যি হয়েছিল—দলিতরা উদ্বাস্তু শিবিরে সবচেয়ে বেশি নিপীড়িত হয়।”
- ৩. শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি: বাংলা বিভক্তির স্থপতি
শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি বাংলাকে হিন্দু ও মুসলিম অঞ্চলে ভাগের দাবি জানিয়ে বলেছিলেন,”পূর্ববঙ্গ পাকিস্তানে গেলে পশ্চিমবঙ্গকে ভারতেই রাখতে হবে।” ইতিহাসবিদ তানিকা সরকার এই সিদ্ধান্ত সম্পর্কে বলেন,”মুখার্জির সিদ্ধান্ত ছিল বাংলার গ্রামীণ সমাজের চেয়ে কলকাতাকেন্দ্রিক উচ্চবর্ণের স্বার্থরক্ষার কৌশল।”
এই বিষয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক শক্তির ভূমিকায় দেখি হিন্দু মহাসভার বিনায়ক দামোদর সাভারকর ও শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় হিন্দু রাষ্ট্রের দাবিতে সরব ছিলেন। যদিও তাঁরা মুসলিম লীগের বিরোধিতা করতেন, কিন্তু সাম্প্রদায়িক বিভাজনেও তাঁরা বলিষ্ঠ সমর্থন যুগিয়েছিলেন।
জাতীয় কংগ্রেসের জওহরলাল নেহরু, মহাত্মা গান্ধী ও বল্লভভাই প্যাটেল একীভূত ভারতের পক্ষে ছিলেন। কিন্তু মুসলিম লীগের চাপ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও ব্রিটিশদের “ভাগ করো ও শাসন করো” নীতির মুখে ১৯৪৭-এ দেশভাগ মেনে নেন।
কমিউনিস্ট পার্টির ক্ষেত্রে দেখা যায় প্রাথমিক পর্যায়ে দেশভাগের বিরোধিতা করলেও পরবর্তীকালে বাংলার ভাগের পক্ষে জ্যোতি বসু ভোট দেন। তবে তাঁদের প্রভাব ছিল সীমিত।
অন্যদিকে মুসলিম লীগ ও মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর নেতৃত্বে মুসলিম লীগ দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে “পাকিস্তান” দাবি করে। ১৯৪৬ সালের প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবসে সংঘর্ষ বাঁধিয়ে দেশভাগের পথ সুগম করে। এক্ষেত্রে দেশের সাধারণ মানুষের ভূমিকা ছিলনা কিন্তু তাদের ভোগান্তির শেষ এখনো হয়নি।
সাধারণ হিন্দু ও মুসলিমদের অবস্থান :
অনেক সাধারণ হিন্দু দেশভাগের বিরোধিতা করলেও হিন্দু মহাসভার প্রভাবে কেউ কেউ বিভাজন মেনে নেয়। পূর্ব পাঞ্জাব, কলকাতা ও নোয়াখালীতে হিংস্র দাঙ্গায় তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
অপরদিকে, অনেক মুসলমান পাকিস্তানের স্বপ্ন দেখলেও অনেকের জন্য এটি ছিল বাধ্যতামূলক স্থানান্তরের যন্ত্রণা। পশ্চিম পাঞ্জাব ও বাংলায় মুসলিমরা ব্যাপকভাবে আক্রান্ত হয়। এই সময় লক্ষ লক্ষ হিন্দু ও মুসলিম ক্ষতিগ্রস্ত ও সর্বশান্ত হয়।
দেশভাগের দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতি:
- ১. দলিত ও আদিবাসীদের দুর্গতি:
উর্বশী বুতালিয়ার The Other Side of Silence গ্রন্থে উদ্বাস্তু দলিত নারীদের দুঃখ-দুর্দশার কথা উঠে এসেছে, “তাদের জন্য না ছিল পুনর্বাসন, না নিরাপত্তা।”
- ২. সাংস্কৃতিক বিভাজন:
বাংলার লোকসংস্কৃতি গবেষক অমিতাভ ঘোষ বলেন,”ভাষা একই থাকলেও পূর্ব ও পশ্চিমবাংলার মধ্যেকার বিভাজন এখনও রক্তক্ষরণ করে।”
- ৩. মুসলিম সম্প্রদায়ের উপর বৈষম্য
CAA ও NRC-এর প্রসঙ্গে ইতিহাসবিদ রামচন্দ্র গুহ বলেন, “দেশভাগের অসমাপ্ত প্রকল্প আজও মুসলিমদের লক্ষ্য করে।” যার প্রতিফলন আজকাল দেখা যায়।
ইতিহাসের পুনর্পাঠ প্রয়োজন:
দেশভাগ কেবল রাজনৈতিক সীমানা পরিবর্তন নয়, এটি ছিল সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ের মর্মান্তিক বিভাজন। জয়া চট্টোপাধ্যায় যথার্থই বলেছেন, “বাংলা ভাগই ছিল দেশভাগের প্রোটোটাইপ।” নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ছিলেন। তাঁর আজাদ হিন্দ ফৌজে হিন্দু-মুসলিম-শিখ-খ্রিস্টান সবাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন,
“ধর্ম ব্যক্তিগত, কিন্তু দেশ সবার।” সুতরাং, ইতিহাসের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদের নতুন করে ভাবতে হবে, যাতে বিভেদের রাজনীতি পুনরাবৃত্তি না ঘটে। ইতিহাসবিদ সিদ্ধার্থ ঘোষ যথার্থই বলেন,”যারা ইতিহাস ভুলে যায়, তারা একই ভুলের পুনরাবৃত্তি করতে বাধ্য হয়।”