এক গুচ্ছ প্রশ্ন নিয়ে রাজ্যের মন্ত্রী তথা কলকাতা পুরসভার মেয়র ফিরহাদ হাকিমের কাছে গিয়েছিলেন টিডিএন বাংলার সম্পাদক মোকতার হোসেন মণ্ডল। সাক্ষাৎকারটি নীচে তুলে ধরা হল –
টিডিএন বাংলা: ২০১৫ সালে এমএসকে শিক্ষকেরা হাজী মুহাম্মদ মহসিন স্কোয়ারে ধর্ণায় বসেছিলেন। ৪১ দিন পর আপনার অনুরোধে তারা ধর্ণা তুলেছিলেন। কিন্তু দীর্ঘ ১৪ থেকে ১৫ বছর মাদ্রাসা শিক্ষা কেন্দ্রে শিক্ষক নিয়োগ হয়নি। কী বলবেন?
ফিরহাদ হাকিম: দেখো এটা তো শিক্ষা দপ্তরের ব্যাপার। তাছাড়া একটা স্কিম চলছিল সেটাও কেন্দ্র সরকার বন্ধ করে দিয়েছে। এই ব্যাপারে সরকার কোন ডিসিশন নেয়নি। তবে এটা আমি বার বার বলেছি যে একটা কোন ডিসিশন নিতে হবে তার কারণ, না হলে অনেকগুলো বেকার ছেলের অসুবিধা হবে। দ্বিতীয়ত এখন কোন রিক্রুটমেন্টই হচ্ছে না যেহেতু সুপ্রিম কোর্টে ওবিসি কেসটা পেন্ডিং আছে। ওবিসি ব্যাপারটা যতক্ষণ না সমাধান হচ্ছে ততক্ষণ হচ্ছে না। আমি মুখ্যমন্ত্রীকে বলেছি, দিল্লিতেও খবর পাঠানো হয়েছে যাতে চিফ জাস্টিসের কোর্টে গিয়ে বলা হয়, এটা খুব ইম্পর্টেন্ট কেস, এটা যাতে ইমিডিয়েটলি শোনা হয়। এইটা হয়ে গেলে আমার মনে হয় যে সব রিক্রুটমেন্টের ক্ষেত্রেই আমাদের অনেকটা সুবিধা হবে।
টিডিএন বাংলা: সাচার কমিটির রিপোর্টে মুসলিমরা পশ্চিমবঙ্গে সবচেয়ে বঞ্চিত বলে প্রতিফলিত হয়েছে। তারপর এটা কে আপনারা ইস্যু করে ক্ষমতায় এসেছেন। বলা হয়, মুসলিমরা আপনাদের ঢেলে ভোট দেয়। কিন্তু লক্ষীর ভান্ডারে এস সি,এসটি মহিলাদেরকে দেওয়া হয় ১২০০ টাকা। অন্যদিকে মুসলিম মহিলারা পায় ১০০০টাকা। মুসলিম মেয়েরাও তো পিছিয়ে। তাদেরও এক রকম হওয়া উচিৎ নয় কি ?
ফিরহাদ: না সেটা হওয়া উচিত না। তার কারণ হচ্ছে যে, লক্ষ্মীর ভান্ডার এসটি একটি আলাদা সেল। এসটি রিকমন্ডেশন,এসসি রিকমেন্ডেশন আলাদা। মুসলিমদের ক্ষেত্রে আমরা কিন্তু জেনারেল ক্যাটাগরি। সুতরাং আমাদের লক্ষীর ভান্ডারে ইস্যুটা বড় ইস্যু নয়। আমাদের যেটা বড় ইস্যু সেটা হচ্ছে যে, আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন মুসলমানদের হয়েছে কি না এবং আমি নিশ্চিত যে হারে ডাক্তার থেকে আরম্ভ করে ইঞ্জিনিয়ার থেকে আরম্ভ করে রিক্রুটমেন্ট হচ্ছে, যেটা সেন্ট্রাল গভমেন্ট এবং বিজেপি বারবার করে তুলে ধরছে আমরা অ্যাপরিসমেন্ট পলিটিক্সে যাচ্ছি। সেইজন্যে আমাদের এই সরকার আসার পরে আর্থ- সামাজিক উন্নয়ন মুসলমানদের হয়েছে যেটা অনেক বেশি দরকার।
টিডিএন বাংলা: রাজনীতিতে মুসলিম মেয়েদের প্রতিনিধিত্ব তো বাড়েনি।
ফিরহাদ: নিশ্চয়ই হয়েছে। পলিটিক্সে অনেক বেশি হয়েছে। অনেক মেয়েরা এগিয়ে এসেছে। নারী সমাজে অনেক এগিয়ে এসেছে। আজ নার্সিং থেকে, ডাক্তারি থেকে আরম্ভ করে, ইঞ্জিনিয়ারিং থেকেআরম্ভ করে, ডাব্লিউবিসিএস থেকে আরম্ভ করে আইএস হয়েছে।
টিডিএন বাংলা: জনপ্রতিনিধি?
