নেতাজিকে নিয়ে রাজনৈতিক টানাপোড়েন নির্জন কক্ষ। এক ছাত্র গভীর মনযোগ সহকারে পড়ছে। হাতে আই.সি.এস.-এর নির্দেশিকা। পড়ছেন একমনে। কি পড়ছেন তিনি? পড়ছেন একটি চটি বই – ‘আই.সি.এস. দের অবশ্য জ্ঞাতব্য’। তাতে বিষয়মর্ম – ‘ভারতবর্ষে ঘোড়ার যত্ন’। এক জায়গায় এসে তাঁর চোখ আটকে গেলো – ‘ভারতবর্ষে ঘোড়া আর সহিসরা একই খাবার খায়’। হ্যাঁ খায়ই তো। দু’জনেই তো ছোলা খায়। সহিসেও খায় আবার ঘোড়াতেও খায়। খায় বলেই তো লিখেছে। আরও কী লেখা আছে ? লেখা রয়েছে – ‘ভারতবর্ষে ব্যাবসায়ী মাত্রই অসাধু’।
মূহুর্তে রক্ত গরম হয়ে উঠল ছেলেটির। এমন নির্লজ্জ ভাষায় তাঁর দেশের অবমাননা ? তাঁর পক্ষে সহ্য করা অসম্ভব। দেশের মর্যাদা তাঁর কাছে সর্বাগ্রে। তখনি ছুটলেন ইংল্যান্ডের ইন্ডিয়া অফিসে। উদ্দেশ্য – সিভিল সার্ভিস বোর্ডের সেক্রেটারি রবার্টসের সঙ্গে দেখা করা। রবার্টসকে সরাসরি প্রশ্ন করলেন ছাত্রটি, “এমন ভুল নির্দেশ ছাপিয়েছেন কেন আপনারা? এক্ষুনি বাতিল করা হোক এসব”। সব শুনে প্রচণ্ড রেগে গেলেন রবার্টস। চোখ রক্তাভ করে বললেন, “সরকারি হুকুম মানতেই হবে। না মানলে চাকরি ছেড়ে দাও। “
— ছাড়ব তো নিশ্চয়ই, কিন্তু যাবার আগে ভুলগুলো সংশোধন করিয়ে তবেই যাব। চোখ রাঙিয়ে তা আটকাতে পারবেন না। ছাত্রটির একরোখা মনোভাব দেখে রবার্টস বুঝলেন এভাবে ছাত্রটিকে নিরস্ত করা যাবে না। সংশোধন করতেই হবে। কথা দিলেন সংশোধন করবে।
ছাত্রটি সুভাষচন্দ্র বসু।
সেই ছোটবেলায় বীর সন্ন্যাসী স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর মননে এক বিপ্লব আনে। সুভাষের যখন পাঁচ বছর বয়স তখন স্বামীজি প্রয়াত হন। স্বামীজির ভাবশিষ্য সুভাষ গুরুর প্রত্যক্ষ সংস্পর্শে আসতে পারেননি ঠিকই, কিন্তু তাঁর রচনা, বক্তৃতা ও চিঠিপত্র সুভাষের মনে দেশপ্রেমের আগুন জ্বালায়, জাগিয়ে তোলে মানবপ্রেমের ভাবধারা। স্বামীজির মানবপ্রেম ও স্বদেশপ্রেমের আদর্শের অপূর্ব সমন্বয় গড়ে ওঠে সুভাষের মধ্যে। স্বামীজির জ্বালাময়ী বাণী গড়ে তোলে জাতীয়তাবাদী সুভাষকে।

প্রখর মেধাবী সুভাষ ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস(আইসিএস) পরীক্ষায় চতুর্থ হয়েও তাতে যোগ না দিয়ে পরাধীন দেশমাতাকে উদ্ধারের সংকল্প করেন। জাতীয়তাবাদী নেতা দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের হাত ধরে সেই সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়ে রাজনীতিতে এসে পূর্ণ স্বরাজের দাবি তুললেন, যেখানে তৎকালীন জাতীয় নেতারা ক্ষমতার অংশীদার হতে সর্বোচ্চ স্বায়ত্বশাসন পর্যন্ত দাবি তুলতে পেরেছিলেন। স্বাধীনতার প্রশ্নে কোটি কোটি ভারতবাসীর অন্তরের কথা যেন সুভাষের কণ্ঠেই ধ্বনিত হল। দেশবাসী কংগ্রেস সভাপতি পদে তাকে সমর্থন দিয়ে জয়যুক্ত করলেন, ব্রিটিশদের কাছে ক্রমেই বিজ্জনক হয়ে উঠতে থাকলেন সুভাষ। আপসকামী রাজনীতিবিদদের কুটচালে দ্বিতীয়বার কংগ্রেস সভাপতি পদে বিপুল সংখ্যাগরিষ্টতা নিয়ে জয়ী হলেও পদত্যাগ করতে হল তাঁকে। একযোগে সুভাষচন্দ্র বসুকে লড়তে হয় ব্রিটিশ ও নিজ দেশের ষড়যন্ত্রকারীদের সঙ্গে সমানতালে।
