ভারতবর্ষের ইতিহাস বহুধা-বিচিত্র, বহুস্তরীয়। এই উপমহাদেশের মাটিতে যুগে যুগে মানুষের চলাফেরা, সংস্কৃতির লেনদেন, ধর্মের পরিবর্তন এবং সামাজিক রূপান্তর ঘটেছে। কিন্তু আজকের দিনে দাঁড়িয়ে, একটা প্রশ্ন আমাদের সবার সামনে দাঁড়িয়ে আছে—এটা কি ইসলাম বিরোধী, না মুসলমান বিরোধী? এটা কি সত্যিই ধর্মের বিরোধিতা, নাকি এর গভীরে রয়েছে সুপরিকল্পিত অর্থনৈতিক স্বার্থ, যা জাতিসত্তা, ধর্মীয় পরিচয়কে অস্ত্র বানিয়ে একে অপরের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দেয়?
ধর্মান্তরের ইতিহাস ও বাস্তবতা
ভারতের অসংখ্য মুসলমান কোনও আরব কিংবা পারস্য থেকে আসা নয়। এরা এ দেশেরই সন্তান। রাজবংশী মুসলমান, কামতাপুরী মুসলমান, জাঠ মুসলমান (পাঞ্জাব ও হরিয়ানা) মেও মুসলমান (রাজস্থান-হরিয়ানা) ম্যাপিলা মুসলমান (কেরালা) গাড্ডি মুসলমান (জম্মু-কাশ্মীর) দেসি মুসলমান (অসম) কুনবি-মুসলমান (মহারাষ্ট্র) ভিল মুসলমান (রাজস্থান-গুজরাত) ধাঙ্গর মুসলমান (মহারাষ্ট্র)জাঠ মুসলমান, পাঞ্জাবি মুসলমান, মল্লিক, মণ্ডল নম: শুদ্র থেকে ধর্মান্তরিত। এরা সবাই ইতিহাসের ধারাবাহিক রূপান্তরের মধ্য দিয়ে এই পরিচয় ধারণ করেছেন। কেউ কখনও বৌদ্ধ ছিলেন, পরে হিন্দু হয়েছেন, আবার কেউ মুসলমান হয়েছেন, কেউ খ্রিষ্টান। এটি ব্যক্তির আত্মপরিচয়ের বহমান ধারা। তাহলে কার বিরুদ্ধে এই বিদ্বেষ?
বিভেদের রাজনীতি: দেশজ না বিদেশী?
বিভেদ সৃষ্টিকারীরা 'স্বদেশী' ভাবনার কথা বললেও, তাদের রাজনৈতিক কৌশল ও অর্থনৈতিক স্বার্থ আসলে বহুজাতিক পুঁজির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তারা দেশে হানাহানি লাগিয়ে, জনগণের মধ্য বিভেদ তৈরি করে, রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে চায়। এর পেছনে আছে বিদেশি অর্থপুষ্ট বৃহৎ পুঁজিপতিদের স্বার্থ। দেশে যারা শ্রমিক, কৃষক, আদিবাসী—তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন নয়; বরং তাদের সম্পদ লুণ্ঠন করে সেই সম্পদ বিদেশে পাচার করাই এদের মূল উদ্দেশ্য।
“ভারতের মূলনিবাসী কারা?
আজ যারা মুসলমান, কাল তারা হিন্দু ছিল। আজ যারা হিন্দু, পূর্বে তারা বৌদ্ধ ছিল। আদিবাসীদের মধ্যে কেউ খ্রিষ্টান, কেউ সনাতনী, কেউ বা অন্য কোনো ধর্মে। এই সবকিছুই এক অবিচ্ছেদ্য জাতিগত ইতিহাস। তারা সবাই মূলত এই দেশের সন্তান, এই মাটির উত্তরসূরি। তাদের ধর্মপরিচয় আসলে তাদের আত্মপরিচয়ের মাত্র একটি মাত্রা। এই সত্যকে অস্বীকার করে যারা মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করছে, তারা আসলে শাসক গোষ্ঠীর হাতিয়ার হয়ে কর্ম করে চলেছে।
বিভেদের রাজনীতির কৌশল
রাজবংশী হিন্দুকে রাজবংশী মুসলমানের বিরুদ্ধে, জাঠ হিন্দুকে জাঠ মুসলমানের বিরুদ্ধে, হিন্দু আদিবাসীকে খ্রিষ্টান আদিবাসীর বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়ে, একে অপরকে দুর্বল করে শাসকগোষ্ঠী দেশকে লুটে নিচ্ছে। এই "বিভাজন করে শাসন করো" নীতি বহু পুরনো, কিন্তু আজও তা অত্যন্ত কার্যকরভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। আর সাধারণ মানুষ, ধর্মীয় বিভেদের মোহে, এই সত্য বুঝতে পারছে না।
পথ কোথায়?
এই পিছিয়ে পড়া ভারতবাসী, যারা এদেশের মূলবাসী, তাদের নিজেদের ইতিহাস জানতে হবে। বুঝতে হবে তাদের পূর্বপুরুষেরা এই দেশেরই সন্তান। ধর্মীয় পরিচয় তাদের বিভক্ত করতে পারে না, যদি তারা নিজেদের ঐতিহ্য, সংগ্রামের ইতিহাস আর মাটির সঙ্গে সম্পর্কটা মনে রাখে। তাদের বোঝাতে হবে, প্রকৃত শত্রু তাদের সেই বিভেদকামী শক্তি, যারা ধর্মের মোড়কে অর্থনৈতিক শোষণ চালিয়ে যাচ্ছে।
পরিশেষে বলা যায়, ভারতবর্ষের মানুষকে আজ আবারও ঐক্যের ডাক দিতে হবে। ধর্ম, জাতি, ভাষা নয়—মানুষের অধিকার, সম্মান আর সমতার ভিত্তিতে সমাজ গঠন করতে হবে। বিভেদের রাজনীতি আর বিদেশী পুঁজির চক্রান্তকে বুঝে, তার বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। এই দেশ কারও একার নয়, এই মাটি সকলের। শাসকগোষ্ঠীর দানবীয় লোভ আর শোষণের চক্র থেকে মুক্তি পেতে হলে, সেই ঐক্যই হতে পারে একমাত্র পথ।
এই সত্য যত দ্রুত বোঝা যাবে, তত দ্রুত ভারতবর্ষ তার প্রকৃত মুক্তির পথে এগোবে।