জানে আলম
ভারত কি সত্যিই এগোচ্ছে, নাকি অন্ধকারের পথে হাঁটছে?
একটি জাতির প্রকৃত উন্নতি নির্ভর করে তার সামাজিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর। কিন্তু বর্তমান ভারত কি সত্যিই উন্নতির পথে? নাকি আমরা এক গভীর সংকটের দিকে এগোচ্ছি? সাম্প্রতিক বছরগুলিতে ভারতের সমাজ, রাজনীতি ও সংস্কৃতিতে এমন কিছু পরিবর্তন এসেছে, যা এক ভয়াবহ ভবিষ্যতের ইঙ্গিত দিচ্ছে। এটি কোনো একক দলের বিরুদ্ধে অভিযোগ নয়, বরং সামগ্রিকভাবে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার ভাঙনের এক বাস্তব চিত্র।
সামাজিক পরিবর্তন: নৈতিকতার অবক্ষয় নাকি আধুনিকতার নামে প্রতারণা?
আমরা লক্ষ্য করছি, সমাজের প্রথাগত মূল্যবোধগুলো ধীরে ধীরে ধ্বংস করা হচ্ছে। এক সময়ের ভারত, যে দেশ মহাত্মা গান্ধী, রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দের আদর্শে পথ চলতো, আজ সেই ভারত কীভাবে এমন পরিবর্তনের সম্মুখীন হলো?
- মাদক গ্রহণকে নতুন প্রজন্মের কাছে “ফ্যাশন” হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে, যার ফলে তরুণ সমাজ ধ্বংসের পথে যাচ্ছে।
- যৌনতাকে মনোরঞ্জনের বস্তুতে পরিণত করা হয়েছে, যা নৈতিকতার সীমারেখাকে ধূলিসাৎ করে দিয়েছে।
- পরকীয়া ও অবৈধ সম্পর্ককে সামাজিক স্বীকৃতি দেওয়ার ফলে পারিবারিক বন্ধন দুর্বল হয়ে পড়ছে, সৃষ্টি হচ্ছে সন্দেহ ও হিংসার আগুন।
- আত্মসুখ ও ব্যক্তিস্বার্থকে এতটাই বড় করে দেখা হচ্ছে যে, মানুষ মানবিকতাকে পিছনে ফেলে দিচ্ছে।
“সমাজ যদি নৈতিকতা হারায়, তবে সভ্যতাও একদিন ধ্বংস হয়।”— এই সতর্কবার্তা দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আজকের সমাজ কি সেই ধ্বংসের পথেই হাঁটছে না?
রাজনৈতিক সংকট: গণতন্ত্রের নীতি ভূলুণ্ঠিত
গণতন্ত্র মানে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, ন্যায়বিচার, সংবিধান ও আইনের শাসন। কিন্তু আজকের ভারত কি সেই গণতন্ত্রের পথেই হাঁটছে?
- সংসদে খোলাখুলিভাবে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষমূলক শব্দ ব্যবহার করা হচ্ছে।
- নির্বাচনী প্রচারে ধর্মীয় বিভেদ সৃষ্টি করে ভোটব্যাংক গঠন করা হচ্ছে।
- সংবিধানের মূলনীতিকে উপেক্ষা করে কিছু রাজনৈতিক নেতারা এমন ভাষা ব্যবহার করছেন, যা গণতন্ত্রের জন্য হুমকিস্বরূপ।
- বিচারব্যবস্থা ও নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে, প্রশাসন কখনো কখনো নীরব দর্শকের ভূমিকায় থাকছে।
“যে দেশে অন্যায়ের প্রতিবাদ নেই, সে দেশ ধীরে ধীরে মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়।”— কাজী নজরুল ইসলামের এই বাক্য আজকের পরিস্থিতির প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছে।
বিবেকহীন রাজনীতি: সংবিধান রক্ষকেরাই কি সংবিধান ভাঙছে?