কংগ্রেস সভাপতি পদ ত্যাগ করার পর ফের কারারুদ্ধ সুভাষ অনশন শুরু করলেন, অবস্থা বেগতিক দেখে কলকাতার নিজ বাড়িতে অন্তরীন করা হল তাঁকে। ব্রিটিশের পুলিশ-গোয়েন্দাদের হাজারো চোখে ধুলো দিয়ে সুভাষচন্দ্র বসু বেরিয়ে পড়লেন ঘর থেকে। এরপরের ঘটনায় তিনি কেবল ভারতবর্ষের নন, বিশ্বের এক কিংবদন্তি স্বাধীনতা সংগ্রামী মহান নেতায় পরিণত হলেন, হলেন সবার প্রিয় নেতাজি। তিনি ছিলেন জাতীয়তাবাদী, স্বদেশী এবং এক আন্তর্জাতিক মানের বাঙালি।
‘স্বাধীনতা চেয়ে পাওয়া যায় না, ছিনিয়ে নিতে হয়’। এই বোধই বাঙালি সুভাষের পরিচয় বদলে উন্মেষ ঘটিয়েছিল বিপ্লবী সুভাষের। স্রেফ বাংলা ও বঙ্গ জাতিতে আবদ্ধ না থেকে, সুভাষ স্বপ্ন দেখলেন স্বাধীন ভারতের। ডাক দিলেন ‘আজাদি’-র। আর তার এই ডাকে তিনি যেমন সঙ্গে পেলেন রাসবিহারী বসুকে, তেমনই তাঁর কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াইয়ের জন্য পাশে পেয়ে গেলেন আবিদ হাসান, লক্ষ্মী সেহগলের মতো সেনানীকেও।
নেতাজি বিশ্বের ক্ষমতাধরদের কাছ থেকে ভারতমাতাকে উদ্ধারের সমর্থন-সহযোগিতা আদায় করতে বেশি সময় নেননি। শক্তিশালী ব্রিটিশ-মার্কিন যৌথশক্তির বিরুদ্ধে নেতাজির এই যুদ্ধে আরেক ক্ষমতাধর জাপানসহ বেশকিছু দেশ পাশে থাকলেও তাঁর মূলশক্তি ছিল দেশপ্রেমের, সততার ও আদর্শের। নেতাজি তাঁর গঠিত আজাদ হিন্দ ফৌজের প্রতিটি সেনার অন্তরের সেই আদর্শের বীজ যথাযথভাবে রোপণ করতে পেরেছিলেন। সেই যুদ্ধে আজাদ হিন্দ ফৌজের হাজার হাজার সৈন্যের বলিদানের বহু বীরত্বগাঁথা ইতিহাসে ঠাঁই পায়নি।
জাপানের সহায়তায় নেতাজির নেতৃত্বে আজাদ হিন্দ ফৌজ ব্রিটিশের বিরুদ্ধে পরিচালিত যুদ্ধে অভূতপূর্ব সাফল্য পায়। রক্তক্ষয়ী সেই যুদ্ধে ব্রিটিশদের পরাভূত করে মনিপুর-আন্দামান ও নিকোবর (নেতাজি যার নাম দেন ‘শহীদ দ্বীপ’ ও ‘স্বরাজ দ্বীপ’ ) সহ বিস্তীর্ণ ভারতভূমি অধিকার করে আজাদ হিন্দ ফৌজ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সেই সময়ে জাপানের আত্মসমর্পণ নেতাজির লড়াইয়ে ছন্দপতন ঘটায়। কিন্তু দেশজুড়ে গণমানুষের মাঝে যে অগ্নিস্ফূলিঙ্গ তিনি ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হন তা ব্রিটিশদের বিতাড়নের পথকে প্রশস্ত করে। স্বাধীনতার প্রশ্নে গণজোয়ারের সঙ্গে নৌবাহিনীতে বিদ্রোহ শুরু হয়। তার পরের ইতিহাস আমাদের সকলের জানা।