ফিরহাদ: জন প্রতিনিধিও অনেক হয়েছে। আমি যদি বলি জনপ্রতিনিধি আগে যা ছিল তার থেকে ফিফটি পার্সেন্ট বেড়েছে মুসলিমদের মধ্যে। এবং মুসলিম মেয়েরা অনেকে এসেছে। জনপ্রতিনিধি আর একটা জিনিস মনে রাখতে হবে। সমাজ যত শিক্ষিত হবে। যত এগিয়ে আসবে। আফলিপমেন্ট হবে তত জন প্রতিনিধি বেরোবে। তুমি ইচ্ছে হলে জন প্রতিনিধি হবে না। যে জন প্রতিনিধি হবে তার কন্ট্রিবিউশন টু সোসাইটিতে থাকবে, তবে তোমাকে ভোট দেবে। যে কোন লোক এসে আমার বিরুদ্ধে দাঁড়ালেই জিততে পারবেনা। আমার বিরুদ্ধে প্রত্যেক বছর প্রত্যেক ইলেকশনে মুসলিম সমাজ থেকে তিনজন করে দাঁড়ায় কিন্তু জামানত জব্দ হয় । কিন্তু আমি জিতি এবং রেকর্ড ভোটে জিতি। তার কারণ হচ্ছে যে পাবলিক কন্ট্রিবিউশন থাকতে হবে। পাবলিকের সঙ্গে মিশা মিশি থাকতে হবে। অর্গানাইজেশন থাকতে হবে। তবেই তুমি জনপ্রতিনিধি হতে পারবে।
টিডিএন বাংলা: রাজ্যসভায় তো মুসলিম মেয়েদের পাঠাতে পারেন।
ফিরহাদ: রাজ্য সভায় পাঠানো যায়। কিন্তু ব্যাপার হল যে, সেই পরিস্থিতি এখনো আসেনি। তবে নিশ্চিতভাবে সেই রকম ডেভেলপমেন্ট, সেরকম পজিশনের মহিলা থাকে তবে নিশ্চয়ই কনসিডার করা যেতে পারে। যে রকম আমাদের সুলতান আহমেদের ওয়াইফ এখন আমাদের লোকসভার মেম্বার আছেন। আমাদের হাজী সাহেব ছিলেন মারা গেলেন। এরকম অনেক মুসলিম কমিউনিটি থেকে এমপি আছেন।
টিডিএন বাংলা: স্টাফ সেনসাস বন্ধ হয়ে গেছে, ফলে বুঝতে পারছি না যে বাম আমল থেকে তৃণমূল আমলে মুসলিমরা চাকরি-বাকরিতে এগিয়েছে কিনা?