কল্পনা করুন, একজন প্রধানমন্ত্রী সংবিধান রক্ষা করার শপথ নেওয়ার পর প্রকাশ্যে বলেন, “যাঁরা দশটি করে বাচ্চা প্রসব করে, তাদের ভোট দেবেন না।” অথবা একজন মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “হিজাব নিষিদ্ধ করা হবে, উর্দু ভারতের ভাষা নয়।”
এই ধরনের বক্তব্য শুধুমাত্র বিদ্বেষ ছড়ানোর জন্যই ব্যবহার করা হয়, যা গণতন্ত্রকে দুর্বল করে এবং সাম্প্রদায়িক বিভাজনকে উসকে দেয়। শাসক দলের নেতারা যখন দেখেন যে, তারা বিদ্বেষমূলক বক্তব্যের জন্য শাস্তি পাচ্ছেন না, বরং বাহবা পাচ্ছেন, তখন তারা আরও বেশি উগ্র হয়ে ওঠেন।
অন্যদিকে, আইন ও প্রশাসন নির্বিকার থাকে, যেন এটাই এখন নতুন স্বাভাবিকতা!
উত্তরণের পথ: কীভাবে এই সংকট থেকে বের হওয়া সম্ভব?
এই অন্ধকার সময় থেকে মুক্তি পেতে হলে আমাদের সবাইকে দায়িত্বশীল হতে হবে।
১. সচেতনতা বৃদ্ধি: জনগণের মধ্যে গণতন্ত্র, নৈতিকতা ও সংবিধান সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।
২. শিক্ষার পুনর্গঠন: সমাজে নৈতিক শিক্ষা ও মূল্যবোধকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে।
৩. সত্য প্রচার: স্বাধীন ও দায়বদ্ধ সাংবাদিকতা নিশ্চিত করতে হবে, যাতে মিথ্যা প্রচারের বিরুদ্ধে জনগণ সচেতন হয়।
৪. আইনি ব্যবস্থা: বিদ্বেষমূলক বক্তব্য ও সংবিধানবিরোধী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রয়োগ করতে হবে।
৫. সম্প্রীতির প্রচার: রাজনৈতিক বিভাজনের ঊর্ধ্বে উঠে সামাজিক ঐক্যের বার্তা ছড়াতে হবে।
গণতন্ত্র রক্ষা করুন, ভারতকে বাঁচান
আজ ভারত এক ক্রান্তিকালের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। গণতন্ত্রের শিকড় নড়বড়ে হয়ে পড়ছে, বিভেদের রাজনীতি মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে, সামাজিক ভারসাম্য ধ্বংসের পথে।
কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী—যখনই অন্ধকার ঘনিয়ে আসে, তখনই একদল সচেতন মানুষ সেই অন্ধকারের বিরুদ্ধে লড়াই করে নতুন আলো আনেন।
আমরা কি সেই পরিবর্তনের অংশ হবো? নাকি নির্বিকার দর্শক হয়ে থাকবো?
এখনই সময়, বিভেদের বিরুদ্ধে ঐক্যের পথে হাঁটার। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিটি ভারতবাসীর দায়িত্ব এই গণতন্ত্রকে রক্ষা করা, কারণ এটি কেবল একটি শাসনব্যবস্থা নয়—এটি আমাদের অস্তিত্ব, আমাদের স্বাধীনতা, আমাদের ভবিষ্যৎ।
“আগুন দিয়ে আগুন নেভানো যায় না, ভালোবাসা দিয়েই ঘৃণার অগ্নি নেভাতে হয়।”— মহাত্মা গান্ধীর এই উক্তি আমাদের স্মরণ রাখতে হবে।
আমরা যদি একসঙ্গে এগিয়ে চলি, তবে ভারতকে সত্যিকারের গণতান্ত্রিক, সাম্যবাদী ও শান্তিপূর্ণ করে গড়ে তুলতে পারবো। আমাদের লড়াই গণতন্ত্র বাঁচানোর লড়াই, আমাদের সংগ্রাম সত্যের পক্ষে দাঁড়ানোর সংগ্রাম।
“আমরা সবাই একসঙ্গে থাকলে, অন্ধকার কেটে যাবে—নতুন সূর্য উঠবেই।”