প্রাক স্বাধীনতা পর্বে সুভাষ চন্দ্র বসু প্রথম ভারতীয়, যিনি ভারতীয়দের নিয়ে তৈরি করেছিলেন ‘ফ্রি ইন্ডিয়া সেন্টার’। সেখানে বাঙালি সংকীর্ণতা ও সাম্প্রদায়িকতার কোনও স্থান ইতিহাসে অন্তত খুঁজে পাওয়া যায় না। জাপানের সহায়তায় তৈরি হয়েছিল ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি, যা পরিচিত আজাদ হিন্দ ফৌজ নামেও। যাদের এক এবং অভিন্ন লক্ষ্যই ছিল ‘আজাদি’। মোহন সিং ছাড়াও স্বরাজ-এ বিশ্বসী নেতাজী ফৌজ-এ ছিলেন জগন্নাথ রাও ভোসলে, শাহ নওয়াজ খান, পি কে সেহগাল সহ হাবিবুর রহমানের মতো নেতৃ্ত্বরা। ছিলেন কর্নেল এসি চ্যাটার্জির মতো বাঙালিও।
এখানেই কি শেষ? না একেবারেই নয়। পরাধীন ভারতের প্রথম স্বশাসিত সরকার, যার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন স্বয়ং নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু। সুভাষের সেই মন্ত্রিসভায় এসি চ্যাটার্জির নাম যেমন ছিল, তেমনই ছিল লক্ষ্মী স্বামীনাথন, এ ম সহয়, এস এ আইয়ার, করিম জিয়ানি, সর্দার ঈশ্বর সিং, ডি এম খান, এম ইয়েলাপ্পা সহ দেবনাথ দাসের মতো ব্যক্তিত্বরা। সুভাষের গড়া সরকারের স্লোগান ছিল ‘জয় হিন্দ’। আদর্শ ছিল – বিশ্বাস, একতা এবং আত্মত্যাগ। এমনকি গোটা ভারতকে এক সুতোয় বাঁধতে রবীন্দ্রনাথের জন গণ মন-র ভাষান্তর করিয়ে সুভাষ সৃষ্টি করেছিলেন ‘শুভ সুখ চেন’। এই গানের ভাষান্তর করেছিলেন আবিদ হুসেন।
দেশভাগের মত সুদূরপ্রসারী সর্বনাশ করে ভারত ছেড়ে যায় ব্রিটিশরা। রেখে যায় তাদের অনুগত দোসরদের, যারা নেতাজিকে মৃত প্রতিপন্ন করার চক্রান্তে মেতে উঠে। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর প্রকাশ্যে শারীরিক অনুপস্থিতির (১৯৪৫-এর পর থেকে) কয়েক দশক পেরিয়ে বহু তথ্য বহু কল্পকাহিনী ডানা মেলেছে। তাঁর বেঁচে থাকার বহু তথ্য প্রকাশ্যে এলেও ‘নেতাজি মৃত’ এমন প্রামাণ আজও অনুপস্থিত।
নেতাজি বরাবরই মনে করতেন, ‘একজন মানুষ একটি আদর্শের জন্য মৃত্যু বরণ করতে পারে। কিন্তু সেই আদর্শ তাঁর মৃত্যুর পরও হাজার হাজার মানুষের মধ্যে বেঁচে থাকে।’ জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এই আদর্শেই তিনি বেঁচেছেন এবং এই আদর্শকেই ভারতবাসীর পাথেয় করে গিয়েছেন। কিন্তু তাঁর আদর্শকে জলাঞ্জলি দিয়ে তাঁকে নিয়ে চলছে রাজনৈতিক টানাহ্যাঁচড়া। কে কত নেতাজির নিকট তা নিয়ে চলছে জোর প্রতিযোগিতা। টিভির পর্দায় গরমাগরম আলোচনা, সমালোচনার ঝড়। রাজনৈতিক নেতানেত্রীদের কথাবার্তায়, চালচলনে উপচিয়ে পড়ছে গদগদ নেতাজিপ্রেম। কে আগে নেতাজির গুণগান করবে তাই নিয়ে চলছে জোর তরজা। নেতাজি ছিলেন সাম্য, মৈত্রী, একতা, অসাম্প্রদায়িকতার প্রতিমূর্তি। নেতাজীর দ্বারা আজীবন লালিত পালিত বিষয়গুলিকে পদদলিত করে নেতাজিকে নিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা তুলতেই ব্যস্ত নেতানেত্রী ও তাঁদের সাঙ্গপাঙ্গরা। হার রে ভারতবর্ষ!