ফিরহাদ: সেন্সর টা বন্ধ, আর নেই। এই সেন্সরটা বন্ধ করে রেখেছি আমি। কারণ এটা যদি সেন্ট্রাল গভমেন্ট হাতে পায়, এনসিআরবি রিপোর্টের মত, তাহলে ওরা অ্যাপ্রিজমেন্ট বেইজ্জত করার চেষ্টা করবে। আপ্রিজম্যান পলিটিক্স করছে। একচুয়ালি এই সরকার এপ্রিজমেন্ট পলিটিক্স করে না। মমতা ব্যানার্জির সরকার যে রকম মুসলমানদের আপ্লিপমেন্ট এর জন্য কাজ করছে তেমনি এস টি, এস সি যারা পিছিয়ে রয়েছে তাদের আপ্লিপমেন্ট করছেন। তাতে কেন হিন্দু মুসলিম হবে? কিন্তু দুর্ভাগ্য হচ্ছে যে আমাদের সেন্ট্রাল গভমেন্ট তারা সব সময় হিন্দু মুসলিম দেখে, মানুষ দেখে না।
টিডিএন বাংলা: বলা হয় কর্ণাটক, কেরল সহ অন্য রাজ্য ওয়াকফ সম্পত্তিকে ভালোভাবে ইউজ করেছে, বিভিন্ন জায়গায় বড় বড় প্রতিষ্ঠান হয়েছে, কমিউনিটি সেন্টার সহ এডুকেশন হাব হয়েছে, কিন্তু আমাদের এখানে কম মনে হচ্ছে।
ফিরহাদ: না, কম হয়নি, বেশি হয়েছে। তার কারণ হচ্ছে যে আমাদের যে ওয়াকফ যেটা ডেভেলপমেন্ট গুলো হয়েছে। সে ডেভেলপমেন্ট গুলো খুব কম জায়গায় হয়েছে। দ্বিতীয়ত, আমাদের আলিয়া ইউনিভার্সিটি হয়েছে। আমাদের যে হজ হাউস হয়েছে, এগুলা আবার অন্য জায়গা হয়নি। হোস্টেল তো পর্যাপ্ত হয়েছে। আমার নিজেরই একটা হোস্টেল আছে চেতলাই। ১০০% হিন্দু এলাকা কিন্তু ওয়াকফ হোস্টেল আছে। যেখানে মুসলিম ছেলেরা থেকে পড়াশোনা করে।
টিডিএন বাংলা: মাইনোরিটি স্ট্যাটাস প্রাপ্ত কলেজ, মেডিকেল কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ যেটা খ্রিস্টান সমাজের আছে, সেটা মুসলিমদের খুব কম বলে মনে করা হয়। এটার কারণ কি?
ফিরহাদ: তার কারণ হচ্ছে যে আমাদের কমিউনিটি থেকে এগিয়ে আসেনি। তবে আমি এটা চেষ্টা করছি। মাইনোরিটি স্ট্যাটাস মেডিকেল কলেজ করা দরকার। যেমন মাইনোরিটির আল-আমিন মিশন আছে। যেমন মিল্লী আলামিন কলেজ আছে। সেই রকম যাতে আরো কলেজ এগিয়ে আসে সেটা নিশ্চিতভাবে আমরা চেষ্টা করব। সরকারের থেকে বেশি কমিউনিটির চেষ্টা করা দরকার। এবং এটা আমার দায়িত্ব, আমি করব।
টিডিএন বাংলা: ধরুন সুপ্রিম কোর্টে কোন কারনে ওবিসি মামলায় হেরে গেলেন? তারপরে গভমেন্টের কী করনীয়?
ফিরহাদ: আবার আমাদের সার্ভে করাতে হবে, সার্ভে করে ওবিসি কমিশনের মাধ্যমে এসে আমাদের নতুন আইন তৈরি করতে হবে।
টিডিএন বাংলা: সেই পথটা আছে?ফিরহাদ: নিশ্চয়ই আছে। এটা সরকারের ইচ্ছা যে ওবিসির মাধ্যমে আমাদের কমিউনিটির রিজার্ভেশন থাকুক। আর হ্যাঁ ৩৭টা কোনও অসুবিধা নেই, ৩৭ টা হতেই পারে, আর যে ৩৭ টা যে কমিউনিটি আছে তাদের আমরা আবার সার্ভে করে ওবিসি কমিশনের মাধ্যমে নিয়ে আসবো।
টিডিএন বাংলা: তৃণমুল কংগ্রেস আমলে মুসলিম বিধায়ক সংখ্যা কিন্তু কমেছে। যেখানে ৫৯ কিংবা ৫৭ ছিল সেটা ৪৩,৪৪ এসে ভিড়েছে।
ফিরহাদ: (একটু থেমে) বিধায়ক সংখ্যা কমেনি। আমার কাছে এটা মনে হয়েছে, কে বিধায়ক হল, কে হল না, তার থেকে বড় কথা কমিউনিটির ডেভলপমেন্ট হচ্ছে কিনা। সেটা অনেক বেশি প্রয়োজন। যদি কেউ হেরে যায় তাকে তো আর জোরপূর্বক জেতানো যায়না। সুতরাং তার থেকেও বেশি হচ্ছে, কমিউনিটির ডেভলপমেন্ট হচ্ছে কিনা, আর্থ-সামাজিক উন্নয়নটা মুসলমানদের হচ্ছে কিনা, সেটা অনেক বেশি প্রয়োজন।